
ছবি: সংগৃহীত
অ্যাপল টিভি প্লাসের নতুন একটি সিরিজ ‘বিশ্বের প্রথম সেলিব্রিটি শেফ’ হিসেবে খ্যাত অঁতোয়ান কারেমের জীবন তুলে ধরছে—ফরাসি বিপ্লব পরবর্তী সময়ে এক উচ্ছৃঙ্খল প্রতিভাবান হিসেবে যিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শেফদের জন্য পথ দেখিয়ে গেছেন।
এই সিরিজটিকে বর্ণনা করা হয়েছে “প্রথম সেলিব্রিটি শেফের গল্প” হিসেবে। ‘কারেম’ নামের ফরাসি ভাষার এই নাট্যধর্মী সিরিজটি অঁতোয়ান কারেমের জীবনের উপর ভিত্তি করে নির্মিত, যিনি ১৭৮৪ সালের দিকে বিপ্লব-পূর্ব প্যারিসে দারিদ্র্যের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর অসাধারণ রান্নার দক্ষতা তাঁকে ফরাসি কূটনীতিক তালেয়রঁ, সম্রাট নেপোলিয়ন, ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ রাজা জর্জ চতুর্থ, রাশিয়ার জার আলেকজান্ডার ও ব্যারন দে রথচাইল্ডের ব্যক্তিগত শেফ বানায়। তিনি বিখ্যাত রাঁধুনিদের টুপি ‘তোক’ (যা এখনো প্রচলিত) চালু করেন এবং বেশ কয়েকটি খ্যাতনামা রাঁধুনির বই লিখেছিলেন—যার মাধ্যমে “সেলিব্রিটি শেফ” ধারণারই জন্ম হয়।
অভিনেতা বেঞ্জামিন ভয়জাঁ, যিনি এই সিরিজে কারেম চরিত্রে অভিনয় করছেন, বিবিসিকে বলেন, “আজ যদি কারেম বেঁচে থাকতেন, তাহলে টিকটকে তাঁর ১০ কোটি ভিউ থাকত। এটাই ছিল তাঁর যুগের সমতুল্য।”
ভয়জাঁর চরিত্রায়নে কারেম যেন আধুনিক এক রকস্টার; তাঁর কানে দুল, পোশাক ১৯ শতকের বদলে যেন ১৯৮০-এর দশকের নিউ রোমান্টিক ঘরানার। নারীঘটিত সম্পর্ক থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতনদের প্রতি শ্রদ্ধাহীনতায় তিনি যেন এক কথিত ‘অঁফঁ তেরিব্ল’। রান্নাঘরে তিনি আত্মবিশ্বাসী, সাহসী ও কর্তৃত্বপরায়ণ—যা গর্ডন র্যামজির মতো আধুনিক সেলিব্রিটি শেফদের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
সিরিজটির অনুপ্রেরণা এসেছে ইয়ান কেলির লেখা কারেমের জীবনী থেকে। তিনি চিত্রনাট্যকার দাভিদে সেরিনোর সঙ্গে মিলে এই সিরিজ তৈরি করেছেন। কেলি তাঁর বইতে কারেমের শুরুর জীবনকে “বইপ্রেমী নিষ্পাপ” বলে বর্ণনা করলেও, ২৫ বছর বয়সী কারেম সম্পর্কে তিনি বলেন, “সে ছিল আকর্ষণীয়, তার চুল বাইরনীয় কায়দায় সামনের দিকে ছাঁটা ও এলোমেলো... শরীর ছিল হালকা গড়নের, আর খেতেও খুব কম।” কেলি তাঁকে “মহাত্বাকাঙ্ক্ষী, আত্মকেন্দ্রিক, এমনকি নার্সিসিস্টিক” হিসেবে বর্ণনা করলেও সিরিজের কারেম প্রিয়জনদের জন্য অনেক কিছু ঝুঁকির মুখে ফেলেন।
তবে, যথারীতি সিরিজে কিছু কাল্পনিক রঙও যোগ করা হয়েছে—যেমন কারেমকে গুপ্তচর হিসেবে দেখানো হয়েছে, যার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। প্রধান পরিচালক মার্টিন বুরবুলোঁ একে বলেন, “গল্প বলার সৌন্দর্য।” আসলে, কারেম তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খুব কম তথ্য রেখে গেছেন। কেলির ভাষায়, “তিনি তাঁর পেশাগত জীবনের খুঁটিনাটি, অতিথি তালিকা, মেনু ও উপকরণ সম্পর্কে বিস্তর লিখেছেন, কিন্তু ব্যক্তিগত বিষয়ে কিছুই জানাননি।”
