ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২

শিক্ষায় ছাত্রীদের ঝরে পড়া

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ১৮:৩৮, ৩ জুলাই ২০২৫

শিক্ষায় ছাত্রীদের ঝরে পড়া

বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের কাতারে সামনের দিকে চলমান প্রক্রিয়া দৃশ্যমান। চিরকালের প্রবাদ শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। সেখানে সমসংখ্যক নারীরা কতখানি সময়ের দাবি পূরণ করছে তাও আলোচনা সাপেক্ষে উঠে আসছে। আর শিক্ষার ক্ষেত্রে পশ্চাদগামিতা যদি ছাত্রীদের বিপন্ন করে তা হলে সমতার আলোকে নারী শিক্ষা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। এক সমীক্ষায় উঠে আসে নবম থেকে এইচএসসি পর্যন্ত ছাত্রীদের ঝরে পড়ার হার চিন্তিত হওয়ারই মতো। হরেক সামাজিক বিপন্নতাই শুধু নয় পারিবারিক নানামাত্রিক সিদ্ধান্তও বালিকা থেকে কিশোরীদের এগিয়ে যাওয়ার পথচলায় বিঘ্নতা তৈরি করা যেন পরিস্থিতির নির্মমতা। কারণ হিসেবে ছাত্রীদের ঝরে পড়ার ইতিহাস সেই পুরানো বাতাবরণেই আধুনিক যাত্রপথের রুদ্ধতার বেষ্টনী। বাধা আর কারণ সেই যুগ-যুগান্তরের পুরানো বিধি বাল্যবিয়ে। যা আজও থামানো গেল না। ঊনবিংশ শতাব্দীর আধুনিক পুরুষ বিদ্যাসাগর তেমন রক্ষণশীল সমাজে উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানিয়েছিলেন কোমলমতি কন্যাদের বিয়ের পিঁড়িতে নয়- বিদ্যালয়ে পাঠাতে হবে পুস্তক হাতে। আজও তা কেন সফল হলো না? বলা মুশকিল। আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির শিল্পায়নের মহাসন্ধিক্ষণে কেন অবোধ  বালিকারা তাদের ন্যায্য অধিকার শিক্ষা থেকে ক্রমাগত বঞ্চিত হচ্ছে। হতদরিদ্র পিতা-মাতার কন্যা সন্তান কেন অকালে অসময়ের শিক্ষার আলো থেকে দূরে সরে যাচ্ছে সেটাও এক চিরস্থায়ী দুর্ভোগ। মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে ছাত্রী ঝরে পড়ার অসম চিত্র বেদনাদায়কই নয় বরং নতুন পরিস্থিতির অনধিগম্য যাত্রাপথও বটে। এক সমীক্ষায় উঠে আসে ‘অষ্টম শ্রেণি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক অবধি এই ঝরে পড়ার হার আশঙ্কাজনক। উপাত্ত নির্দেশ করছে প্রতি তিনজনের একজন ছাত্রী শিক্ষা জীবনে আর থাকতে না পারাও সমাজ সংস্কারের অবধারিত দুর্যোগ, বাল্য বিয়েই শুধু নয় পরিবার, সমাজের হরেক জটিলতায় সবার আগে চাপ সৃষ্টি হয়ে কোমলমতি শিশু কন্যাদের ওপর। আর তাদের তো একটাই নিয়তি অকাল বোধনের মতো বিয়ের সাজে বধূবেশে কারও না কারও ঘরণি বলে যাওয়া। বিংশ শতাব্দীর নারী জাগরণের যোদ্ধা বেগম রোকেয়াও অবরোধবাসিনী কন্যা শিশুদের ভেতরে অর্গল ভেদ করে শিক্ষার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছার আকুল আবেদন জানান। কিন্তু ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দী পার হয়ে আমরা এখন একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের