
২০২৪-এর জুলাইয়ে সাড়া জাগানো গণঅভ্যুত্থান দেশ ও জাতির জন্য নতুন যাত্রা পথের অনন্য অঙ্গীকার। সেখানে সমসংখ্যক নারীর অবস্থান, এগিয়ে চলা বিবেচনা সাপেক্ষে। যে কোনো সমাজ, সংস্কার, সভ্যতা নানামাত্রিক অসাম্য আর বৈষম্যকে জিইয়ে রেখে সংগঠিত হয়। পরবর্তীতে এগিয়ে যাওয়া, সার্বিক মানুষের ন্যায্যতা দেওয়া আইন, অধিকারকে স্বীকার করে নেওয়া সেটা প্রচলিত নিয়মানুগের অনুষঙ্গ। শ্রেণি বিভাজনভিত্তিক সমাজ কাঠামো ফারাকের আবর্তে জড়িয়ে থাকা এক অসম ব্যবস্থার নিয়ামক কৌশল। সৃষ্টির ঊষাকাল থেকে যে বিভাজন সবার সামনে আসে তা কিন্তু নারী-পুরুষের ব্যবধানে সূচনাকাল। আদিম সাম্যবাদী প্রাচীন সমাজে বিত্তবৈভবের কোনো বালাই ছিল না। সকলে মিলে ফল-ফলাদি বন-বনান্তরে ঘুরে যা কুড়িয়ে আনত তাই মিলেমিশে আহারের সংস্থান হতো বলে নৃবিজ্ঞানীদের জোরালো অভিমত। নারী-পুরুষের অবাধ স্বেচ্ছাচার আর দলগত বিবাহে পিতৃত্বের কোনো স্বীকৃতিই ছিল না। মায়ের গর্ভ থেকে সন্তান ভূমিষ্ঠ হতো বলে গর্ভধারিণী জননীর পরিচয় সৃষ্টি বৈচিত্র্যের অনন্য নিদর্শন। যবে থেকে সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি উদ্ভাবন সেখান থেকেই নারীর মূল ভূমিকায় টানাপোড়েন। সভ্যতা যত এগিয়েছে তেমন অসম ব্যবস্থাপনায় নারী সমাজের ওপর যে ব্যবধানের প্রাচীর তোলা হয় সেটা আজও এক সমাজ সভ্যতার ক্ষতবিক্ষত আঁচড়। আমরা এখন তথ্যপ্রযুক্তির শিল্পোন্নত সমাজ ব্যবস্থাকে ধারণ-লালন করে যাচ্ছি। কিন্তু সেই পুরানো সংস্কারাচ্ছন্ন প্রথা আজও বিলুপ্ত না হওয়া সময়-সভ্যতার কালোচিহ্ন। তাই যুগ পরম্পরায় বহুবার উচ্চারিত এক অনধিগম্য সেøাগান- নারীর নিরাপত্তা আসলে কোথায়? ক্ষুদ্র পারিবারিক গণ্ডি থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ পুরো কাঠামোর ভিত্তিমূলে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো অসহনীয় এক দাবানলের নিত্য নতুন পরিক্রমা। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ’২৪-এর জুলাইয়ে নারীর অংশগ্রহণই শুধু নয় তাদের সার্বিক বিকশিত জীবন গড়ার প্রত্যয় এখনো সরবে উচ্চকিত। সম্প্রতি জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া বিপ্লবী ছাত্রীদের এক অনুষ্ঠানে এভাবে তাদের অভিমত ব্যক্ত করা হয়। প্রশ্ন তোলা হয় নারীদের বিকাশে সবার আগে জরুরি তাদের নিরাপত্তা। যার অভাবে যোগ্যতম নারীও পিছু হটতে বাধ্য হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, গণপরিবহন কোথাও নিরাপদভাবে চলতে না পারায় সমসংখ্যক যেভাবে বিপন্নতার শিকার হচ্ছেন তা সত্যিই দূর করা সমাজের কল্যাণেই জরুরি। