ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঝড়-ঝঞ্ঝার জীবনগাথা

রাকিবুল রকি

প্রকাশিত: ২১:১৩, ১ জুন ২০২৩

ঝড়-ঝঞ্ঝার জীবনগাথা

ঝড়-ঝঞ্ঝা, মারি ও মড়ক নিয়েই এগিয়ে গেছে বাঙালির জীবন

ঝড়-ঝঞ্ঝা, মারি ও মড়ক নিয়েই এগিয়ে গেছে বাঙালির জীবন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অসুস্থতা, মহামারি- এসব বাঙালির জীবনের নৈমিত্তিক ব্যাপার। যেন জীবন-যাপনেরই অংশ। তাই হয়তো বিশ^ সাহিত্যে মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেভাবে প্রধান বিষয় হয়ে এসেছে, বাংলা সাহিত্যে যেন তা শুধু অনুষঙ্গ হয়েই এসেছে। যদিও দুর্যোগ, মহামারি প্রধান বিষয় হিসেবে না এলেও জীবনের বিশ^স্ত চিত্র অঙ্কন করতে গিয়ে লেখকগণ অত্যন্ত নিপুণভাবে, দরদ দিয়ে বিষয়গুলো তুলে এনেছেন তাঁদের সৃজনকর্মে, সাহিত্যে।
ঝড়-বৃষ্টি, কালবৈশাখী, ঘূর্ণিঝড় প্রতিবছরই বাঙালির জীবনে হানা দেয়। কখনো কখনো তারা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়ে যায় জীবনের। সম্পদের। বাংলা সাহিত্যে আমরা তার চিত্র দেখতে পাই।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। ‘দুর্গেশনন্দিনী’। প্রকাশিত হয় ১৮৬৫ সালে। ইতিহাস আশ্রয়ী রোমান্সধর্মী উপন্যাস। পাশ্চাত্যে একটি লেখাকে উপন্যাস হতে হলে যেসব গুণাবলি থাকার প্রয়োজন, বঙ্কিমচন্দ্রের এই লেখায় তার সবগুলোই ছিল বলা চলে।
বাংলা প্রথম সার্থক উপন্যাসের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদেই আমরা বৃষ্টির সাক্ষাৎ পাই। 
বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, ‘অল্পকাল মধ্যে মহারবে নৈদাঘ ঝটিকা প্রধাবিত হইল এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রবল বৃষ্টিধারা পড়িতে লাগিল। ঘোটকারূঢ় ব্যক্তি গন্তব্য পথের আর কিছুমাত্র স্থিরতা পাইলেন না। অশ^-বল্গা শ্লথ করাতে অশ^ যথেচ্ছ গমন করিতে লাগিল। এইরূপ কিয়দ্দুর গমন করিলে ঘোটকচরণে কোন কঠিন দ্রব্যসংঘাতে ঘোটকের পদঙ্খলন হইল। ঐসময়ে একবার বিদ্যুৎ প্রকাশ হওয়াতে পথিক সম্মুখে প্রকা- ধবলাকার কোন পদার্থ চকিতমাত্র দেখিতে পাইলেন।’
‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসে আমরা বৃষ্টির সময় প্রকৃতির যে অবস্থা তার একটি চিত্র দেখতে পাই।
‘অঙ্গে কিসের শীতল স্পর্শ অনুভূত হইল। এক বিন্দু বৃষ্টি। ফোঁটা, ফোঁটা, ফোঁটা! তার পর দিগন্তব্যাপী গর্জ্জন। সে গর্জ্জন, বৃষ্টির, বায়ুর এবং মেঘের; তৎসঙ্গে কোথাও বৃক্ষশাখাভঙ্গের শব্দ, কোথাও ভীত পশুর চীৎকার, কোথাও স্থানচ্যুত উপলখ-ের অবতরণশব্দ। দূরে গঙ্গার ক্ষিপ্ত তরঙ্গমালার কোলাহল। অবনত মস্তকে পার্ব্বতীয় প্রস্তরাসনে, শৈবালিনী বসিয়াÑ মাথার উপর শীতল জলরাশি বর্ষণ হইতেছে। অঙ্গের উপর বৃক্ষ লতা গুল্মাদির শাখা সকল বায়ুতাড়িত হইয়া প্রহত হইতেছে, আবার উঠিতেছে, আবার প্রহত হইতেছে।’
