ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৫ মে ২০২৫, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

চেতনার জলছবি

আধুনিক কথাসাহিত্য

সাদিয়া ফয়জুন

প্রকাশিত: ১৮:১৫, ১৫ মে ২০২৫

আধুনিক কথাসাহিত্য

ভার্জিনিয়া উলফ

ইংরেজি সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক ও সমালোচক ভার্জিনিয়া উলফ (১৮৮২-১৯৪১)। তিনি উপন্যাসের শৈলীতে আনেন নতুনত্ব। এবং প্রচলিত বা ঐতিহ্যবাহী ধারা থেকে সরে গিয়ে হেঁটেছেন ভিন্ন পথে। “মডার্ন ফিকশন” প্রবন্ধটি ১৯১৯ সালে লেখা হলেও ১৯২১ সালে 'Monday or Tuesday' নামে একটি ছোটগল্প সংকলনে প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধে উলফ, পূর্ববর্তী সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মের রীতিনীতির সমালোচনা করেছেন। এবং নতুন লেখকদের উদ্দেশে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন- তাঁরা যেন নিজেদের অনুভূতি ও চিন্তাকে প্রাধান্য দেন, বাজারের চাহিদা বা সমাজের প্রত্যাশা অনুযায়ী না লেখেন।
ভার্জিনিয়া উলফ মনে করেন, আধুনিক লেখকদের উচিত তাদের মনের আবেগ ও উপলব্ধি অনুসারে লেখা। তিনি বলেন, লেখকরা প্রকাশকদের শর্ত এবং সমাজের গৎবাঁধা নিয়মের মধ্যে বন্দি হয়ে পড়েছেন। তাঁদের সাহিত্যে জীবনের গভীর সত্য প্রতিফলিত হচ্ছে না। উলফ চান, লেখকরা জীবনের জটিলতা ও অনিশ্চয়তাকে তুলে ধরুক, কেবলমাত্র পরিচিত ও গৃহীত বিষয়গুলোর মধ্যে নিজেদের সাহিত্যকর্মকে সীমাবদ্ধ না রাখুক।
এই প্রবন্ধটি মূলত ভিক্টোরিয়ান যুগের উপন্যাসের ধারা থেকে আধুনিক কথাসাহিত্যকে পৃথক করেছে। উলফ প্রথমে ১৮ শতকের ঔপন্যাসিকদের পথচলা ব্যাখ্যা করেন এবং বলেন, তাঁরা তাঁদের সাধ্যের মধ্যে যথাসম্ভব ভালো কাজ করেছেন। তাঁর ভাষায়,  'Fielding did well and Jane Austen even better'- অর্থাৎ ফিল্ডিং ভালো করেছেন, কিন্তু জেন অস্টিন আরও ভালো করেছেন।
উলফ এই প্রবন্ধে এইচ জি ওয়েলস, আর্নল্ড বেনেট এবং জন গলসওয়ার্দির কড়া সমালোচনা করেন। তিনি তাঁদের 'materialists' বলে আখ্যা দেন, কারণ তাঁদের উপন্যাসে জীবনের বাহ্যিক দিক বেশি গুরুত্ব পায়, কিন্তু আত্মার গভীরতা অনুপস্থিত। বেনেটের লেখা সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে, কারণ তাঁর উপন্যাস কাঠামোগতভাবে নিখুঁত হলেও তাতে জীবনের অন্তর্নিহিত সত্তা অনুপস্থিত। উলফ মনে করেন, এই লেখকদের উপন্যাস থেকে নতুন প্রজন্মের লেখকদের শেখার কিছু নেই। বরং তাঁদের ভুল এড়িয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়াই শ্রেয়।


কিন্তু উলফ নতুন ধারার লেখকদের প্রশংসা করেছেন। তিনি জেমস জয়েস, থমাস হার্ডি, জোসেফ কনরাড, উইলিয়াম হেনরি হাডসন এবং আন্তন চেখভের লেখাকে আধুনিক সাহিত্যের প্রকৃত দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখান। তিনি বলেন, এই লেখকরা জীবনের ভেতরের বাস্তবতা ও মানুষের মনস্তত্ত্বের গভীরতা তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। বিশেষ করে জেমস জয়েস সম্পর্কে তিনি বলেন, তিনি যা অনুভব করেন, তাই লেখেন।
উলফের মতে, 'a luminous halo, a semi-transparent envelope surrounding us from the beginning of consciousness to the end'- অর্থাৎ জীবন এক উজ্জ্বল বলয়, যা আমাদের চেতনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘিরে থাকে। তিনি মনে করেন, জীবন ধারাবাহিক, স্থির নয়, বরং এক প্রবাহমান প্রক্রিয়া। তাই লেখকদের উচিত এই পরিবর্তনশীলতাকে তুলে ধরা, প্রচলিত কাঠামো বা নিয়ম মেনে চলার প্রয়োজন নেই।
এই ভাবনার ওপর ভিত্তি করেই উলফ “স্ট্রিম অব কনশাসনেস” ধারার অন্যতম প্রবক্তা হয়ে ওঠেন। তাঁর মতে, একজন ঔপন্যাসিকের প্রধান কাজ হলো মানুষের চিন্তাগুলোর সেই অগোছালো ও জটিল প্রবাহকে তুলে ধরা। উলফ লেখকের স্বাধীনতাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন এবং বলেছেন ,'Any method is right, every method is right, that expresses what we wish to express'- অর্থাৎ লেখক যে পদ্ধতিতেই লিখুক না কেন, যদি তা তার অনুভূতিকে সঠিকভাবে প্রকাশ করে, তবে সেটিই সঠিক পথ।
“মডার্ন ফিকশন” প্রবন্ধে ভার্জিনিয়া উলফ মূলত আধুনিক সাহিত্যকে নতুন দিশা দেখিয়েছেন। তিনি লেখকদের উৎসাহিত করেছেন জীবনের অন্তর্নিহিত সত্য ও মানুষের চেতনার জটিলতা তুলে ধরতে। তিনি মনে করেন, উপন্যাসের জন্য কোনো নির্দিষ্ট কাঠামো বা পদ্ধতি নেই- যে কোনো বিষয়, যে কোনো অনুভূতি, যে কোনো চিন্তা সাহিত্যের উপাদান হতে পারে। তিনি লেখকদের অনুপ্রাণিত করেছেন নিজেদের সত্যকে প্রকাশ করতে এবং প্রচলিত রীতির বাইরে গিয়ে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে সাহিত্য রচনা করতে।
এই প্রবন্ধের মাধ্যমে উলফ শুধুই পূর্ববর্তী লেখকদের সমালোচনা করেন এবং নতুন লেখকদের জন্য একটি স্বাধীন ও সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছেন, যা আজও প্রাসঙ্গিক।

প্যানেল

×