ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

নারীর প্রতি সহিংসতা 

প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির বদল 

জলি রহমান

প্রকাশিত: ১৭:০৮, ৯ ডিসেম্বর ২০২৩

প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির বদল 

প্রতীকী ছবি

আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ শুরু হয়েছে ২৫ নভেম্বর। বিশ্ব মানবাধিকার দিবস (১০ ডিসেম্বর) পালনের মধ্য দিয়ে এই পক্ষ শেষ হবে। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা বন্ধে এগিয়ে আসুন, সহিংসতা প্রতিরোধে বিনিয়োগ করুন’। প্রতিরোধ পক্ষের উদ্বোধনী দিনে বক্তারা বলেছেন, এক নারীর নির্যাতনে অন্যদের এগিয়ে আসা উচিত। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে- অন্যরা এগিয়ে এলে ঠিক কতটা সমাধান পাওয়া সম্ভব? একজন নারীই যদি স্বেচ্ছায় পরাধীনতা মেনে নিতে চায়! 

নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা বলি। আমার বাসার নিচতলা থেকে প্রায়ই উচ্চৈঃস্বরে আলাপের শব্দ আসত। তখন ভেবে নিয়েছিলাম হতেই পারে কোনো বাসায় কথার কাটাকাটি। কিন্তু একদিন ভোরবেলা এক নারীর কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙল। তখন ভোরের আলো ভালোভাবে প্রস্ফুটিত হয়নি। তবুও নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি, ছুটে গেলাম কাউকে না বলে। দেখলাম যে নারী কাঁদছেন, তাকে আমি খুব ভালোভাবে চিনি। অনেকবার কথা হয়েছে। আবেগতাড়িত হয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। দরজার সামনে ফ্লোরে বসে কাঁদছেন। তার স্বামী হাত ধরে টেনে-হিঁচড়ে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছেন, যেন দরজাটা আটকানো যায়। পাশেই পাঁচ বছরের মেয়েটা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছিল। মেয়েটার চোখে ছিল এক অজানা ভয়। তখন ওই নারীকে বললাম, আপনি ট্রিপল নাইনে ফোন দিন। এ লোকের শাস্তি পাওয়া উচিত। সে তেমন ভ্রƒক্ষেপ করল না। বাবার বাসায় চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অনেকভাবে সান্ত¡না দিলাম। যেহেতু তাদের পরিবার বেশ সচ্ছল। ভেবেছিলাম হয়তো এটাই তার শেষ যাওয়া। কিন্তু আমার ধারণা সম্পূর্ণ মিথ্যা হয়ে গেল। এক সপ্তাহ পার না হতেই আবার একই নারীর কণ্ঠস্বর। আমি বেশ চমকে নিচে নামলাম। আমাকে দেখেই সে দরজা লাগিয়ে দিল। আগে সব সময় কুশল বিনিময় হতো। কিন্তু এ ঘটনার পর নারীটি লজ্জা ও সংকোচের কারণে আমাকে এড়িয়ে যাওয়াতেই স্বস্তিবোধ করেছে। 

ঘটনাটি থেকে একটি ভয়ানক বার্তা পেয়েছি। অবশ্যই কোনো কিছুর সুষ্ঠু মীমাংসা ভালো। তবে প্রতিনিয়ত আত্মসম্মান ভূলুণ্ঠিত করে বেঁচে থাকাকে কারাগার মনে হয়। নারীদের দৃষ্টিভঙ্গি আটকে আছে তথাকথিত শৃঙ্খলে। জন্ম থেকেই মেয়েদের শেখানো হয় তোমার ঘর অন্য জায়গায় হবে। তোমাকে আমরা পড়ালেখা করিয়ে বিয়ে দেব। এটাই আমাদের দায়িত্ব। সেই মেয়ে কিভাবে শিখবে নিজের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করা। সম্ভব নয়। তাই পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। 