বঙ্কিমীয় ভাষায় হয়তো বর্তমানের নতুন প্রজন্ম এখন আর তেমন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে না। কিন্তু তাঁর তৎসম শব্দের ঝঙ্কার ঝড়ের যে গর্জন, ভারিক্কিচালÑ তা চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নৌকাডুবি’ (১৯০৬) একটি বহুল পঠিত এবং আলোচিত উপন্যাস। যদিও তৎকালীন কতিপয় সমালোচকগণ এর স্থায়িত্ব সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। যাই হোক, সামাজিক ঘরানার এই উপন্যাসে ঝড়ের একটি মূখ্য ভূমিকা রয়েছে। নদীপথে আকস্মিক ঝড়ের ফলে যে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়, তাই দেখিয়েছেন। 
উপন্যাসের নায়ক রমেশ উপন্যাসের প্রারম্ভে অর্থাৎ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বিয়ে করে নৌ-পথে বাড়ি ফিরছিলেন। এমন সময় নদীর বুকে তারা টর্নেডোর কবলে পড়েন।
রবীন্দ্রনাথ অল্প কথায় সেই বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন,
‘এমন সময় আকাশে মেঘ নাই, কিছু নাই, অথচ কোথা হইতে একটা গর্জনধ্বনি শোনা গেল। পশ্চাতে দিগন্তের দিকে চাহিয়া দেখা গেল, একটা প্রকা- অদৃশ্য সম্মার্জনী ভাঙা ডালপালা, খড়কুটা, ধুলাবালি আকাশে উড়াইয়া প্রচ-বেগে ছুটিয়া আসিতেছে। ‘রাখ্ রাখ্, সামাল সামাল, হায় হায়’ করিতে করিতে মুহূর্তকাল পড়ে কী হইল কেহই বলিতে পারিল না। একটা ঘূর্ণা হাওয়া একটি সংকীর্ণ পথমাত্র আশ্রয় করিয়া প্রবলবেগে সমস্ত উন্মূলিত বিপর্যস্ত করিয়া দিয়া নৌকা-কয়টাকে কোথায় কী করিল তাহার কোনো উদ্দেশ পাওয়া গেল না।’
এতটুকুই বর্ণনা। 
তবে পাঠকমাত্রই জানেন, এই টর্নেডো যেমন নৌকাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল, ঠিক কাহিনীর গতিপথও আমূল পরিবর্তন করে দেয়। রমেশ যখন বালির চড়ে জ্ঞান ফিরে পায়, তখন সে ভুলবশত তাদেরই মতো একই অবস্থার শিকার আরেকজন নববধূকে বাড়ি নিয়ে আসে।
নদীপথে টর্নেডোর আকস্মিক আগমন যেমন আমরা রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে দেখতে পাই, ঠিক তেমনি সাগর বুকে সাইক্লোনের আঘাত কতটা ভয়ঙ্করÑ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর শক্তিশালী কলমের মাধ্যমে আমাদের এঁকে দেখিয়েছেন। শরৎচন্দ্রের বিখ্যাত উপন্যাস, অনেকের মতে তাঁর আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘শ্রীকান্ত’। উপন্যাসটি চারখ-ে বা পর্বে প্রকাশিত হয়। চারটি খ- যথাক্রমে ১৯১৭, ১৯১৮, ১৯২৭ এবং ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত হয়। 
উপন্যাসের দ্বিতীয় খ-ে শ্রীকান্ত জাহাজে করে বার্মা যাওয়ার সময় সাগরের বুকে সাইক্লোনের মুখোমুখি হন। সাইক্লোন তো নয় যেন যমদূত স্বয়ং এসে হাজির হয় শ্রীকান্তের সামনে। একটু দীর্ঘ হলেও সেই রোমহর্ষক বর্ণনা তুলে ধরছি।
‘অনেকক্ষণ হইতেই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়িতেছিল। সন্ধ্যার কাছাকাছি বাতাস এবং বৃষ্টির বেগ উভয়ই বাড়িয়া উঠিল’ এমন হইয়া উঠিল যে পালাইয়া বেড়াইবার আর জো রহিল না, যেখানে হোক, সুবিধামত একটু আশ্রয় না লইলেই নয়।...