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির বিকশিত যুগে তেমন দুর্বিষহ অবস্থা আরও শোচনীয় পর্যায়ে। ‘নারী অধিকার প্ল্যাটফর্ম’ সদস্যদের এক মতবিনিময় সভায় অভিমত ব্যক্ত করা হয় যে কোনো মানুষের বিকাশমান জীবন এগিয়ে নিতে তার সার্বিক নিরাপত্তা জরুরি। সাথে পারিপার্শ্বিক অবস্থাকেও অনুকূলে নিয়ে আসা সময়ের অপরিহার্যতা। গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া নারীদের হরেক অভিযোগ ওঠে আসে বিভিন্ন বক্তব্যে। বলা হচ্ছে তারা গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে কি কোনো ভুল করেছিল? সমবেত নারীরা এক বাক্যে বলছেন- একেবারেই না। দেশের স্বার্থ আর জনগণের নির্বিঘ্ন চলার পথে সব সময়ই পাশে থাকার অঙ্গীকার এক উদ্দীপ্ত চেতনা। অনুষ্ঠানটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় মহিলা ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদের উপস্থিতি ও আলোচনায় নেতৃত্ব দেওয়া।
নারীর প্রতি নিপীড়ন, বঞ্চনা সমাজ সংস্কারের চিরায়ত মূল্যবোধ, অপসংস্কৃতি যাই বলি না কেন। একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের মধ্যাহ্নেও জোরেশোরে আওয়াজ তুলতে হচ্ছে নারীর নিত্য জীবন-মন বিকাশে সবার আগে নিরাপত্তার বেষ্টনীই তৈরি করতে হবে। তা না হলে চিরায়ত প্রথা আর বিঘ্নতায় এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অঙ্কুরেই না বিনষ্ট হতে পারে। ‘নারীর চোখে আগামীর বাংলাদেশ’ শিরোনামে এক আলোচনা সভায় নারী নেত্রীদের কণ্ঠে এমন দৃঢ়চেতা মনোবৃত্তি অনুরণন হতে থাকে। তবে নারীর সামনে চলার কাঁটা বিছানো যাত্রাকে যে কোনো মূল্যে আলোর ঝলকানিতে উজ্জীবিত করাও সময়ের দাবিতে আধুনিকতাকে আলিঙ্গন করা। নিয়তই যেখানে সম্মুখ সমর মোকাবিলা করতে হয়। নারীর বিরুদ্ধে চলমান হরেক নৃশংসতার আঁচড়কে অতিক্রম করতে গেলে সবার আগে আপন বলয়কে নির্ভয় আর নিষ্কণ্টক করা পরিস্থিতিকে নিজের আয়ত্বে রাখা। যুদ্ধ আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা যা, যা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু নারী-পুরুষের অসমতা কমাতে গেলে সময় কতদূর পাড়ি দিতে হবে তা এক অজানা বিস্ময়। নারীর প্রতি নির্মমতার শেকল জড়ানো অপদৃশ্য সেই পুরাকাল থেকে, যা আজ অবধি ভাঙা গেল না। অদূর ভবিষ্যতে কতখানি সম্ভব তাও সুদূরপরাহত। স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে ’২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অনেক নারী লাঞ্ছিত এমনকি মৃত্যুবরণও করতে হয় কিছু সম্মুখ সারির নেত্রীকে। কিন্তু কয়েক মাস যেতে না যেতেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের যাত্রা পথ স্তিমিত হয়ে আসলে নারীদের পেছনে ফেলতেও কিছুমাত্র ভাবা হয়নি। গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রীদের সচেতন অংশ গ্রহণে কোনো চাওয়া পাওয়া কিংবা স্বীকৃতি আদায়ের ব্যাপারও ছিল না। স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে স্বৈরাচারী সরকারের পতনকে অনিবার্য করতে ছাত্রীরাও রাস্তায় নেমে আসে। কোনো আকাক্সক্ষা কিংবা স্বীকৃতি আদায়ে নয়। দেশের দুঃসময়ে সচেতনভাবে আন্দোলনে শরিক হওয়াও ছিল পরিবেশ পরিস্থিতির চাহিদা।
প্যানেল