
আইয়ুব আল আমিন
(পূর্ব প্রকাশের পর)
মঙ্গলবার ১১
আমি তাকে স্বপ্নে দেখলাম, তিনি তার ডায়াপারটি ভিজিয়ে ফেলেছেন। আমার বাস্তবজীবনে এই প্রথমবার আমি এইরকমের একটি স্বপ্ন দেখলাম এবং প্রচ- একটি ধাক্কা খেলাম। যতবারই আমি তাকে দেখতে যাই, তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লোমে ভর্তি মুখটা কামিয়ে দিতে হয়। একবার কমিউনিস্ট পার্টির উৎসবে আমি নীলাভ চামড়ার এক ট্রান্সসেক্স্যসুয়ালের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। সেখানেও আমি অবচেতনভাবে আমার মায়ের কথাই ভাবছিলাম।
আজ তিনি আমার কোনো কথাই বুঝতে পারছেন না। যখনই আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার কি পর্যাপ্ত ঘুম হয়েছে?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, এটাতো আমি ভালো করে ধুয়ে রেখেছি”। তিনি সেদিন যা যা করেছেন তার বিশদ বিবরণ দিলেন। বললেন, আমি শহরে গিয়েছিলাম কিছু কেনাকাটা করতে। রাস্তায় এত ভিড়! এমন করে আরো অনেক কিছুর বিবরণ দিচ্ছিলেন। এইরকম অনেক কিছুর গল্প তিনি আমাকে শোনাতে লাগলেন, যেন একজন স্বাভাবিক মানুষ, তার কি চমৎকার প্রাণবন্ত কল্পনা! এইসব কিছু এখনো মাতিয়ে রেখেছে তাকে। বিদায় নেওয়ার আগে আমি এই কল্পনাটুকু ঠিকমতো অনুধাবন করার আগেই তিনি বলে উঠলেন, “আমি এই বিরক্তিকর জায়গাটা ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে আমাকে আরো বহু বহুদিন এখানে থাকতে হবে”।
সোমবার ১৭
তার মুখের লোমগুলো তুলে দিলাম। খুব ঠা-া দৃষ্টিতে ভাবলেশহীন অভিব্যক্তিতে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি খুঁজতে লাগলাম- আমার শৈশবের দেখা তার সেই চোখ দুটো কোথায়? ত্রিশবছর আগের তার সেই ভয়ংকর চোখ দুটো, যে দৃষ্টিগুলো আমাকে সবসময় তাড়া করে ফিরত। আমাকে এমন কঠিন করে গড়ে তুলেছে।
আজ ঠিক যখন আমি ডাইনিংরুমে ঢুকেছিলাম, তখন তিনি তার জ্বরজ্বর গরম হাতের তালু দিয়ে টেবিলের উপরটা মুছে দিচ্ছেন দেখলাম। তার ফুলতোলা গাউনটিতে তাকে দেখতে লাগছিল লুসির মতো। লুসি, সেই মহিলা যে লিলিবোনে আমাদের বাড়িতে ধোয়ামোছার কাজ করত। লিলির মুখে কোনো দাঁত ছিল না, আমার মা-ও তার সমস্ত দাঁত হারিয়ে ফেলেছেন, তার দাঁতহীন মাড়িটিও যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে।
এই সপ্তাহে মেইলবক্সে আমার মায়ের কাছে একটি চিঠি এলো। ‘ফ্রান্সের লাখপতি বিজয়ী’- লেখা ছিল যখন ভাগ্য আপনার পথে সে দাঁড়ায়’। আনমেরি পেইসন নামের প্রাণবন্ত হাসিমুখের একজনের একটি ফটোগ্রাফের পাশে আমি দেখতে পেলাম, লেখা আছে- “ম্যাদাম ব্লঞ্চ দুসেইন কি সেই ভাগ্যবান ব্যক্তি যার হাতে আনমেরি পেইসন দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার ফ্রা’র চেক হস্তান্তর করবেন?” । এরপর দেখলাম পৃষ্ঠার নিচের দিকে আমার মায়ের মুখের ছবি দিয়ে একটি প্রতিকৃতি তৈরি করা, সেখানে কিছু শব্দ লেখা ছিল যা একটু দূর থেকে দেখলে বেশ প্রাণবন্ত হয়ে ফুটে ওঠে। সেখানে আমার মায়ের নাম কয়েক ডজনবার উল্লেখ করা হয়েছে তাকে বোঝানোর জন্য যে, তাকে নির্বাচিত করা হয়েছে। আর তিনি যদি ৫ অক্টোবরের আগে সাড়া দেন তাহলে তিনিই বিজয়ী হবেন। বদমাশের দল। কারো উচিত এই আনমেরি পেইসনকে তার ঘাড়টা ধরে টেনে টেনে পন্তোয়্যাজ হাসপাতালের জেরিয়াট্রিক উইনিটে নিয়ে আসা।
