
একটা কথা আছে - “যত কম, তত ভালো।” কথাটি শুনলে মনে হতে পারে এ কোনো অলস মানুষের ভবনা। আসলে তা নয়। এটি একটি দর্শন নাম : মিনিমালিজম। বাংলায় বলা যায় সরলবাদ অথবা নূন্যতমবাদ।
এই কম মানে কমতি নয়, এই কম মানে অল্পতে সন্তুষ্ট থাকা। যখন যা থাকে, অপ্রয়োজনীয় এবং বাহুল্য তা কমিয়ে সুখের প্রাচুর্য আনা।
লেখক লিও বাবাউটা লিখেছিলেন - সরলতা হল জটিলতা থেকে মুক্তি পাওয়া। আমি বড় হয়েছি বিগত শতকের শেষার্ধে। আশি আমার কিশোর হলে নব্বই তারুণ্য। এমন এক সময়ে বেড়ে উঠেছি, যখন সামাজিক মূল্যবোধ এবং সফলতার সংজ্ঞা নির্ভরশীল ছিল কিছু বস্তুগত এবং সামাজিক অর্জনের ওপর। হয়তো এখনো তাই আছে সমাজে। হয়তো আগের চেয়ে আরও বেশি হয়েছে। যার যত বেশি আছে, সে-ই সফল, এমনটাই শেখানো হয়েছে ছোটবেলা থেকে। কিন্তু যত বয়স বেড়েছে, অভিজ্ঞতার চুল পেকেছে, ততই বুঝেছি, বস্তুগত প্রাচুর্য মানে সুখ নয়। তথাকথিত সাফল্য মানে শান্তিও নয়। অনেকক্ষেত্রে এটি বরং জীবনকে জটিল করে তোলে, অহেতুক অস্থিরতা বাড়ায় আড়ালে। অতিরিক্ত যে কোন কিছুই সুখের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এটাই অভিজ্ঞতার মূল কথা।
প্রথম যখন মিনিমালিজম সম্পর্কে জানতে পারি, তখনই বুঝতে পারি যে - এটি কেবল জীবনের প্রয়োজন কিংবা জিনিসপত্র কমানোর ব্যাপার নয়। মিনিমালিজম এমন একটি জীবন পদ্ধতি, যা মানসিক চাপ কমায়, আবেগের ভারমুক্তির একটি উপায় হয়ে যায়, যখন যেটুকু হাতের কাছে থাকে, সেটুকু তে অপূর্ণতার পরিবর্তে পূর্ণতার ছায়া খুঁজে পায়।
নিজের জীবনে এমন দর্শনের প্রয়োগ করতে শুরু করলাম। একধারে অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ত্যাগ করলাম, অপ্রয়োজনীয় ব্যস্ততা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলাম, অপ্রয়োজনীয় সম্পর্কগুলো থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চেষ্টা করলাম। ফলাফল ? জীবনে ভালো থাকা এবং জীবনকে ভালো রাখার সুযোগ পেলাম।
মিনিমালিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ জোশুয়া বেকার বলেছিলেন - মিনিমালিজম হল এমন একটি টুল যা আপনাকে মুক্তি দেয়। ভয়, উদ্বেগ, অতীতের বোঝা, অপ্রয়োজনীয় জিনিস থেকে মুক্ত করে আপনাকে।
সমাজের কাজ প্রতিযোগিতা তৈরি করা। এর মাধ্যমে সমাজ আমাদের মাঝে একধরনের মিথ্যা চাহিদা সৃষ্টি করে। যা নেই, সেটা দরকারি না হলেও চাই, এমন ইমোশান তৈরি করে আপনার ভেতর ! এটি তৈরি করে বিভিন্ন মিডিয়ায় মাধ্যমে। কখনো বিজ্ঞাপন, কখনো সামাজিক মিডিয়া, সাথে সমাজ ব্যবস্থা এবং বাজারব্যবস্থা আমাদের শেখায় যে - আরও বেশি কিছু পাওয়া দরকার, আরও উন্নত মানের জিনিস কিনতে হবে।
বিজ্ঞাপনের একটি গোপন দর্শন হলো - আপনার ভেতর এই নিঃশ্বাস এবং বিশ্বাস ঢুকানো যে - কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি দরকার না থাকলেও আপনার ওটা চাই। প্রয়োজনটি সামনে দাঁড়াবার আগেই আপনার ভেতর সেই চাহিদা তৈরি করা বিজ্ঞাপন গুলোর কাজ। মার্কেটিং প্রচারণাগুলো গোপন মিশন হলো - আপনার কাছে তাদের পণ্য বিক্রি করা। আপনার প্রয়োজন-অপ্রয়োজন বুঝা তাদের কাজ না। সে কাজ আপনাকে আমাকেই করতে হবে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ‘আরও বেশি’র পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা আসলে কী হারাই ? প্রকৃতই কি কিছু পাই ?
