নাম মানেই তো ডাকনাম। একে আবার পোশাক পরাবার প্রয়োজনটা কি? এই যেমন লালটু। একে মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন বললে কে চিনবে?
অথচ লালটুকে নব্বইর বিশ্ববিদ্যালয়-ক্যাম্পাসে কে না চিনত। তুখোড় আড্ডাবাজ আর মেজাজী এক যুবক। প্রতিদিন বানিয়ে বানিয়ে এক-একটি লোমহর্ষক গল্প বলার জুড়ি নেই যার - সেই লালটু। একবারটি যে ওর এসব গল্প শুনেছে, সে-ই বন্ধু হয়ে গেছে। এক আড্ডায় বন্ধুত্ব জমানোর এমন প্রতিভা সম্ভবত ওর মতো আর কারও ছিল না।
সকালবেলার প্রথম ক্লাসটা কোনোরকমে সেরে সে সোজা চলে আসত বটতলায়। চোখের সামনে ওকে পেলেই বন্ধুরা বুঝত- ঢিমে জীবনে এবার গল্পের উষ্ণতা ফিরে আসবে- চাঙ্গা হবে শরীর-মন সব।
‘কী দোস্ত খবর কি? কাইল রাইতে হলের ডাইনিং-এ দেখলাম না।’ কোন এক বন্ধুর জিজ্ঞাসা।
‘আর কইয়ো না। কাইল মরণের মুখ থেইক্যা ফিইর্যা আইছি। চার অর্ডার দাও ফ্রেন্ড।’ গল্প শুনতে মরিয়া বন্ধুটি চায়ের কথা বলল এক পিচ্চিকে।
শুধু চায়ে লালটুর হয় না। সঙ্গে লাগবে চপ-সিঙ্গাড়া। খাওয়ার পর সে সিগারেট হাতে নেবে। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হয়তো একসময় মুখ খুলবে।
‘কাইল যে অবস্থায় পড়ছিলাম। মাথার ওপর মাবুদ না থাকলে হলেই ফিরতে পারতাম না।’ সিগারেটের ঘন ধোঁয়া তখন বাতাসে সমúাদ্য-উপপাদ্য আঁকছে।
সবাই উদ্বিগ্ন। দৃষ্টিতে অপার কৌতূহল।
কেউ একজন বলে উঠল, ‘গুলাগুলি শুরু অয়া গেল?’
‘আরে না।’
‘তাইলে বাস ফুটপাথে তর উপরে?’
‘ধ্যাৎ। ’
‘বাজ পড়ল?’
‘কাইল আবার বাজ পড়ল কুন সময়?’
‘পুলিশ ভুলে তরে রমনা থানায় উঠায়া নিল?’
‘আরে না ব্যাটা। আগেভাগে অত আজব জিনিস বুইজা বইয়া থাহস ক্যা?’
‘তাইলে কি অইছে?’ তর আর সইছে না ওদের।
‘আরে ব্যাটা সইনধার সময় না? শাহবাগের গলিতে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ছিলাম। ’
‘কস কি ? কয়জন ?’
‘মোট তিন জন ?’
‘হেরপর ?’ সবার দৃষ্টিতে বিস্ময়।
‘মাইরাই দিছিল।’
‘কি দোস্তো?’
‘ড্যাগার। সঙ্গে যা আছে সব চায়। আমারে ত জানছ? ভয় পাওনের পোলা আমি?’
