
“থমাস সাংকারা যে বিপ্লব শুরু করেছিলেন, আমরা তা পূর্ণ করতে এসেছি।”
এভাবেই দৃঢ় প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠে নিজ লক্ষ্যের মূলমন্ত্র ঘোষণা করেন সাহারার প্রান্ত ছুঁয়ে থাকা বুরকিনা ফাসোর প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম ট্রাওরে।
থমাস সাংকারা ও ইব্রাহিম ট্রাওরে, সময়রেখায় আফ্রিকার অতীত ও বর্তমান প্রজন্মের দুই জনপ্রিয় কিংবদন্তি নেতা। একজন তার কর্মের মধ্য দিয়ে মৃত্যুর পরেও অমর হয়ে আছেন আরেকজন ঔপনিবেশের কালো থাবা থেকে মুক্তির দিশা দেখাচ্ছেন হতদরিদ্র পশ্চিম অফ্রিকানদের।
১৬ থেকে ১৭ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ফরাসি সাম্রাজ্য যখন একের পর এক পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে ঔপনিবেশের বীজ বপন করতে থাকে তখন এই ভয়াল কালো থাবা থেকে বাদ পড়েনি বুরকিনা ফাসো । পূর্বে দেশটির নাম ছিল ‘আপার ভোল্টা’ যা ১৯৬০ সালে ফরাসি ঔপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
স্বাধীনতার পর থেকে অভ্যুত্থান, ঘাত-প্রতিঘাত, সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে দেশটি এক অনিশ্চিত সময় পার করতে থাকে। এই ক্রান্তিকালে কিছু দেশপ্রেমিক মানুষ দেশকে দুরবস্থা থেকে উত্তরণের সংকল্পে ‘ন্যাশনাল রেভলুশনারি কাউন্সিল’ গঠন করে। এই কাউন্সিল একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনা অফিসার থমাস সাংকারাকে ‘হেড অভ দ্যা স্টেট’ ঘোষণা করে বুরকিনা ফাসোর রাষ্ট্র ক্ষমতায় নিয়ে আসে।
ক্ষমতায় এসেই তিনি দেশটিকে নতুন করে গড়ার কাজে নেমে পড়েন, শুরু করেন এক অভূতপূর্ব সংস্কারযাত্রা।। ‘আপার ভোল্টা’ থেকে দেশটির নাম পরিবর্তন করে বুরকিনা ফাসো রাখেন যার অর্থ ‘সৎ মানুষের দেশ’। নারীশিক্ষার উন্নয়নসহ শিক্ষার হার ১৩ শতাংশ থেকে ৭৮ শতাংশে উন্নীত করেন। বন্ধ হয়ে যাওয়া জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি পুনরায় চালু করেন এবং ১৯৮৪ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৫ লক্ষ্য শিশুকে টীকা দেয়ার প্রকল্পের সাফল্য নিশ্চিত করেন। শিশু মৃত্যুর হার ২০.৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৪.৫ শতাংশে নিয়ে আসেন। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে সামন্ততান্ত্রিক জমিদারদের কাছ থেকে গচ্ছিত রাখা জমি নিয়ে দরিদ্র কৃষকদের মাঝে বণ্টন করে দেন। গৃহহীন মানুষের আবাসনের জন্য গৃহায়ন প্রকল্প চালু করেন। এছাড়া তিনি দেশকে মরুকরণের থেকে রক্ষার জন্য এক কোটি বৃক্ষরোপণ ও যোগাযোগখাতে উন্নয়নের জন্য ৭০০ কিলোমিটার রেলরোড তৈরি করেন।
সরকারি কাজে ব্যবহারের জন্য পূর্বে ব্যবহৃত মার্সিডিজ গাড়ি বিক্রি করে সে সময়ের সর্বনিম্ন দামের ‘রেনল্ট ৫’ গাড়ি ব্যবহার করতেন। এছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিভিন্ন লাক্সারি সুবিধা বাতিল করেন এবং এক মাসের বেতন জনউন্নয়ন তহবিলে দান করতে বাধ্য করেন। দেশের মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করে তিনি নিজে কখনো আরামদায়ক জীবন গ্রহণ করেননি। প্রতিমাসে মাত্র ৪৫০ ডলার করে বেতন নিতেন যা তার দেশের ইতিহাসে যেকোনো প্রেসিডেন্টের তুলনায় সবচেয়ে কম।
তিনি পৃথিবীর একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি একটি স্বাধীন দেশের নতুন নামকরণ করেন এবং একইসাথে সে দেশের জাতীয় সংগীত রচনা করেন। তার শাসনামলে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হলেও তিনি কখনো বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য নেননি। তিনি বলতেন,
“যে তোমাকে খাওয়াবে, সেই তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। তাই নিজের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিতে হলে নিজের শক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার বিকল্প নেই।’