আমরা আসলে সময় হারাই। আমাদের ভেতরকে হারাই। আরও অধিক প্রাপ্তি, আরও অধিক সম্পদ অর্জনের জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম করি। পরিশ্রম আমাদের সময় কেড়ে নেয়; বিনিময়ে আনন্দ উপভোগের সময়ই পাই না। অতিরিক্ত চাহিদা মানসিক চাপে ফেলে। যা নেই, সেটার জন্য দুশ্চিন্তা করতে গিয়ে যা আছে, সেটার মূল্য বুঝতে পারি না। কর্মব্যস্ত জীবনে প্রিয়জনের জন্য সময় দিতে পারি না, সম্পর্কের দূরত্ব বাড়ে, সম্পর্কগুলো বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে ঠিকই অপ্রয়োজনের পেছনে ছুটতে থাকি আমরা।
অতিরিক্ত জিনিস সুখী করে না; বরং ভারাক্রান্ত করে, আমাদের বোঝা বাড়ায়, সুখ কমিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ায়। তাই মনে হয় যে - সরলতায় সুখ, সরলতায় শান্তির চাবিকাঠি জীবনে।
সরলতার দর্শনটি প্রাচীনকাল থেকেই স্বীকৃত। গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের মতে “আমি কত কিছুই না ছাড়া থাকতে পারি !” অর্থাৎ প্রয়োজনীয় জিনিস সীমিত, কিন্তু আমরা অহেতুক অনেককে প্রয়োজনীয় করে তুলি।
আরেকজন গ্রীক দার্শনিক ডায়োজিনিস তো একেবারে সামান্য কিছু জিনিস নিয়ে জীবন কাটিয়েছিলেন। তিনি একটি পাইপের মধ্যে থাকতেন। আর বলতেন, “আমি সম্পদের নয়, স্বাধীনতার মালিক হতে চাই ।”
গৌতম বুদ্ধ বলেছিলেন, “আকাঙ্ক্ষা কমালে দুঃখ কমে ।” আসলে বস্তুগত জিনিসের প্রতি আসক্তি যত কমবে, ততই মানসিকভাবে স্বাধীন হবেন আপনি ।
স্টিভ জবস মিনিমালিজম দর্শনটি জীবনে মেনে চলতেন। পরিণত বয়সে তিনি সরলতার পক্ষে ছিলেন, মিতব্যয়িতা এবং সংযমের পক্ষে ছিলেন। তিনি বলতেন, “সরল জিনিসই সবচেয়ে উন্নত হয় ।” অ্যাপলের বিভিন্ন প্রোডাক্ট এর নকশায় তার এই দর্শনে বার বার প্রতিফলিত হয়েছে। চমকপ্রদ নয়, বরং কার্যকর ও সরল ডিজাইনের দিকেই তিনি মনোযোগ দিয়েছিলেন। পরের পর্যায়টি তো আমরাই সাক্ষী। ফোন থেকে মিউজিক, কম্পিউটার থেকে আইপ্যাড, প্রযুক্তি আর প্রোডাক্ট এ তার মিনিমালিজম দর্শন পুরো কম্পিউটার জগতকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
মনোবিজ্ঞানীরা দেখেছেন, অগোছালো পরিবেশ এবং অপ্রয়োজনীয় বস্তু মানসিক চাপ বাড়ায়। অপ্রয়োজনীয় চিন্তা, অতিরিক্ত দায়িত্ব এবং অবাঞ্ছিত প্রতিযোগিতা মনোজগতকে ভারী করে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মানুষ কম জিনিসপত্র নিয়ে জীবন চালাতে পারেন, তারা বেশি সুখী এবং উৎপাদনশীল হন। তাদের মধ্যে উদ্বেগ কম থাকে।
