ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সংকটে প্রতিবন্ধকতায় কর্মজীবী মায়েরা

অপরাজিতা প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০১:৪৭, ৯ ডিসেম্বর ২০২২

সংকটে প্রতিবন্ধকতায় কর্মজীবী মায়েরা

কর্মজীবী মায়েরা

বাংলাদেশ উন্নয়ন অভিগামিতায় জোর কদমে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। সমসংখ্যক নারীরাও তাদের অংশীদারিত্ব প্রমাণ করতে পেছনের দিকে তাকাচ্ছে না। কর্মজীবী নারীদের সংখ্যাও আজ হাতে গোনার অবস্থায় নেই। সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সব ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক পেশায় নারীদের সম্পৃক্ততা যে কোন সময়ও যুগের দাবি। এক সময়ের সুগৃহিণীরাই আজ আধুনিকতার বিস্তৃত বলয়ে নিজেদের সসম্মানে অধিষ্ঠিত করতে যেভাবে তৈরি হচ্ছেন সেটাও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের অনন্য অর্জন।

শুধু কি চাকরি? না, এখন নারীরা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানেও সফলতার সঙ্গে নিজেকে শুধু মানিয়ে নেওয়াই নয় বরং অন্য অনেকের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে নারীদের প্রাণিতও করছেন। একসময় শিক্ষকতা এবং চিকিৎসক হিসেবেই নারীরা তাদের পেশা নির্বাচনে প্রাধান্য দিতেন। কিন্তু নতুন যুগের অপরিহার্য চাহিদায় ব্যবসাবাণিজ্যকেও পেশায় জায়গা দিতে অর্ধাংশ মহিলা কখনো সেভাবে পিছনে তাকানইনি। সঙ্গত কারণে বাণিজ্যিক ভুবনেও নারী অংশগ্রহণ যেন অপরিহার্যতা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জোরালো ভূমিকা উদোক্তা তৈরিতে নারীদের কতখানি উদ্বুদ্ধ করেছিল তাও যেন নারী স্বাধীনতার অপার বিস্ময় আর মুগ্ধতা। শুধু শিক্ষা নারীদের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিতে পারেনি বরং প্রয়োজন ছিল আর্থিকভাবে স্বাবলম্বন। আর সেটার জন্য শুধু চাকরির আসন ছিল একেবারেই সীমিত। আর ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় তো কখনো সেভাবে উৎসাহই পাননি।

তাই ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশে’ মহাকর্ম প্রকল্পটির উদ্বোধন করলেন। সে সময় সম্প্রসারিত এই দেশ থেকে বহু নারী উদ্যোক্তার শুভ সূচনা বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।
সেটা ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে নারী ব্যবসায়ীর গোড়াপত্তন। তার এক দশক অতিক্রান্তের সুবর্ণকালে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা কোথায় গিয়ে পৌঁছাল তাও এক মুগ্ধতার অপার বিস্ময়। এখন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তার কাতারে বাংলাদেশ শুধু দেশেই নয় আন্তর্জাতিক আঙিনায়ও নজরকাড়া। অতিমাত্রায় উৎসাহব্যঞ্জক হার। নারী ৬৫% আর পুরুষ ৩৫%। নারীরা বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে সম্প্রসারিতভাবে জড়িত হয়েছে সেটা যেমন ঠিক।

তার চেয়েও বেশি সত্য আধুনিকতার সমৃদ্ধ বলয়ে হরেক রকম প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তর। যেমন একক পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া আর যৌথ পরিবার ক্রমান্বয়ে তার ঐতিহ্য হারানো যেন সময়ই সব ঠিক করে দেয়। একক পরিবার মা-বাবা আর সন্তান-সন্তুতি নিয়েই তৈরি। আর যৌথ পরিবার যুগান্তরের সর্বমিলনের এক অবিচ্ছেদ্য সংগঠন। যেখানে মা-বাবাকে সন্তানের দেখভালে বেশি নজরও দিতে হয়নি। দাদা, দাদি, চাচা, চাচি আর ফুফুদের তত্ত্বাবধানেই সন্তান মানুষ হওয়া ছিল চিরকালের এক অভেদ্য নিয়ম।

নতুন যুগ তেমন চিরন্তন বিধির ওপর আঁচ বসায়। পৃথকীকরণ প্রক্রিয়ায় বাবা-মার ছোট্ট পারিবারিক আঙিনাটি শুধু সন্তানরাই মূল সদস্য। সমস্যা বাঁধে তখন যখন যুগের প্রয়োজনে মাকে পেশাগত কারণে বাইরে বেরুতে হচ্ছে। ছোট্ট দুধের শিশুটিকে তো একা ঘরে ফেলে রাখা যায় না। এদিকে মায়ের চাকরিটাও জরুরি। ফলে স্বাভাবিকভাবে সামনে চলে আসে শিশু দিবাযতœ কেন্দ্রটির অবশ্যাম্ভাবিতা।

