
ছবি: সংগৃহীত
একদিকে তীব্র দাবদাহ, অন্যদিকে আর্দ্রতা—এই দুইয়ে যেন পুড়ছে পুরো দেশ। আবহাওয়া অধিদপ্তর ইতোমধ্যেই জানিয়েছে, চলতি সপ্তাহে দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে তাপমাত্রা থাকবে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। এই ভয়াবহ গরমে মানুষ অসুস্থ হচ্ছেন হিটস্ট্রোকে।
চোখে দেখা যায় না, কিন্তু মুহূর্তেই প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে হিটস্ট্রোক। তাই সচেতনতা ও প্রস্তুতিই একমাত্র প্রতিরক্ষা।
হিটস্ট্রোক কী?
হিটস্ট্রোক হলো এমন এক অবস্থা, যেখানে শরীর অতিরিক্ত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় এবং দেহের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি উঠে যায়। সাধারণত ঘাম, শ্বাসপ্রশ্বাস ও রক্তসঞ্চালনের মাধ্যমে শরীর নিজেকে ঠান্ডা রাখে। কিন্তু তীব্র গরম ও আর্দ্র পরিবেশে এসব প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে শরীরে তাপ জমা হতে থাকে এবং একপর্যায়ে মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড ও কিডনিসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো বিকল হয়ে যেতে পারে।
কারা সবচেয়ে ঝুঁকিতে?
হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে—
1.শিশু ও বয়স্কদের
2.গর্ভবতী নারীদের
3.উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের
4.যারা কায়িক পরিশ্রম করেন (কৃষক, নির্মাণ শ্রমিক)
5.যাঁরা গরমে বাইরে চলাফেরা করেন, বিশেষ করে রোদে
হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হলে যেসব লক্ষণ দেখা দেয়
১. মাথাব্যথা ও বিভ্রম
২. শরীর গরম হয়ে যাওয়া, ঘাম বন্ধ হয়ে যাওয়া
৩. চামড়া শুকনো, লালচে ও উত্তপ্ত হওয়া
4. দ্রুত হৃৎস্পন্দন ও শ্বাস-প্রশ্বাস
৫. বমি বমি ভাব বা বমি
৬. হাত-পা দুর্বল হয়ে যাওয়া বা খিঁচুনি
৭. অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বা সাড়া না দেওয়া
এসব লক্ষণ দেখা দিলে সময় নষ্ট না করে রোগীকে দ্রুত ছায়া বা ঠান্ডা জায়গায় নিয়ে যান এবং চিকিৎসা নিন।
হিটস্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয়—নিজেকে ও পরিবারকে সুরক্ষিত রাখার ১০টি কার্যকর উপায়
১. প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করুন
গরমে শরীর দ্রুত পানি হারায়। দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন। অতিরিক্ত ঘাম হলে ওআরএস বা লবণ-চিনির শরবত খেতে পারেন।
শিশুরা ও বয়স্কদের বারবার পানি পান করান, কারণ তারা নিজেরা সচেতনভাবে পান না-ও করতে পারে।
২. রোদ এড়িয়ে চলুন, বিশেষ করে দুপুর ১২টা থেকে ৪টা
দিনের সবচেয়ে বেশি গরম থাকে এই সময়টায়। এই সময়ে জরুরি না হলে বাইরে না যাওয়াই ভালো। বাইরে যেতে হলে ছাতা, হ্যাট বা সানগ্লাস ব্যবহার করুন।
3. হালকা ও ঢিলেঢালা সুতির পোশাক পরুন
গরমে ভারী ও টাইট কাপড় শরীরের তাপ বাড়িয়ে তোলে। হালকা রঙের সুতির জামা ঘাম শোষণ করে এবং শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে।
4. গরমে ঠান্ডা খাবার ও জলীয় ফল খান
তরমুজ, শসা, ডাবের পানি, আনারস ইত্যাদি ফলে জলীয় উপাদান বেশি থাকে, যা শরীর ঠান্ডা রাখতে সহায়ক।