‘মোটেই না।’ সায় দেয় সবাই।
‘যার হাতে ড্যাগার ওই হালারে তো চিনি নাই। কিন্তুক পিছনেরটারে চিইন্যা ফেলাইলাম। মগবাজারের লুলা জসিম। চোখে চোখ পইর্যা যাইতেই কইয়া ফেল্লাম, কিরে জসিম্যা, অহন কি তগোরেও সালাম দেওন লাগব? সঙ্গে সঙ্গে মামু কইয়া হাত ধইরা ফেলাইল। হা হাহা। ’
এভাবেই লালটুর আসর জমে ওঠে। অথচ ওর উঠে যাওয়ার পরপর এক ঠোঁটকাটা বন্ধু বলেই ফেলল, ‘শালা একটা গাঞ্জাখোর। ক্যাম্পাস থেইক্যা ফিইরা খাইয়া-লইয়া সইন্ধা অব্দি ঘুমাইয়া কাটাইল। আর অহন কয় ছিনতাইকারীর কবলে পড়ছিল। গুলবাজ কুনহানের।’
তবু ওর আসরেই বন্ধুদের উপস্থিতি বেশি। সবাই কেন যেন ওকেই ভালোবাসে।
অথচ সেই লালটুর প্রেম-পরিণয়-বিয়ে কোনোটাই ক্যাম্পাসে হয়নি। দেখতে হ্যান্ডসাম; পড়াশুনোয় মেধাবী। তবু।
২
লালটুর প্রেম হয়নি ক্যাম্পাসে, তা মোটেও সত্যি নয়।
ঠিকই সে প্রেমে পড়েছিল। এ্যানি নামের সেই মেয়েটিও দুর্বল হয়ে পড়েছিল ওর প্রতি। কিন্তু প্রেম টিকিয়ে রাখতে যেসব আজগুবি নট-ঘট প্রয়োজন, তা লালটুর ছিল না।
এ্যানি লালটুর বিভাগেই পড়ে , ওর চেয়ে বছর দুয়েকের ছোটো। গৌরিপুরের কোনো এক অজ পাড়াগাঁর মেয়ে; তা সত্ত্বেও ন্যাকা কথাবার্তা আর চোখ-মুখের ছলাকলায় মদালস করে ছাড়ত রূপতৃষ্ণায় কাতর সব ক্যাম্পাস-যুবকদের। লালটু তাদেরই একজন।
অপরদিকে লালটু ওর গুলবাজ চরিত্রটি মেলে ধরতে গিয়ে বারবার ধরা খাচ্ছিল এ্যানির কাছে। একসঙ্গে বিকালে বের হলেই সে ভাব দিয়ে ওকে নিয়ে চলে আসত সোনারগাঁও হোটেল-লবিতে। সেখানে কিছুক্ষণ বসে ফেরার সময় বলে উঠত, ‘এ্যাই, তোমার কাছে কিছু টাকা অইব?’
‘ক্যান?’
‘হাসানরে তো চিন? আমার রুমমেট। হে কারে য্যান গিফট দিব কইয়া কিছু টাকা ধার নিয়া গেল। আমি তো না কইতে পারি না।’ প্রথম-প্রথম লজ্জার মাথা খেয়ে টাকার যোগান দিলেও চতুর এ্যানি খুব দ্রুত বুঝে ফেলে লালটু আসলে টাউট কিসিমের পুরুষ। ওর অবিরাম বায়না মিটাবার মতো বশংবদ পয়সাওলা পুরুষ সে নয়। তখন ওর কাছ থেকে ছাড়া পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে সে। কিন্তু বেঁকে বসা লালটু তখন কিছুতেই নিজের প্রেমের অধিকার ছাড়তে চাইছে না।
‘আমারে চেন তুমি?’
‘চিনি। গাজিপুরের গরিব কিষাণ ধন মিঞার পোলা মোহাম্মদ সোলায়মান হোসেন। ক্যাম্পাসে সবাই যারে গুলবাজ লালটু নামে চেনে। তোমার লগে আমার কোন সম্পর্ক নাই। ভুল হয়ে গেছে। মাফ চাই।’
‘মাফ চাইলে তো অইব না। আমার জীবন তামা-তামা বানাইয়া অহন মাফ চাইলে অইব?’
‘কি করবা?’