কয়েক বছর আগের কথা, পরিচিত একটি মেয়ে ¯œাতক সম্পন্ন করে সিদ্ধান্ত নিল বিদেশে ¯œাতকোত্তর করবে। কিন্তু বাবার ঘোর আপত্তি বিদেশে যাওয়া যাবে না। বিয়ের পর স্বামী যদি পাঠাতে চায়, তবে যেতে পারবে। শুনেছি, এখন সে ঘর-সংসার নিয়ে শুধু বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছে। মেয়েদের শোনানো হয়, তুমি ঘরের লক্ষ্মী, তুমি পড়ালেখার পাশাপাশি ঘর সাজিয়ে রাখবে। আবার বিয়ের পর স্বামীর ঘরও। আর ছেলে আরাম করে খাওয়া-দাওয়া এবং পড়ালেখা করবে। এক সময় অফিসের কাজ আর বিশ্রাম তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়। আচ্ছা, ছেলেরা কেন ঘরের লক্ষ্মী হবে না? লক্ষ্মীর বিশেষণ- শান্তস্বভাব, সুবোধ। ছেলেদেরও ছোটবেলা থেকে শেখানো উচিত তুমি ঘরের লক্ষ্মী। ছেলেরা যখন মাকে সাহায্য করে তখন হয় ভালো ছেলে। আর যখন স্ত্রীকে সাহায্য করে তখন বলা হয় বউপাগল। নেতিবাচক এসব দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক কবে পরিবর্তন হবে তা জানা নেই। তবে ছোট ছোট এসব পরিবর্তন বদলে দিতে পারে পুরো সমাজ। একবিংশ শতাব্দীতেও প্রতি তিনজন নারীর একজন কোনো না কোনোভাবে শিকার হন সহিংসতার। অধিকাংশই লোকলজ্জার ভয়ে আইনের আশ্রয় গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। কখনো কখনো নিজ পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমেও শিকার হন সহিংসতার। লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বা যৌন হয়রানির কারণে মেয়েরা নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় পড়ে। আত্মীয়স্বজন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস ও যানবাহনসহ বিভিন্ন স্থানে নারী অথবা মেয়েরা হরহামেশা হয়রানি ও নির্যাতনের মুখোমুখি হন। বর্তমানে নারীরা অশ্লীল, ক্ষতিকর, যৌনতামূলক, বিদ্বেষমূলক মন্তব্য ও ছবি পেয়ে থাকেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ যুগে এমন সহিংসতা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে ফেসবুকসহ সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে আরও সজাগ হতে হবে। কিশোরী অথবা নারী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে জানলেও তারা জানে না কোথায় কী ভাবে সহায়তা পেতে হয়। নারীর প্রতি সহিংসতা বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। 

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ১০ মাসে নারী নির্যাতনের এক হাজার ২১৮টি খবর প্রকাশিত হয়েছে। এসব ঘটনার ৪১ শতাংশ ধর্ষণ ও ৩৬ শতাংশ পারিবারিক নির্যাতনের। নারীকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলাই হতে পারে সহিংসতা প্রতিরোধের অন্যতম উপায়। দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী। তাদের পদচারণা মসৃণ না হলে দেশের উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে শুধু বিনিয়োগই যথেষ্ট নয়। নারী-পুরুষ সবারই পারিবারিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। দেশের উন্নয়নে নারীর অবদান পুরুষের চেয়ে কম নয়। তাই নারীকে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশই নেই। করপোরেট চাকরি, প্রশাসনিক কাজ, রাজনীতি, ফসলের মাঠ, সর্বত্র নারীর পদচারণায় মুখরিত। তবুও নারীরা নির্যাতিত। একটি খবর মাঝে মধ্যেই আমাদের নজর কাড়ে, ডিভোর্স বাড়ছে। যা নারীর পক্ষ থেকেই বেশি হয়। এর কারণ, নারী শিক্ষার হার বাড়ছে। তারাও বাঁচতে চায় ন্যূনতম আত্মসম্মান নিয়ে। নারী সহিংসতা রোধে সর্বাগ্রে মানুষের মধ্যে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নারী নির্যাতনের মামলার বিচার কাজ দ্রুতসম্পন্ন করতে হবে। কঠোরভাবে দমন করতে হবে এসব অপরাধীকে।
 
লেখক : সাংবাদিক

 

×