মাত্র ৩৩ বছরে ক্ষমতায় আসীন হয়ে ৪ বছর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করে দেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করেন। তার সাফল্যের কথন নিজ দেশ ছাড়িয়ে আফ্রিকা ও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহল ও ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের প্রেতাত্মারা তা সহ্য করতে পারেনি। ১৫ আগস্ট ১৯৮৭ সালে এক কাউন্সিল মিটিং চলাকালে সাংকারাসহ বারোজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে বুলেটের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চক্রান্তকারীরা ক্ষমতা দখল করলেও বুরকিনা ফাসোর জনগণ সাংকারাকে জাতীয় বীরের মর্যাদার আসনে বসিয়েছিল। বিপ্লব ও ভালোবাসার জন্য তাকে আফ্রিকার চে গুয়েভারা বলা হয়।
ইতিহাসের অমোঘ সত্য হলো একজন বিপ্লবীকে হত্যা করা হলেও তার আদর্শকে হত্যা করা যায় না। পৃথিবী ভেবেছিল বিপ্লবী সাংকারার স্বপ্ন চিরতরে হারিয়েগেছে কিন্তু ৩৯ বছর পর অনুর্বর মাটির দেশখ্যাত বারকিনা ফাসোতে সাংকারার আদর্শের পুনর্জন্ম হলো তরুণ নেতা ইব্রাহিম ট্রাওরের উত্থানের মধ্য দিয়ে।
মাত্র ৩৪ বছর বয়সে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইব্রাহিম ট্রাওরে ক্ষমতায় আসেন। বারকিনা ফাসোর প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্রথমেই তিনি দেশ থেকে ফ্রান্সের সেনাদের বিতাড়িত করেন। দেশের বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ রক্ষায় বেশ কয়েকটি সোনার খনি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাত থেকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে আসেন। সাংকারার মতোই তিনি বিদেশি ঋণ নির্ভর পশ্চিমা উন্নয়ননীতি বাতিল করেন এবং বামপন্থী অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন করেন। এছাড়াও দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের জন্য এ খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেন।
তথাকথিত পপুলিস্ট রাজনীতির পথে না হেঁটে থমাস সাংকারার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে সে পথেই এগিয়ে যাচ্ছেন ইব্রাহিম ট্রাওরে। তার কাজের মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশবাদের প্রেতাত্মা ও সাম্রাজ্যবাদের রীতিনীতি গুড়িয়ে সাফল্যের সাথে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। পশ্চিমা জোটের থেকে ক্রমাগত দূরে সরে গিয়ে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করছেন।
ট্রাওরে প্রথম আফ্রিকানদের নজর কাড়েন ২০২৩ সালে রাশিয়া-আফ্রিকা শীর্ষ সম্মেলনে। সেখানে তিনি আফ্রিকান নেতাদের বলেন,
“উপনিবেশবাদীরা দড়ি টানলে আমরা যেন পুতুলের মতো না নাচি।”
তার এই বক্তব্য গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর তরুণদের মাঝে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এছাড়াও তার আত্মবিশ্বাস, স্পষ্টভাষী ও অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য তাকে আফ্রিকার তরুণদের নতুন কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। প্রবীণরা তার মধ্যে আফ্রিকার চে গুয়েভারা খ্যাত থমাস সাংকরার প্রতিচ্ছবি দেখতে পান।
আফ্রিকার প্রাচীন ভূমিতে এক বিপ্লবী স্বপ্ন বপন করেছিলেন থমাস সাংকারা, যা আজ ইব্রাহিম ট্রাওরের হাতে নতুন রূপ পাচ্ছে। ইতিহাস সাক্ষী, আফ্রিকান বিপ্লবীদের উত্থান যেমন দ্রুত হয়, তেমনি পতনও অনেক সময় হঠাৎ করেই ঘটে। সময়ই বলে দেবে ইব্রাহিম ট্রাওরে সত্যিকার অর্থেই ইতিহাস গড়বেন, নাকি সময়ের ঢেউয়ে মিলিয়ে যাবেন আফ্রিকার আরেকটি সাহসী প্রতীক হয়ে।
মুমু