তারা সহজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। জীবনের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব রাখেন তারা।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, যখন থেকে অপ্রয়োজনীয় জিনিস কমিয়ে দিয়েছি, ঠিক তখনই মনে হয়েছে - আমি হালকা, আমি অনেকটা ভারমুক্ত, আমি চিন্তামুক্ত, আমি আনন্দিত এবং সুখী। মিনিমালিজম আমাকে ভালো রেখেছে, মিনিমালিজমে আমি ভালো থেকেছি।
কেমন করে জীবনে মিনিমালিজম আনবেন, সেটা সম্পর্কে বলতে গিয়ে মারি কন্ডোর বলেছিলেন, “যে জিনিসগুলো আপনাকে আনন্দ দেয়, শুধু সেগুলোই রাখুন। বাকি সবকিছু বাদ দিন ।”
মিনিমালিজম মেনে চলা তেমন কঠিন নয়। কেবল মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। কিছু সহজ ধাপ অনুসরণ করলেই এ পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব-
১. অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ত্যাগ করুন। খুঁজে দেখলে দেখবেন যে - আপনার ঘরে এমন অনেক কিছু আছে, যা কখনোই ব্যবহার করা হয় না। শুধু শুধু পড়ে আছে ঘরে। অপ্রয়োজনীয় কাপড়, আসবাবপত্র, প্রযুক্তি, গ্যাজেট কিংবা এমনসব পণ্য সরিয়ে ফেলুন কিংবা নতুন আর কেনার পরিকল্পনা করবেন না ।
২. প্রয়োজনীয় জিনিস বেছে নিন। নিজের জন্যে শুধু প্রয়োজনীয় এবং অর্থবহ জিনিস রাখুন।
৩. ব্যস্ততাকে কমান। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করুন। অপ্রয়োজনীয় কাজ এড়িয়ে চলুন।
৪. সীমিত সম্পর্ক বজায় রাখুন। যারা সত্যিকার আপনাকে মূল্য দেয়, তাদের সঙ্গেই সম্পর্ক রাখুন।
৫. নিজেকে প্রশ্ন করুন । নতুন কোন কিছু কেনার আগে নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন, সত্যিই কি এটি আমার প্রয়োজন?”
আজকের জটিল বিশ্বে মিনিমালিজম কেবল একটি জীবনধারা নয়; হয়ে উঠতে পারে একটি বিপ্লব। অতিরিক্ততার শৃঙ্খল ভেঙে, অহেতুক প্রতিযোগিতা থেকে নিজেকে মুক্ত করে, মিনিমালিজম বা সরলতার এই পথে আরও বেশি সুখী হয়ে উঠতে পারি আমরা। একবাক্যে বলতে পারি - নিজের জীবনে মিনিমালিজম বা সরলতা আমাকে মানসিক শান্তি ও পরিপূর্ণতা দিয়েছে। যখন অপ্রয়োজনীয় জিনিস এবং উদ্বেগ থেকে নিজেকে মুক্ত করেছি, তখনই বুঝেছি-সত্যিকারের সুখ বহরের নয়, ভেতরের।
সুখী হতে চাইলে খুঁজে নিন কমের মাঝে বেশি ।
প্যানেল