যা ঐতিহাসিকভাবে সত্য, তা হলো—রাজকীয় প্রাসাদের রান্নাঘর, বিপুল কর্মী বাহিনী এবং রাজসিক ভোজের জটিল প্রস্তুতি। সিরিজে তাঁকে নেপোলিয়নের জন্য একটি ভোজ আয়োজন করতে দেখা যায়, বাস্তবেও তিনিই সম্রাটের বিয়ের কেক তৈরি করেছিলেন। চিনির ভাস্কর্য তৈরিতে তাঁর দক্ষতা ছিল অতুলনীয়—যার মধ্যে শাস্ত্রীয় ল্যায়ার বা ভেনিসীয় গন্ডোলার মতো আকৃতি ছিল, আর প্রতিটিই কারেম নিজে হাতে স্কেচ করে নিতেন।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ অধ্যাপক পল ফ্রিডম্যান বলেন, “তিনি রান্নাঘরের কাঠামোগত নিয়ম প্রতিষ্ঠা করেন, কোন খাবারের সাথে কী ধরনের সস বা গার্নিশ মানায়, কোন খাবার কোন কোর্সে পরিবেশিত হবে—এই সবই তাঁর অবদান। চিনির ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে তৈরি খাবারের ধারণাও তিনিই চালু করেন।”
কারেমের রান্নার কিছু রেসিপি আজও শুনতে লোভনীয়—যেমন কমলা ফুল ও গোলাপি শ্যাম্পেইনের জেলি। আবার কিছু রেসিপি, যেমন ভরা বুনো শুকরের মাথা, আজকের যুগে একটু অদ্ভুত ঠেকতে পারে। তবুও পরিচালক বুরবুলোঁর লক্ষ্য ছিল, “আধুনিক দর্শকের কাছে এই রাঁধুনিকে সহজভাবে উপস্থাপন করা।”
বুরবুলোঁ, যিনি আলেকজান্ডার দ্যুমার ঐতিহাসিক উপন্যাস থ্রি মাস্কেটিয়ারস-এর দুটি সফল রূপান্তর পরিচালনা করেছেন, বিবিসিকে বলেন, “এই সিরিজে আমি ঐতিহ্যগত ‘পিরিয়ড ড্রামা’-র ধরন ভাঙতে চেয়েছি। আমি একটু সেক্সি, রক-এন-রোল ধাঁচ, এবং আধুনিক একটা গন্ধ দিতে চেয়েছিলাম।”
অভিনেতা ভয়জাঁ বলেন, “আমাদের ধারণায় কারেমের মধ্যে একটা মিক জ্যাগার টাইপের ব্যাপার ছিল। তার সেই লেনি ক্রাভিটজ ঘরানার চেহারা ও জীবনবোধ—এটাই মূল আকর্ষণ ছিল। এটা একটা তরুণের সমাজে নিজের জায়গা খুঁজে পাওয়ার লড়াইয়ের গল্প।”
ঐতিহাসিক অঁতোয়ান কারেমের অসাধারণ সাফল্য তাঁকে সেই আত্মবিশ্বাস দিয়েছিল—তাঁকে বলা হতো “শেফদের রাজা ও রাজাদের শেফ”। অনেকেই তাঁকে ফরাসি গ্যাস্ট্রোনমির জনক ও গ্রঁদ কুইজিন (ঐতিহ্যবাহী রাজকীয় ফরাসি রান্নার শৈলী)-এর প্রতিষ্ঠাতা মনে করেন।
তবে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের পল ফ্রিডম্যান মনে করেন, কারেম হয়তো প্রথম সেলিব্রিটি শেফ নন। ফরাসি রাঁধুনি গিয়োম তিরেল, যিনি “তাইয়োভঁ” নামে পরিচিত, ১৩১০-১৩৯৫ সালের মধ্যে ফরাসি রাজাদের জন্য রান্না করতেন এবং তাঁর লেখা রান্নার বই দ্য ভিয়াঁদিয়ে আজও টিকে আছে। এখনো তাঁর নামে অনেক রেস্টুরেন্ট চালু আছে।
কারেম আধুনিক ইউরোপের একজন সেলিব্রিটি শেফ হলেও, তিনি শেষ প্রজন্মের রাজদরবার নির্ভর শেফদের একজন ছিলেন। তাঁর কোনো রেস্টুরেন্ট ছিল না, সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগও ছিল না। তাঁর অসংখ্য রন্ধন বই মূলত অন্যান্য পেশাদার রাঁধুনিদের জন্য লেখা, গৃহিণীদের জন্য নয়।
ফ্রিডম্যানের মতে, “তিনি আধুনিক সেলিব্রিটি শেফদের দিকে সেতুবন্ধন গড়েছেন—যারা এখন মিডিয়া, টেলিভিশন, ব্যক্তিত্ব আর রেস্টুরেন্ট ব্যবসার মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করে থাকেন।”
শহীদ