‘তুইলা লইয়া যামু।’
একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে এ্যানি চলে গেল ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানের কক্ষে। কেঁদে-কেঁেদ আকুল হয়ে জানাল লালটু নামের এক বদমাশ যুবক ওকে ক্যাম্পাসে কিভাবে প্রতিদিন গায়ে পড়ে কেবল গুম-খুনের হুমকি দিচ্ছে।
চেয়ারম্যান মহোদয় এ্যানির কান্নায় গলে গিয়ে টিস্যুর বাক্স ছিঁড়ে টিস্যু-পেপার এগিয়ে দিলেন ওর দিকে। তারপর গর্জে উঠলেন সিংহের মতো। লালটুর তখন দম যায়-যায় অবস্থা। ছাত্রত্ব বাতিলের নিষ্ঠুর হুমকি স্যরের কণ্ঠে। অগত্যা এ্যানির কাছে ক্ষমা চেয়ে আর স্যরের হাতে-পায়ে ধরে কোনোরকমে নিজের মাথাটি বাঁচিয়ে চলে এলো। কিন্তু বাইরে এসে গল্প দিল ভিন্ন। নিজের আধিপত্য বজায় রেখে সে বলে উঠল, ‘স্যর অনুরোধ না করলে এ্যানিরে দেহাইয়া দিতাম ঘুঘুর ফাঁদ ক্যামন অয়?
‘অহন কি করবা দোস্ত?’
‘মাফ কইরা দিলাম।’
‘কারে? এ্যানিরে? ভুইলা যাইবা?’
উত্তরে লালটু চুপ করে থাকে। ওর ধারণা ছিল, নর-নারীর একত্রে চলাফেরার অন্য নাম বোধহয় প্রেম। সেটি নির্মমভাবে ভেঙে যাওয়ায় সে এ ব্যাপারে একেবারে নীরব হয়ে পড়ে।
এরপর যে কদিন সে ক্যাম্পাসে ছিল, কখনও ওকে আর মেয়েদের পিছু ঘুরতে দেখা যায়নি।
তখনও বন্ধুদের মাঝে ওর উদ্দীপনাময় উষ্ণ গল্পগুলোর একইরকম কদর। কিন্তু লালটুর নিজের কাছে মনে হচ্ছিল ওর বানানো জগতে ভালোবাসার মায়াবী স্বাদ নেই। তরকারিতে হলুদ-মরিচ সব ঠিকঠিক হবার পরও যেন জিহ্বা ফিরিয়ে দিচ্ছে সব।
বুকের গহিনে কবরের মতো সেই স্থানটা নির্জন পড়ে থাকে। বুঝতে পারলেও লালটুর কিছু করার নেই, কেবল দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখা ছাড়া।
৩
না, একথাও ঠিক নয়। নায়িকার সন্ধান লালটু ঠিকই পেয়েছিল।
তবে ক্যাম্পাসে নয়, জীবনের প্রথম চাকরিটি করতে গিয়ে।
এমএ করার পর ঢাকার খুব কাছেই একটা কলেজের প্রভাষক হয়ে চলে এলো সে।
তখনও গল্প বলা ওর থামেনি। বরং নিজেকে আকর্ষণীয় করে প্রকাশ করতে যেখানে যতটুকু সুযোগ মিলছে সেখানেই সেগুলো বলে চারপাশে দূর আকাশের মতো এক রহস্যময় বলয় তৈরি করে নিচ্ছে সে। লালটুর ধারণা Ñওকে যত দূরবর্তী লাগবে সবার কাছে তত দিন-দিন জনপ্রিয় হবে সে।
ঠিক এসময়টায় আগমন ঘটে লিজার। ওর ছাত্রী। বলল, ‘আমি কিছু বুঝি না। বাসায় যেতে হবে।’