বৃষ্টি বাতাস, অন্ধকার এবং জাহাজের দোলন সব-কটিই ধীরে ধীরে বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। সমুদ্রতরঙ্গের আকৃতি দেখিয়া মনে হইল, এই বুঝি সেই সাইক্লোন; কিন্তু সে যে সাগরের কাছে গোষ্পদমাত্র, তাহা অস্থিমজ্জায় হৃদয়ঙ্গম করিতে আর একটু অপেক্ষা করিতে হইল।
হঠাৎ বুকের ভিতর পর্যন্ত কাঁপাইয়া দিয়া জাহাজের বাঁশী বাজিয়া উঠিল। উপরের দিকে চাহিয়া মনে হইল মন্ত্রবলে যেন আকাশের চেহারা বদলাইয়া গেছে। সেই গাঢ় মেঘ আর নাইÑ সমস্ত ছিঁড়িয়া-খুঁড়িয়া কি করিয়া সমস্ত আকাশটা যেন হালকা হইয়া কোথাও উধাও হইয়া চলিয়াছে;...
ছেলেবেলায় অন্ধকার রাত্রে ঠাকুরমার বুকের ভিতরে ঢুকিয়া সেই যে গল্প শুনিতাম, কোন্ এক রাজপুত্র একডুবে পুকুরের ভিতর হইতে রূপার কৌটা তুলিয়া সাতশ’ রাক্ষসীর প্রাণÑ সোনার ভোমরা হাতে পিষিয়া মারিয়াছিল এবং সেই সাতশ’ রাক্ষসী মৃত্যুযন্ত্রণায় চীৎকার করিতে করিতে পদভরে সমস্ত পৃথিবী মাড়াইয়া গুঁড়াইয়া ছুটিয়া আসিয়াছিল, এও যেন তেমনি কোথায় কিÑএকটা বিপ্লব বাধিয়াছে; তবে রাক্ষসী সাতশ’ নয়, শতকোটি; উন্মত্ত কোলাহল এদিকেই ছুটিয়া আসিতেছে। আসিয়াও পড়িল। রাক্ষসী নয়Ñ ঝড়। তবে এর চেয়ে বোধ করি তাদের আসাই ঢের ভাল ছিল।’
বর্ণনা এখানেই শেষ নয়, আরও দীর্ঘ। তবে উপরের খ-িত উদ্ধৃতাংশ থেকেই কিছুটা বোঝা যাবে সাইক্লোনের ছোবল কত হিং¯্র। নির্মম। ভয়াবহ।
‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে আমরা যেমন সাইক্লোন আক্রান্ত জাহাজের চিত্র দেখতে পাই, ঠিক একই ভাবে সমুদ্র তীরবর্তী একটি জনপদ সাইক্লোনের কারণে কী ভাবে বিরাণ হয়ে যায়Ñ তার বিশ^স্তভাষ্য দেখি শহীদুল্লা কায়সারের ‘সারেং বৌ’ উপন্যাসে। উপন্যাসের শেষের দিকে এসে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা দীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন ঔপন্যাসিক। 
টানা কয়েকদিন বর্ষণের পর সাগরে বান ডাকে। সবাই বাঁচার জন্য ছুটতে থাকে শেখ বাড়ীর দিকে।
নবিতুন কোথাও না গিয়ে গাছের উপর ওঠে। নবিতুনের স্বামী কদম তাকে নেমে আসতে বলে। কিন্তু নবিতুন নামে না। এক পর্যায়ে কদম এবং তাদের কন্যা আককিও গাছে উঠে আসে। পানির পাহাড় দেখে চমকে উঠে কদম। সে একজন সারেং। সমুদ্রেও কখনো এত বড় ঢেউ পানির পাহাড় সে দেখেনি।
একের পর এক ঢেউ আসতে থাকে। তলিয়ে যেতে থাকে বাড়ির পর বাড়ি। এমন কি এক পর্যায়ে দোতলা বাড়িও ডুবে যায়। ভাসিয়ে নেয় অনেককে। নবিতুন গাছে দাঁড়িয়ে দেখে, আর দীর্ঘশ^াস ফেলে। ঢেউ আসতে আসতে এমন উঁচু ঢেউ আসে যে গাছের উপর দিয়ে চলে যায়। নেতিয়ে পড়ে গাছ। ভেসে যেতে যেতে কদম সারেং খেয়াল করে তার সাথে স্ত্রী নবিতুন, কন্যা আক্কি নেই।
যদিও উপন্যাস শেষ দিকে আরও নাটকীয় দিকে মোড় নেয়। সেটা ভিন্ন কথা। 