ঝাল ও তৈলাক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন, যা দেহের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
5. বাড়ির পরিবেশ শীতল রাখুন
জানালায় পর্দা ব্যবহার করুন যাতে রোদ সরাসরি ঘরে না আসে। সম্ভব হলে সকাল ও সন্ধ্যায় জানালা খুলে হাওয়া চলাচল নিশ্চিত করুন।
6. বাড়তি পরিশ্রম এড়িয়ে চলুন
শরীরচর্চা বা শারীরিক পরিশ্রম সকালে বা সন্ধ্যায় করুন। তীব্র গরমে দৌড়, হাঁটা বা ভারী কাজ হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
7. নিয়মিত বিশ্রাম নিন ও ঘুম পূর্ণ করুন
শরীরের শক্তি ধরে রাখতে ও গরমে ধকল সামাল দিতে পর্যাপ্ত ঘুম অত্যন্ত জরুরি।
8. বাইরের খাবার ও দূষিত পানীয় এড়িয়ে চলুন
গরমে খাদ্যে ব্যাকটেরিয়া দ্রুত জন্মায়। বাড়ির তৈরি পরিষ্কার খাবার ও বিশুদ্ধ পানিই খান।
9. সঙ্গে রাখুন পানি ও লবণ-চিনির গোলা
বাইরে গেলে ছোট বোতলে পানি ও ঘরে তৈরি ওআরএস রাখুন। প্রয়োজনে নিজে খান ও অন্যকে সাহায্য করুন।
10. ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের বিশেষ নজরে রাখুন
শিশু, বৃদ্ধ, গর্ভবতী নারী ও অসুস্থ ব্যক্তিরা হিটস্ট্রোকে বেশি সংবেদনশীল। তাদের খাবার, পোশাক, বিশ্রাম ও পানীয়ের বিষয়ে বাড়তি যত্ন নিন।
হিটস্ট্রোক হলে তাৎক্ষণিক করণীয়—জীবন বাঁচাতে জরুরি পদক্ষেপ
১. রোগীকে তৎক্ষণাৎ ছায়া বা ঠান্ডা জায়গায় নিয়ে যান
২. যতটা সম্ভব শরীর ঠান্ডা করার চেষ্টা করুন (ঠান্ডা পানিতে কাপড় ভিজিয়ে শরীর মুছে দিন বা বরফ দিন)
৩. রোগীর মাথা একটু উঁচু করে দিন
৪. জ্ঞান থাকলে ওআরএস বা ঠান্ডা পানি দিন
৫. জ্ঞান না থাকলে মুখে কিছু দেবেন না
6. সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে যান, বিলম্ব নয়
স্বাস্থ্য অধিদফতর (DGHS) সূত্র জানায়, ২০২৫ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত হিটস্ট্রোক সন্দেহে অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে আরও বেশি হতে পারে, কারণ অনেক ক্ষেত্রেই হিটস্ট্রোকজনিত মৃত্যুকে আলাদা করে চিহ্নিত করা হয় না।
এর আগেই, ২০২৪ সালের এপ্রিল-মে মাসে দেশে রেকর্ড পরিমাণ তাপপ্রবাহ দেখা দেয়। কোথাও কোথাও তাপমাত্রা পৌঁছায় ৪৩.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এই তীব্র তাপদাহে প্রাণ হারান কমপক্ষে ১৫ জন। সেসময় দেশের অধিকাংশ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়, যার ফলে প্রায় ৩ কোটির বেশি শিক্ষার্থী শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, “বাংলাদেশে শহরাঞ্চলে যেভাবে ঘনবসতি ও বাতাস চলাচলহীন পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, তা হিটস্ট্রোকের জন্য মারাত্মক বিপদ ডেকে আনছে।”
সচেতনতাই বাঁচার চাবিকাঠি
হিটস্ট্রোক একটি নিরব ঘাতক। কিন্তু সঠিক সতর্কতা ও সময়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করলেই এই প্রাণঘাতী পরিস্থিতি প্রতিহত করা সম্ভব। মনে রাখুন, "এক ঢোক পানি ও একফোঁটা সচেতনতা—দু’টিই জীবন বাঁচাতে পারে।" তাই এই গরমে নিজেকে সুরক্ষিত রাখুন, প্রিয়জনকে সচেতন করুন। কারণ সুরক্ষা মানেই বাঁচার অধিকার।
Mily