কাছেই ওদের বাড়ি। বাবা মাঝারি গোছের ব্যবসায়ী। স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গেও লতায়-পাতায় বেশ খানিকটা জড়ানো। তাই গ্রাম্য বোধবুদ্ধির জোরে এলাকায় বেশ প্রভাবশালী। দেখা হলেই বাধাধরা এক বক্তৃতা, ‘মাস্টারসাব, বাঙালীর কেরেকটারে ক্যারিকেচার ঢুইকা গেছে। সব হাইব্রিড। জেনুইন কিছু নাই। বুঝলেন?’ কথা শুনে লালটু বিস্মিত; ইন্টারমিডিয়েট পাস এই গ্রাম্য ব্যবসায়ীর কেন বাঙালর চরিত্র নিয়ে এত উদ্বেগ তা সে বুঝতে পারে না। কিছুটা অদ্ভুত ও হাস্যকর লাগে নিজের কাছে।
একদিন টিপটিপ বৃষ্টি ঝরছে। ওর বিসিএসের ভাইভার রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে। আনন্দে আত্মহারা সে। কী করবে বুঝতে পারে না।
লিজার কথা মনে হলো। কালো মেয়েরা কেন যে ওকে এত টানেÑ তা নিজের কাছেও রীতিমতো রহস্যাবৃত। একশ’ আটটা চুমু খেলেও কোনো রা নেই মেয়েটার মুখে। ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া যেন আর কোনো কাজ নেই এই অবোধ মেয়েটার। দু-চারটা পড়াপাঠ, দুচারটা চুমু আর সবশেষে জম্পেশ নাশতাÑ ভালোই চলত।
কিন্তু লালটু জানে, কালো মেয়েরা ওকে যতই আকর্ষণ করুক, সে শেষ পর্যন্ত একটা ফর্সা মেয়েকেই বিয়ে করবে। ফর্সা মেয়ে পাশে থাকলে আত্মবিশ্বাস ও স্ট্যাটাস দুটোই দ্রুত বেড়ে যায় বাঙালী পুরুষের। গাজীপুরে ওর দূর-সম্পর্কের কাকার ফর্সা বউকে দেখে সে জেনেছেÑ পাড়া-সমাজে ওরা কত গুরুত্বপূর্ণ।
লালটু ছুটে গেল লিজাদের বাড়ি। আনন্দে আটখানা হয়ে জানাল ওর কৃতিত্বের কথা।
সব শুনে লিজার বাবা গুরগম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল, ‘তাইলে চরিত্রের মান রাখেন প্রফেসার সাব। ’
‘মানে?’
‘কাজিসাব রেডি আছে। বিয়াডা সাইরা ফ্যালান।’ ভাবলেশহীনভাবে বলে উঠলেন লিজার বাবা।
বাঙালির চরিত্র নিয়ে লোকটার এত আহাজারির মূল অর্থটা তখন অনুধাবন করতে পারল লালটু।
তখন ফেরার আর সময় নেই। অগত্যা পাড়া-পড়শি আর কলেজের সহকর্মীদের সামনে অনিচ্ছাসত্ত্বেও কালো মেয়েটাকেই বিয়ে করতে হলো ওকে।
পরাজয়ের সেই কষ্ট এখনও লালটুকে কুড়ে কুড়ে খায়। অপরদিকে দুই সন্তানের জননী ও উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তার স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও লিজা নিজেকে একাই ভাবে। লালটু কোনোদিন মন থেকে মেনে নেয়নি ওকে। সবই ঠিকঠিক চলছে। কিন্তু ‘আমি আমার, তুমি তোমার’ মতো প্রাণহীন কাগজি ফুল সব।
লিজা স্বামীর বন্ধুদের চেনে না। সহকর্মীদেরও জানে না। এমন কি, আজকাল দুই ছেলেও ওকে অবহেলা করে কথা বলে। চুয়াল্লিশ বছর বয়সের একাকী লিজা এখন ভাবে, ধরেবেধে জোর করে লালটুকে বিয়ে না করলে কী এমন ক্ষতিবৃদ্ধি হতো ওর জীবনে!