বাংলা সাহিত্যে সাইক্লোনের বর্ণনা খুব কম উপন্যাসেই এমন ভাবে ফুটে উঠেছে।
ঝড় যে আমাদের জন্য শুধু আতঙ্কের এবং বিভীষিকার, তা নয়। ঝড়ের সময় আম কুড়ানোর স্মৃতি সারাজীবনই হিরণ¥য় দ্যূতি ছড়িয়ে যায়। বাঙালির শৈশব-কৈশোরের সঙ্গে এই আম কুড়ানোর স্মৃতি এক সময় সেলাই করে দিয়েছিল ভাগ্য বিধাতা। যদি বর্তমানে শহরে বসবাসকারী শিশুকিশোরদের এই আনন্দ একেবারেই অজানা, অচেনা। তবে গ্রাম থেকে ঝড়ের দিনে আম কুড়ানোর রেওয়াজ এখনো হারিয়ে যায়নি। মুছে যায়নি সেই আনন্দ, উচ্ছ্বাস।
কালবৈশাখীর দিনে আম কুড়ানোর ছবি এঁকেছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘পড়ে পাওয়া’ গল্পে। তাঁর জাদুকরী লেখনশৈলীর কিছু বর্ণনা পাঠ করা যাক।
‘কালবৈশাখীর সময়টা। আমাদের ছেলেবেলার কথা।
বিধু, সিধু, নিধু, তিনু, বাদল এবং আরও অনেকে দুপুরের বিকট গরমের পর নদীর ঘাটে নাইতে গিয়েছি। বেলা বেশি নেই। বিধু আমাদের দলের মধ্যে বয়সে বড়। সে হঠাৎ কান খাড়া করে বললে Ñ ঐ শোনÑ
আমরা কান খাড়া করে শুনবার চেষ্টা করলাম। কিছু শুনতে বা বুঝতে না পেরে বললাম Ñ কী রে? বিধু আমাদের কথার উত্তর দিলে না। তখনো কান খাড়া করে রয়েছে।
হঠাৎ আবার সে বলে উঠল Ñ ঐÑ ঐ শোনÑ 
আমরাও এবার শুনতে পেয়েছি Ñ দূর পশ্চিম-আকাশে ক্ষীণ গুড়-গুড় মেঘের আওয়াজ।
নিধু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেÑ ও কিছু নাÑ
বিধু ধমক দিয়ে বলে উঠল Ñ কিছু না মানে? তুই সব বুঝিস কিনা? বৈশাখ মাসে পশ্চিম দিকে ওরকম মেঘ ডাকার মানে তুই কিছু জানিস? ঝড় উঠবে। এখন জলে নামব না। কালবৈশাখী।
আমরা সকলে ততক্ষণে বুঝতে পেরেছি ও কী বলছে। কালবৈশাখীর ঝড় মানেই আম কুড়ানো! বাড়ুয্যেদের মাঠের বাগানে চাঁপাতলীর আম এ অঞ্চলে বিখ্যাত। মিষ্টি কী! এই সময়ে পাকে। ঝড় উঠলে তার তলায় ভিড়ও তেমনি। যে আগে গিয়ে পৌঁছতে পারে তারই জয়।’
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়। বৈশাখ মাসে পশ্চিমাকাশে মেঘ ডাকার শব্দ শুনেই বিধু বুঝে গিয়েছে কালবৈশাখী ঝড় হবে। মানুষ প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতির অংশ। তাই এক সময় প্রকৃতি মানুষের কাছে সহজপাঠ্যই ছিল। তাই বিধু কালবৈশাখীর আগামবার্তা জানতে পেরেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের কোনো খবরের প্রয়োজন হয়নি। দিনদিন মানুষ যত প্রযুক্তি নির্ভর হয়েছে, ততই দূরে সরে গিয়েছি প্রকৃতির কাছ থেকে। প্রকৃতি আজ মানুষের কাছে দুবোর্ধ্য। মানুষ এবং প্রকৃতির অবস্থান পরস্পরের বিপরীত মেরুতে।
অথচ বিধুর মতো একজন কিশোর প্রকৃতিকে সেদিন খুব সহজেই পড়ে ফেলতে পেরেছিল। তারই প্রমাণ আমরা গল্পের মধ্যে পাই।