যে কোনো প্রয়োজনীয় বিষয়ের যাত্রা শুরু হয় চাহিদার অপরিহার্যতায়। শিশু দিবা যতœ কেন্দ্রটিও এর ব্যতিক্রম ছিল না। এই মুহূর্তে সারাদেশে ৪৩টি শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র রয়েছে। তবে কর্মজীবী মহিলার সংখ্যা ১ কোটি ৮৭ লাখ। তুলনামূলকভাবে মাত্র ৪৩টি দিবাযতœ কেন্দ্র কতখানি অপ্রতুল বলার অপেক্ষা রাখে না। সন্তানদের একা বাসায় রেখে কর্মজীবী নারীর পক্ষে তার পেশাটা টিকিয়ে রাখা এক আশঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সঙ্গতকারণে অনেকে চাকরি হারাচ্ছেন কিংবা নিজেরাই পেশা-বিচ্ছিন্ন হয়ে পরিবারে থাকাটাই শ্রেয় মনে করছেন। তবে পেশাগত জীবনে নারীদের ক্রম বিচ্ছিন্নতায় বাংলাদেশের উন্নয়নের যাত্রাপথ শ্লথ হবে কিনা সেটাও বিবেচনার দাবি রাখে। তবে এক্ষেত্রে সবার আগে শিশু দিবা যতœ কেন্দ্রের পরিসর আরও বেশি বাড়ানো যায় কিনা সেটাই এই মুহূর্তে সব থেকে বেশি জরুরি। আড়াই কোটি জনসংখ্যার এই রাজধানীতে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা অনেক।

সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ৪০ জন কর্মজীবী নারী থাকলে সেখানে শিশু দিবা যতœ কেন্দ্র অত্যাবশ্যক। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী কোথাও তা সেভাবে পালন করা হচ্ছে না। ফলে বিব্রতকর এবং বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন অনেক নারী কর্মজীবী। তার ওপর আছে নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি। আগে ছিল তিন মাস এখন ছয় মাস। তবে এটা আট মাস করার পরামর্শ এসেছে বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে। শুধু তাই নয়, মাতৃত্বকালীন ছুটির পরে কর্মজীবী মাকে বাসা থেকে অফিস করতে দেওয়ার সুযোগও অপরিহার্য।

সব থেকে বেশি জরুরি কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো। আর কর্মজীবীদের প্রাতিষ্ঠানিক আঙিনায় তা থাকাও জরুরি। সন্তানকে বেহাল অবস্থায় রেখে কোনো ¯েœহশীল মা স্বস্তিতে, নিরাপদে কাজে মনোনিবেশই করতে পারে না। ফলে পেশাগত দক্ষতাও হ্রাস পাওয়া স্বাভাবিক। যা যেকোনো কর্মজীবী তিনি পুরুষ নারী যাই  হোন না কেন কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। শিক্ষিত ও সুদক্ষ নারী যদি তার যাত্রাপথের কর্মযোগে নানাভাবে হোঁচট খান তাহলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নও প্রশ্নবিদ্ধ হতে সময় নেবে না। আগামীর সমৃদ্ধ ও প্রযুক্তির বাংলাদেশ গড়ার মাঝপথে সব বাধাই দূরীকরণ করা বাঞ্ছনীয়।
আপোসেই রফা
নারী নির্যাতনের বিভিন্ন মামলার তদন্ত মাঝ পথে থেমে যাওয়ার তথ্য আশঙ্কাজনক। তবে আরও বিপরীত তথ্য ভয়ঙ্কর। তদন্ত থেমে যাওয়া কিংবা মামলার দীর্ঘসূত্রিতায় ভুক্তভোগী নারীরা পড়েন আরও বিপাকে। মামলা চালাতে খরচপত্রের প্রয়োজন হয় অনিবার্যভাবে। আর নির্যাতিত নারীর সিংহভাগই হতদরিদ্র কিংবা নিম্নআয়ের। সঙ্গতকারণে মামলা রফা করা ছাড়া তাদের উপায়ও থাকে না।

সেটা আরও মারাত্মক আকার নেয় যখন অপরাধীর সঙ্গে সমঝোতায় আসতে হয়। যেখানে সিংহভাগ অপরাধীই প্রভাবশালী। হয় অর্থবিত্ত নয়ত বা মান মর্যাদায়। অতি আবশ্যিকভাবে টাকার লেনদেন হতে সময় লাগে না।
আর তেমন দফা-রফায় যদি দোষীরা আইনের ফাঁকফোকড়ে বের হয়ে যেতে পারে তাহলে তেমন সুযোগ তো ছাড়ার কথাও নয়। আপাতত: অপরাধের তকমা তো মুছা গেল! সেটাও বা কম কিসের। শুধু কি তাই? পার পাওয়া অপরাধীর শ্যেনদৃষ্টি থাকে নতুন কোনো অন্যায় বা সমাজবহির্ভূত কাজ করতে প্ররোচিত হওয়া।

আইনি প্রক্রিয়ায় বিচারাধীন মামলা খন দুর্বৃত্তায়নের জালে আটকা পড়ে সেখানে শুধু নির্যাতিত নারী কেন সহায় সম্বলহীন নির্বিত্ত পুরুষরাও সংকটের জালে আবৃত হয়। তাই সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা রক্ষাকারী জনবান্ধব কর্তৃপক্ষের আরও বেশি সচেতন দায়বদ্ধতা আবশ্যক, যেখানে অপরাধী পার পাওয়ার কিঞ্চিৎ মাত্র সুযোগ না থাকে।

তবে সবার আগে সাবধান-সতর্কতায় ভুক্তভোগীকেই নিজের সুরক্ষা দেওয়া নৈতিক দায়িত্ব। তার ওপর হয়ে যাওয়া অন্যায়-অবিচারের আইনি কার্যক্রম থেকে কোনোভাবেই যেন সরে না দাঁড়ায়। অপরাধী ছাড়া পেলে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়। ফলে অপরাধের মাত্রা মারাত্মক হতেও সময় নেবে না।

অপরাজিতা প্রতিবেদক

×