ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৮ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২

লিপি হালদার

অনন্য ব্যক্তিত্বে নারী

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৯ জানুয়ারি ২০১৬

অনন্য ব্যক্তিত্বে নারী

আমাদের চিন্তা, অনুভূতি এবং আচরণের সমন্বয়েই আমাদের ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। এ সকল বৈশিষ্ট্য এবং গুণাবলী একে অন্যের থেকে আমাদের আলাদা করে তোলে, আমাদের নিজেদের একান্ত আমি কে প্রকাশ করে। অর্থাৎ ব্যক্তিত্বই মানুষের পরিচায়ক যা তাকে একে অন্যের থেকে আলাদাভাবে উপস্থাপন করে। প্রত্যেকেই নিজের ব্যক্তিত্বকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে চায়, নারীও তার ব্যতিক্রম নয়। এই উপমহাদেশে এক সময় নারী শিশু ছিল অভিশাপ। নারী ছিল সমাজের কাছে বন্দী, আলাদা করে তার ব্যক্তিত্বের কথা ভাবেনি অনেক নারী নিজেও। সেই শিকলাবস্থা থেকে নারী নিজেকে আজ অনেকটাই উঠিয়ে এনেছেন সম্মানের আসনে। আজ নারীর নিজের পরিচয় আছে, যদিও সংখ্যায় নিতান্তই কম, তবু কোথাও আজ এগিয়ে এসেছে নারী। শিকল আর শোষণের পরাধীনতা থেকে নারী হয়ে উঠেছে পরিবারের নির্ভরতার একটি প্রতীক। ধর্মের রোষানল, ফতোয়া কাটিয়ে পুরুষের পাশাপাশি সর্ব ক্ষেত্রে আজ নারীর বিচরণ, বিকাশ লাভ করেছে নারীর ব্যক্তিত্বের। তবু পুরুষশাসিত এই সমাজে পুরুষের নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে যাওয়া নারীর সংখ্যাও নেহাতই কম নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশীদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পুরুষের ছত্রছায়াই যেন নারীর পরিচয়, অনেক ক্ষেত্রেই নারীর আলাদা ব্যক্তিত্বকে খুঁজে পাওয়া যায় না তার কর্মকা-ে। এখনও অনেক ক্ষেত্রেই নারীর পরিচয়, ব্যক্তিত্ব নির্ভর করে পুরুষের সামাজিক মর্যাদা এবং পুরুষ কতটা এগিয়ে দেবে, সুযোগ দেবে তার উপরে। পুরুষশাসিত সমাজের প্রতিবন্ধকতা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখনও এমনভাবে ছড়িয়ে যেন নারী অবলা, একটু করুণা করে দাও ওকে, করুণার দানটুকুই তার জন্য যথেষ্ট, নারী নিজেও বিগলিত। প্রতিকুলতার মাঝেও কিছুসংখ্যক নারী নিজের ব্যক্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করে সমাজে নারীর স্বকীয় বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরতে সফল হয়েছেন বলেই নারী আজ একটি ভিন্ন সত্তা হিসেবে নিজের জায়গা সমাজে গড়ে তুলতে পেরেছে। আবার এমন অনেক ক্ষেত্র আছে, যেখানে পরিলক্ষিত হয়, সম্মুখে নারীর ক্ষমতায়ন কিন্তু পশ্চাতপদে নিজেদের ব্যক্তিত্বকে জিম্মি করে তুলে দিচ্ছেন অপরের কাছে। নিজেদের পুরুষের করুণার পাত্রী হিসেবে পরনির্ভরশীলভাবে তুলে ধরতেই যেন নারীর সুখভোগ, পরিতৃপ্তি! অনেক ক্ষেত্রেই নারী তার ব্যক্তিত্বকে বিকোশিত না করে, লোক দেখানো অথবা দৈহিক সৌন্দর্যের সীমাবন্ধতার মাঝেই নিজেকে খুঁজে নিতে সহজ পথটি বেছে নেন। নারীর চিন্তা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ন্যায্যতা এবং মতামত বহু স্থানেই নির্বাক, নিশ্চুপ, অর্থাৎ ব্যক্তিত্বের অভাব পরিলক্ষিত হয় প্রকটভাবে। নারীর পরিচয়, ব্যক্তিত্বের মাপকাঠি হয়ে ওঠে পুরুষ। নারীর পদমর্যাদা কি হবে, সমাজের কোন ক্ষমতাসীন ব্যক্তির স্ত্রী কোন পদাধিকার পাবেন, এসব নির্ধারণ করে দেন সমাজের পুরুষেরা। যে সমস্ত নারী তা মেনে নিয়ে নিজের