রবিবার ২৩
কিছুদিন আগে, ট্রেনে ফিরতি পথে আমি একজন নানকে দেখলাম তিনি খুব উৎসুক দৃষ্টিতে কৌতূহলী হয়ে অন্য যাত্রীদের লক্ষ্য করছিলেন। তার চোখে ছিল এক ধরনের তদন্তসুলভ চাহনি। আমি সেসময় বিহ্ববল হয়ে আমার মায়ের কথা ভাবছিলাম। সেদিন এক নার্স আমাকে বলেছিল, আমার মা সবসময় আমার সম্পর্কে আর শুধু আমাকে নিয়েই সারাক্ষণ কথা বলেন। অসহ্য অপরাধবোধটা এখন আবার ফিরে এলো আমার ভেতরে। এটা আমিও লক্ষ্য করেছি, তিনি প্রায়ই ভাবেন যেন তিনি আসলে আমিই।
আমার জন্ম হয়েছে কারণ, আমার বড় বোনটা মারা গিয়েছিল, আমি ওর পরিবর্তে এই পৃথিবীতে এসেছি, তাই সেভাবে দেখলে আমার আসলে নিজস্বতা বলে কিছু নেই।
শনিবার ২৯
যখন আমি ডাইনিংরুমে গেলাম, দেখলাম তারা সবাই বসে টিভি দেখছে। শুধু তিনিই বারবার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছেন। তিনি সারাদিন ধরে আমার জন্য অপেক্ষা করেছেন। কিন্তু এটিই সব নয় বরং এরচেয়েও খারাপ একটি ঘটনা ঘটতে চলেছে যা আমি একটু আগেও কল্পনা করতে পারিনি। রুমে প্রবেশ করে আমি যখন তার বিছানার পাশের দেরাজটা খুলে খুঁজে দেখছিলাম সেখানে কিছু বিস্কুট অবশিষ্ট আছে কিনা? আরো এনে রাখা লাগবে কিনা? কিন্তু এরপর বিস্কুট ভেবে আমি যেটাকে দেখলাম আর হাতে তুলে নিলাম, সেটা আসলে ছিল কোনো মানুষের মল, শুকনো মল; এরপর সম্পূর্ণ হতবুদ্ধি হয়ে আমি দেরাজটি বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু আমার মনে হলো আমি যদি এটাকে এভাবে রেখে যাই, তাহলে নার্সদের কেউ না কেউ এটিকে খুঁজে পাবে। আর অবচেতন মনে আমি হয়ত এটাই চেয়েছিলাম, যাতে তারা দেখতে পায় আমার মা কতটা নিচে নেমে গেছে। কিন্তু আমি একটি কাগজের টুকরো খুঁজে এনে ওটাকে তুলে টয়লেটে নিয়ে ফ্লাশ করে দিলাম। হঠাৎ করে আমার শৈশবের একটি স্মৃতিদৃশ্য মনে পড়ল- একবার ওপরতলায় আমার শোবার ঘরের আলমারিতে কিছু মলমূত্র লুকিয়ে রেখেছিলাম আমি। কারণ, ওখান থেকে নিচে নেমে বাড়ির বাইরের পায়খানা ব্যবহার করতে আমার ভীষণ আলসেমি লাগত।
আজ তিনি যেসব কথা বলছেন তার কোনো মানে হয় না। সবই অর্থহীন। তিনি বলছেন, ‘এখানে তারা সবগুলো নামের ‘এ’ আর ‘ও’ গুলোকে পরিবর্তন করেছে’। তিনি আরো বললেন, ‘মারি লুইস আমাকে প্রায়ই দেখতে আসে’। মারি লুইস তার বোন, যিনি বিশ বছর আগে মারা গেছেন।
আক্টোবর, রবিবার ৭
এখন আমি রবিবারগুলোতে তাকে দেখতে আসি। টিভিতে জ্যাক মার্টিন শো ‘ ল্যকুল দ্য ফ্রান্স’ অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হচ্ছে যেখানে শিশুরা গান গাইছে আর এখানে টিভির সামনে বসে বৃদ্ধরা অপলক তাকিয়ে আছে। যখন আমি আর মা রুমে ঢুকলাম, তখন বিষ্ঠার প্রচ- দুর্গন্ধে আমার নাকের ছিদ্র দুটো যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। আমরা দুজন দুজনের মুখোমুখি বসলাম। যথারীতি আমার মায়ের অন্য রুমমেট বৃদ্ধা মহিলাটা তার