‘অল্পক্ষণ পরেই প্রমাণ হলো, ও আমাদের চেয়ে কত বিজ্ঞ। ভীষণ ঝড় উঠল, কালো মেঘের রাশি উড়ে আসতে লাগল পশ্চিম থেকে। বড় বড় গাছের মাথা ঝড়ের বেগে লুটিয়ে লুটিয়ে পড়তে লাগল, ধুলোতে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল, একটু পরেই ঠান্ডা হাওয়া বইল, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে পড়তে বড় বড় করে ভীষণ বাদলের বর্ষা নামল।
বড় বড় আমবাগানের তলাগুলি ততক্ষণে ছেলেমেয়েতে পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। আম ঝরছে শিলাবৃষ্টির মতো; প্রত্যেক ছেলের হাতে এক এক বোঝা আম। আমরাও যথেষ্ট আম কুড়ুলাম, আমের ভারে নুয়ে পড়লাম এক একজন। ভিজতে ভিজতে কেউ অন্য তলায় চলে গেল, কেউ বাড়ি চলে গেল আমের বোঝা নামিয়ে রেখে আসতে।’
মুহাম্মদ জাফর ইকবালের ‘সাইক্লোন’ (২০১৮) একটি কিশোর উপন্যাস। এখানে তিনি দক্ষ হাতে সাইক্লোনের ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন। 
ঝড় যে শুধু ধ্বংসই নিয়ে আসে, তা নয়। ঝড় কখনো কখনো নতুনের বার্তাবাহক। এজন্যই কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতায় ঝড়কে, ঝড়ের শক্তিকে অভিনন্দিত করেছেন। ‘অগ্নিবীণা’ (১৯২২) কাব্যের প্রথম কবিতা ‘প্রলয়োল্লাস’-এ তিনি কালবৈশাখী ঝড়কে নতুনের বার্তাবাহক বলেছেন। বলেছেন, ‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখী ঝড়’। এজন্য সবাইকে জয়ধ্বনি করার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা বিদ্রোহী’তে তিনি নিজেকে সাইক্লোনের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, ‘আমি সাইক্লোন।’
লেখাটি শেষ করার আগে একটি কবিতার কথা এখানে বলতে চাই। কবিতাটি লিখেছেন নির্মলেন্দু গুণ। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হানা দেয়। ১২ থেকে ২২ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস হয়। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ২২৫ কিলোমিটার। অনেক মানুষ প্রাণ হারায়। সেই হতভাগ্য মানুষদের মধ্যে একজন গর্ভবতী মহিলাও ছিল। মহিলার লাশ যখন পাওয়া যায়, তখন সে নগ্ন অবস্থায় পড়ে আছে। কিন্তু তার প্রসবকৃত মৃত সন্তান, নাড়ি না কাটার ফলে মায়ের সঙ্গেই জড়িয়ে ছিল, ঢেকে রেখেছিল মায়ের লজ্জাস্থান।
নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন,

‘অথচ কেমন আজ ভিনদেশী মানুষের চোখের সমুখে
নগ্ন সে, নির্লজ্জ, নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছে
জলাধারে পশু আর পুরুষের পাশে শুয়ে আছে।
তার ছড়ানো মাংসল বাহু নগ্ন,
কোমর, পায়ের পাতা, বুকের উত্থানগুলো নগ্ন,
গ্রীবার লাজুক ভাঁজ নগ্ন; Ñ কে যেন উন্মাদ হয়ে
তার সে নিঃশব্দ নগ্নতায় বসে আছে।
তার সমস্ত শরীর জুড়ে প্রকৃতির নগ্ন পরিহাস,
শুধু গোপন অঙ্গের লজ্জা ঢেকে আছে
সদ্য-প্রসূত-মৃত সন্তানের লাশ।’
(লজ্জা)।

×