মধ্যাহ্নে। কিন্ত  এমন নতুন সময়ের অবগাহনেও কেন কন্যারা বাল্যবিয়ে আর অকাল মাতৃত্বের শিকার হচ্ছে যা কোনোভাবেই মান্যতা পায় না। আমরা অনেক পুরানো বিধি ব্যবস্থাকে অতিক্রম করতে পারছি। যদিও যাত্রা ততটা মসৃৃণ নয়। তবুও এগিয়ে যাওয়ার মহান ব্রতে আর কিছুটা আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক বলয়ের আধুনিকতার অপার সম্ভাবনায়। নারী সমাজ শিক্ষার আলোই শুধু নয় বৈচিত্র্যিক পেশায়ও নতুন সময়কে আলিঙ্গন করছে। এক সময় চিকিৎসক আর শিক্ষকের পেশায় শিক্ষিত নারীদের অবলীলায় সম্পৃক্ত হওয়া সে সময়ের যুগ ও সমাজের চাহিদা ছিল কিন্তু বর্তমানে বদলে যাওয়া আগামীর বাংলাদেশে বিচিত্র কর্মযোগ নারীদের সমানভাবে উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছে। কিন্তু বিপরীত কিছু অপদৃশ্যও সমসংখ্যককে বিব্রত আর মান্ধাতা আমলের পরিবেশ পরিস্থিতিতে আটকে দিচ্ছে। তার পরও নারী সমাজের সামনে চলার পথে বহু বাধাবিপত্তিকে ডিঙিয়ে যেতে পেছনে ফিরে না তাকানোর চিত্র চমৎকারভাবে সময়কে অভিনন্দিত করছে। সমসংখ্যক নারী খুব বেশি পিছিয়ে থাকলে সার্বিক উন্নয়ন যাত্রা বিঘ্নজালে থমকে দাঁড়ায়। যা পুরো পরিস্থিতিকে নাজুক অবস্থায় আবর্তিত করে। আর বাল্যবিয়ের মতো অতি আদিম প্রবৃত্তিকে নতুন সময়ের নব আহ্বানে ঝেড়ে ফেলা ছাড়া কন্যা শিশুদের সামনে অন্য কোনো রাস্তা নেই। যা শুরু করতে হবে সমাজের অতি আদিম ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান পরিবার থেকেই। দায়িত্ব নিতে হবে পারিবারিক বলয়ে পিতা-মাতাকেই। পুত্র-কন্যা সমঅধিকার সমমর্যাদায় পারিবারিক আঙিনায় নিজেদের নাগরিক অধিকার অদায়ে এগিয়ে আসাও পরিস্থিতির দাবি। সমসংখ্যক কন্যা শিশু যদি বাল্যবিয়ে কিংবা পারিবারিক যে কোনো বৈষম্যের শিকার হয় তার প্রভাব শুধু নির্দিষ্ট সাংসারিক আলয়ে নয় বরং পুরো সমাজ ব্যবস্থাকেই নাড়িয়ে দেয়। ঝরে পড়া এমন দুঃসহ চিত্রকে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাবিদরা উদ্বেগের সঙ্গে অনুধাবন করছেন। বিনামূল্যে বই উপবৃত্তিসহ হরেক কর্মযোগেও কন্যা শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া কোনোভাবেই স্বস্তিকর নয়। বিশিষ্টজনরা বলছেন সরকারকেও এ বিষয়ে নতুন করে চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন আছে। শুধু বাল্যবিয়ে নয় আরও কিছু কারণ তথ্য-উপাত্তে দৃশ্যমান হচ্ছে। অনেক কিশোরী মাধ্যমিকের পরেই হাতের কাছে যা পায় তেমন কোনো কর্মযোগে জড়িয়ে পড়ে। আর সেখানেই তার শিক্ষার্থী জীবনের চিরস্থায়ী ব্যবচ্ছেদ। তাই শেষ পর্যন্তও বলা যায় পরিবারকেই সচেতন সাবধানতায় কন্যা সন্তানকে তার মেধা-মননের স্ফুরণে ভবিষ্যতের চলার পথও নির্ধারণ করে দেওয়া আবশ্যক। যেভাবে পুত্র সন্তানকে তৈরি করা হয় কন্যাকেও তেমন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া বাঞ্ছনীয়। 

প্যানেল

×