বিছানায় বসে হাঁপাচ্ছিলেন। তিনি বললেন- “প্লিজ আমাকে কিছু কেক খেতে দাও”। আমি লক্ষ্য করেছি কেউ কখনো তাকে দেখতে আসে না। আমি যখন তার বিছানার দিকে এগিয়ে গেলাম- তার আর্মচেয়ারের কাছে বিষ্ঠার বিশাল স্তুপ লক্ষ্য করলাম। এরপর কর্তব্যরত নার্সকে ডেকে এনে দেখালে সে আমাকে আশ্বস্ত করল যে বৃদ্ধা মহিলা যিনি বিছানায় বসে আছেন (তিনি ডায়াপার পরে আছেন) অথবা আমার মা, কেউ-ই এই কাজটি করতে পারবেন না। এটা স্পষ্টই একজন ভবঘুরে বয়স্ক লোক হাসপাতালের চারপাশে ঘুরঘুর করছেন, তিনি কোনো না কোনো ভাবে রুমে ঢুকে মেঝেতে ঘুমিয়ে সেখানে মল ত্যাগ করেছেন।
বিদায় জানিয়ে এবারও আমি খুব দ্রুত হেঁটে লিফটে পৌঁছানোর চেষ্টা করি তিনি আমাকে ধরবার আগেই এবং তার মুখের উপর দরজা বন্ধ করার আগেই আমি লিফটের দরজা দুটো টেনে দিতে চাই। আমার মায়ের বর্তমান অবস্থা দেখা আমার জন্য সত্যিই কষ্টকর। তবু তিনি এখনো আমার ভেতরে প্রচ- রাগ জাগিয়ে তুলতে পারেন। আজ সকালেই বাড়ির পাশের এক বেকারিতে একজন মহিলা তার ছোট মেয়েটাকে প্রচ- জোরে একটি চড় মেরেছিল। শিশুটি কষ্ট পেলেও লজ্জায় কেঁদে ওঠেনি। ওর মায়ের মুখটা খুব রূঢ় ছিল, ক্রোধে যেন ফেটে পড়ছিলেন। দৃশ্যটি আমাকে বিচলিত করেছিল, এটি আমাকে আমার নিজের মায়ের কথা মনে করিয়ে দেয়- যিনি আমাকে সামান্য থেকে সামান্যতম জিনিসের জন্য চড় মারতেন।
শুক্রবার ১২
আমি মনে করার চেষ্টা করি সেই সময়টা যখন আমার মা আমার সঙ্গে থাকতেন, সেটা সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি দিনে তখন তার প্রতি আমি (সচেতনভাবেই কি?) নিষ্ঠুর ছিলাম, আমার মনে হচ্ছিল তিনি স্মৃতিশক্তি হারিয়ে অদ্ভুত রকমের নারীতে রূপান্তরিত হচ্ছিলেন, একজন ভীতু মহিলা যে আমাকে শিশুর মতন আঁকড়ে ধরে আছেন। যাই হোক, এটি আজকের মতন এতটা খারাপ ছিল না। অন্তত তার মধ্যে কিছু আকাক্সক্ষা আর উন্মাদনা তো ছিল সে সব দিনগুলোতে।
আজকে তাকে দেখে যাওয়ার মধ্য দিয়ে এই প্রথমবারের মতো আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, এখানে আসলে তার জীবনটা কেমন কাটছে আমার সাক্ষাতের বিরতির দিনগুলোর ভেতর দিয়ে, ডাইনিংরুমে তিনবেলা খাবার আর খাবারের মাঝে শুরুর অপেক্ষায়। ভবিষ্যতের জন্য আমি শুধু অনুশোচনাই জমিয়ে যাচ্ছি বস্তার পর বস্তা ভরে। কিন্তু উনাকে আমার কাছে এনে রাখা মানে আমার নিজের জীবনটাই শেষ হয়ে যাওয়া এটা তার বা আমার- আমি ঠিক জানি না। আমি শুধু মনে করতে পারি শেষ বাক্যটা যেটা তিনি লিখেছিলেন- ‘আমি অন্ধকারেই থাকি’।
তবে তার রেখে যাওয়া পোশাকগুলো বিশেষ করে স্লিপিং গাউনটি একবার গায়ে দেওয়ার কথা ভাবতে পারি না। আমি এগুলোকে জাদুঘরে প্রদর্শনীর মতো বস্তু করেই রেখে দিতে চাই।
আমি ক্রমাগত আমার মায়ের শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে এখানকার অন্য বৃদ্ধা রোগীদের শরীরের অবস্থার সঙ্গে মনে মনে তুলনা করেই যাচ্ছি, তাদের প্রত্যেকের গায়ের রং, তাদের কুচকানো শুকনো পায়ের অবস্থাগুলোর মতো- এসব দেখছি যেন তারা সবাই কতটা আর দ্রুত বা ধীরে ধীরে বার্ধক্যে আক্রান্ত হচ্ছেন।
(চলবে...)