ব্যক্তিত্বকে অন্যের মাঝে বিলীন করতে দ্বিধাবোধ করেন না অথবা অতিরিক্ত কিছু দেবার মতো মানসিকতা রাখতে পারেন, সমাজের প্রভু হয়ে বসে থাকা পুরুষের কথায় সুর মেলাবেন, তাদের এগিয়ে চলাই সমাজের অনেকাংশে, নারীর ক্ষমতায়নে হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এবং এভাবেই নারীর ব্যক্তিত্বের পরিচয় হয়ে উঠেছে তিনই কার কন্যা, কার স্ত্রী, কার বোন, কার আত্মীয় হিসেবে। যদিও সমাজে নারীর সহঅবস্থান এবং অংশগ্রহণ বেড়েছে বলে এক শ্রেণীর নারী-পুরুষ বড়ই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন কিন্তু প্রকৃতভাবে নারীর ব্যক্তিত্বের বিকাশ লাভের মাধ্যমে সমাজের নানা ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বা ক্ষমতায়ন হয়েছে অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে। নারীর নিজের পরিচয়ে সমাজে পরিচয়, স্থান, ক্ষমতা বিকোশিত হওয়ার পথে প্রধান অন্তরায় নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির অভাব এবং নারীর ব্যক্তিত্ব বিকাশের অভাব। সমাজে কোন নারী, স্ব-ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত পুরুষের ইচ্ছার বিপরীতে এগিয়ে যেতে চাইলেই তাকে সমাজের পুরুষরা এবং তাদের অধিনস্ত নারীরা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা তৈরিতে এগিয়ে আসেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে থামিয়ে দেয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করে থাকেন। এই যুদ্ধ, সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা দূর করে খুব কম নারী পারেন সমাজে নিজের ব্যক্তিত্ব বা পরিচয় তুলে ধরতে। যারা সকল বাধা পেরিয়ে সংগ্রামে জয়ী হন তাদের জয়লাভের অন্তরালে হারাতে হয় অনেক, পেরোতে হয় বহু দুর্গম পথ। তবু আশার আলো এই যে, সেই দুর্গম পথেই হেঁটে হেঁটে এগিয়ে আসছেন নারী, পরিচিত হচ্ছেন সমাজে নিজের পরিচয়ে, নিজের ব্যক্তিত্বে। এই এগিয়ে চলায় বা সচেতনতা সৃষ্টিতে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, সর্বাগ্রে নারীদের সচেতন হতে হবে নিজের ব্যক্তিত্ব গঠন, বিকাশ এবং ব্যক্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে। নারীর ব্যক্তিত্বের গঠন এবং বিকাশ, অনেকাংশে পুরুষের ব্যক্তিত্বের চেয়েও বেশি জরুরী এই কারণে যে, নারীকে সন্তান ধারণ করতে হয়, সন্তানকে লালন-পালন করতে হয়। এবং নারীর শিক্ষাই সন্তানের প্রথম শিক্ষা হয়ে রয়ে যায়। আপনার সন্তানটি অন্যকে কিভাবে সম্মান করবে, কিভাবে একজন নারীর সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে, নীতিশিক্ষা, সৌজন্যবোধ, ভুল স্বীকার, ক্ষমা, সততা, ন্যায্যতা, অপরকে সাহায্য করা, এ সকলের প্রথম পাঠ, ঘর থেকেই শিশু শিক্ষা লাভ করে। তাই নারীর স্বশিক্ষিতি হওয়া, আত্মবিশ্বাস অর্জন, ন্যায্যতায় বিকাশসহ নানাগুণে নিজেকে সাজিয়ে নিজের ব্যক্তিত্বের বিকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় নারী বিভিন্ন সময়ে নানা দুর্গম, সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়েই এগিয়ে এসেছে, এগিয়ে আসছে। তবে নারীর এই এগিয়ে আসা এবং সমাজের নানা ক্ষেত্রের নানা অবস্থানে বিকোশিত হোক নারীর স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব, নিজের চিন্তাধারা, নিজের পরিচয়। নিজের যোগ্যতায় নারী করুক বিশ্ব জয়, তৈরি হোক নারীর জন্য সমাজে সম্মানজনক অবস্থান।
×