ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দিল আফরোজ ॥ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন

ফারহানা ইয়াসমিন

প্রকাশিত: ০১:৩৮, ২৪ মার্চ ২০২৩

দিল আফরোজ ॥ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন

দিল আফরোজ

গড়পরতা গ্রামের মেয়েরা যেভাবে বড় হয় তার বেড়ে ওঠার গল্পটাও একই। অজপাড়া গাঁয়ে তার জন্ম, গ্রামের যে স্কুলটিতে তিনি তার পড়াশোনা শুরু করেছিলেন সেখানে নিত্যসঙ্গীর মতোই  ছিল স্কুলের ভাঙ্গা  দরজা,  ফুটো টিনের চাল থেকে পানি ঝড়ে পড়ার শব্দ আর কাঁচা মাটির মেঝে। তবে এই জীর্ণশীর্ণ স্কুল থেকে পাওয়া  প্রাথমিক শিক্ষা কোনো বাঁধা হয়নি তার জন্য পরবর্তীতে বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার জন্য।

গ্রাম থেকে শিক্ষার প্রথম পাঠ শেষ করে ঝালকাঠি শহরের হরচন্দ্র বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও ঝালকাঠি মহিলা কলেজ থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি শেষ করেন তিন। হরচন্দ্র বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে তার খুব প্রিয় একজন শিক্ষক ছিলেন মারুফা বেগম (যিনি বর্তমানে ঝালকাঠি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক) তাকে দেখে মনে মনে শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছাটা তার জাগতে শুরু করে। এতগুলো কথা যার সম্পর্কে বললাম, এবার তার পরিচয় জানার পালা। তিনি দিল আফরোজ খানম, বর্তমানে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক এবং সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন। 
স্কুল ও কলেজের পর্ব চুকিয়ে পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ হতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর এ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী শিক্ষক হিসেবে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে যোগদান করেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে  সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম চেয়ারম্যান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ হাসিনা হলের প্রথম প্রভোস্ট, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের প্রথম ডিনসহ অনেক দায়িত্ব সফলতার সঙ্গে পালন করার সৌভাগ্য হয়েছে তার।

এত কিছুর মধ্যে বিয়ে করে সংসারও পেতেছেন তিনি এবং তার একটি মেয়ে সন্তান আছে। যাকে দুই বছর নয় মাস বয়সের রেখে একা বিদেশে পড়তে চলে যান তিনি। সুইডিশ সরকারের প্রদানকৃত সুইডিশ ইনস্টিটিউট স্কলারশিপ লাভ করে সুইডেনের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান লুন্ড ইউনিভার্সিটিতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি যদিও স্বীকার করেন সেটা খুব চ্যালেঞ্জিং সময় ছিল তার জন্য। যাই হোক, জীবনে চলার পথে অনেক মানুষের সহযোগিতা, উৎসাহের ফল আজকের এই বর্তমান তিনি। 
এর মাঝে ২০১৮ সালে স্টেপস এহেড নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শুরু করেন তিনি। সংগঠনটি ২০১৯ সালে জার্মান অ্যাম্বাসি থেকে পুরস্কার লাভ করে ২০২০ এ লুন্ড ইউনিভার্সিটি থেকে মেন্টরশিপ লাভ করে। এছাড়াও ২০২১ এ জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড, ২০২৩ এ বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম থেকে সেরা সোশ্যাল ইনোভেশন ক্যাটাগরিতে পুরস্কার লাভ করেছে। সমাজ পরিবর্তনে স্টেপস এহেড এর অনন্য ভূমিকার জন্য ২০২২ সালে দিল আফরোজ ইউ এন ভলান্টিয়ার্স, ভিএসও, ইউএন উইমেন কর্তৃক প্রদানকৃত ইন্সপায়ারিং উইমেন ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। 
বর্তমান নারী সমাজ সম্পর্কে সার্বিকভাবে তিনি বললেন, ‘সমাজের যে ভাঙ্গা প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে এতদূরে পৌঁছিয়েছি আমি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে সমাজটির কি খুব পরিবর্তন হয়েছে? না, আশানুরূপ পরিবর্তন এখনো আসেনি। মেয়েদের জন্য আমাদের এই ছোট্ট সোনার বাংলাটি এখনো নিরাপদ হয়নি, লিঙ্গবৈষম্য এখনো অনেক, গ্লাস শিলিং এখনো প্রকট। কর্মস্থল থেকে শুরু করে সমাজের প্রতি স্থানে হাজারো বাধা ডিঙাতে হচ্ছে- মেয়েদের। তাদের প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হচ্ছে ঘরের মানুষের সঙ্গে, যানবাহনের ড্রাইভার-হেল্পারের সঙ্গে, অফিসের বস-কলিগের সঙ্গে, মুদিদোকানদারের সঙ্গে, শপিংমলের ব্যবসায়ী-শ্রমিকদের সঙ্গে, হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সের সঙ্গেসহ আরও অনেকেরই সঙ্গে। 
এত লড়াইয়ের পরেও তাদের ছুঁতে পেরেছি কি  ক্লান্তি ও গ্লানির ছাপ? এ প্রশ্নের প্রেক্ষিতে দিল আফরোজ খানম জানান, ঘরে এবং বাইরে দুজায়গায় লড়াই করে মেয়েরা আজ অনেকটাই স্বনির্ভর হয়েছে এবং হচ্ছে। আমি খুবই আশাবাদী আমাদের মেয়েরা এখন অনেক বেশি সচেতন, পড়াশোনায় অগ্রাহী। এমনকি এখন তারা তাদের জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে জানে’।
 সর্বোপরি তিনি বলেন, ‘এবারের নারী দিবস উপলক্ষে  চাওয়া হলো ‘স্বাবলম্বনই সবচেয়ে বড় অবলম্বন’ এই ব্রত নিয়ে  এগিয়ে আসুক আমাদের মেয়েরা। আর আমরা যারা নতুন প্রজন্মের পূর্বসূরি আছি তারা নতুনদের এগিয়ে দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করব এই  অঙ্গীকার করছি।’

×