ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

নতুন চীন-বাণিজ্য ‘চুক্তি’: ঘুরে ফিরে আগের জায়গায়ই যুক্তরাষ্ট্র

প্রকাশিত: ১২:২১, ১২ জুন ২০২৫

নতুন চীন-বাণিজ্য ‘চুক্তি’: ঘুরে ফিরে আগের জায়গায়ই যুক্তরাষ্ট্র

ছবিঃ সংগৃহীত

লন্ডন বৈঠকে প্রাথমিক সমঝোতা হলেও প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধের লাভ নিয়ে। দুই দিন ধরে টানটান উত্তেজনার মধ্যে চলা আলোচনার পর যুক্তরাষ্ট্র ও চীন একটি প্রাথমিক সমঝোতায় পৌঁছেছে—যদিও সেটি কতটা স্থায়ী হবে, তা এখনো অনিশ্চিত। লন্ডনে বুধবার ভোররাতে ‘হ্যান্ডশেক চুক্তির’ মাধ্যমে দু’দেশ একে অপরের ওপর আরোপিত কিছু কঠোর বাণিজ্যিক পদক্ষেপ শিথিল করতে সম্মত হয়েছে। তবে বিশ্লেষকদের প্রশ্ন, এত মাস ধরে চলা সংঘাতের পর যুক্তরাষ্ট্র আসলে কী অর্জন করল? 

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে চলা সাম্প্রতিক বাণিজ্য যুদ্ধের পরিণতিতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক অনেকটাই খারাপ হয়ে পড়েছিল। এপ্রিল থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের বাড়তি শুল্ক আরোপ এবং পাল্টা চীনা নিষেধাজ্ঞার জেরে অর্থনীতিতে একপ্রকার অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল। এখন লন্ডনের আলোচনায় সেই অবস্থা খানিকটা বদলালেও সেটি মূলত পুরনো অবস্থায় ফিরে যাওয়ার নামান্তর মাত্র।

চীন রপ্তানির ওপর দেওয়া কিছু নিষেধাজ্ঞা শিথিল করবে, বিশেষ করে বিরল খনিজ উপাদান যেগুলো মার্কিন সামরিক ও শিল্প খাতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রযুক্তিপণ্যের ওপর আরোপিত নতুন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ হালকা করবে এবং চীনা শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিলের হুমকিও প্রত্যাহার করবে।

তবে এই আলোচনায় দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্য সংকট বা অন্যান্য বড় ইস্যুতে কোনো অগ্রগতি হয়নি। ভবিষ্যতে আলোচনা করে সেগুলোর সমাধান খোঁজা হবে বলে জানিয়েছেন মার্কিন কর্মকর্তারা।

ডিজিএ-অ্যালব্রাইট স্টোনব্রিজ গ্রুপের সিনিয়র উপদেষ্টা ও যুক্তরাষ্ট্র চেম্বার অব কমার্সের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইরন ব্রিলিয়ান্ট বলেন, “আমরা মনে হচ্ছে একটি বৃত্তেই ঘুরছি। একবার উত্তেজনা বাড়ে, আবার কমে। কিন্তু কোথাও আসল অগ্রগতি হচ্ছে না।”

মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের কৌশল সফল—কারণ চীনের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার জবাবে তারাও পাল্টা কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্কের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি চলতি দশকে ১৯৬০’র দশকের পর সবচেয়ে ধীর গতির হতে পারে।

বুধবার সকালে সামাজিক মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প লেখেন, “চীনের সঙ্গে আমাদের চুক্তি সম্পন্ন। সম্পর্কও দুর্দান্ত।” তবে তিনি স্বীকার করেন, এই চুক্তি এখনো তিন ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায়।

তিনি আরও লেখেন, “পুরো চুম্বক ও প্রয়োজনীয় বিরল খনিজ উপাদান চীন সরবরাহ করবে। আমরাও চীনা শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ দিচ্ছি—যা সবসময়ই আমি সমর্থন করেছি!”

দুই দিন ধরে লন্ডনে হওয়া আলোচনায় একাধিকবার উত্তপ্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছিল বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। উভয় দেশের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসের ঘাটতি স্পষ্ট ছিল।

আলোচনায় অংশ নেওয়া বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক বলেন, “প্রেসিডেন্টের মূল লক্ষ্য ছিল বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং পারস্পরিক বাণিজ্য বাড়ানো। তার আগে অবশ্য সব ‘নেগেটিভিটি’ দূর করতে হতো।”

চীনা দূতাবাসের মুখপাত্র লিউ পেংইউ বলেন, “বাণিজ্যযুদ্ধে কেউ জয়ী হয় না। চীন সংঘাত চায় না, তবে ভয়ও পায় না।”

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিরল খনিজ রপ্তানি বন্ধ করে চীন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলেছে। কারখানা, সামরিক খাত এমনকি বড় বড় কোম্পানি হোয়াইট হাউসের কাছে স্বস্তির দাবি জানাতে বাধ্য হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রও পাল্টা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তবে তাতে নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেমন, চীনের জন্য নির্ধারিত ইথেন রপ্তানি বন্ধ করে মার্কিন জ্বালানি খাত বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ ফিলিপ লাক।

বিশ্লেষক ইলারিয়া মাজজোক্কো বলেন, “ওয়াশিংটনে ধারণা ছিল চীন সহজেই চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে। কিন্তু চীন প্রমাণ করেছে তাদের সহ্যক্ষমতা অনেক বেশি।”

এছাড়াও চীনের রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিন ক্যানরং বলেন, “বিরল খনিজ আমাদের হাতে এক ট্রাম্পকার্ড, আর ট্রাম্পের বোঝা উচিত, চাপ ও হুমকি চীনের সঙ্গে কার্যকর পদ্ধতি নয়।”

এই চুক্তি আপাতত উত্তেজনা কিছুটা কমাতে পারলেও অনেক বিশ্লেষক আশঙ্কা করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার নামে নেওয়া পদক্ষেপ এখন চীন দ্বিপাক্ষিক দরকষাকষির টেবিলে টেনে আনবে। এভাবে যদি বাণিজ্য ও নিরাপত্তার রেখা মুছে যায়, তবে ভবিষ্যতে আরও জটিল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

এশিয়া সোসাইটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ওয়েন্ডি কাটলার বলেন, “জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে যে কৌশল এতদিন আলোচনা থেকে দূরে রাখা হয়েছিল, এখন তার দরজা চীনকে খুলে দেওয়া হয়েছে। এটা এক বড় পালাবদলের ইঙ্গিত।”

নোভা

×