
ছবিঃ সংগৃহীত
অত্যাধুনিক ডিজাইন, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি এবং পরীক্ষিত অস্ত্রসজ্জার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি যুদ্ধবিমান বিশ্বে সেরা বলে স্বীকৃত। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে বিশ্বের এক নম্বর সামরিক শক্তি। তাদের সমরাস্ত্র কিনলে সেই শক্তির কিছুটা ক্রেতাদেশেও সঞ্চালিত হবে—এই আশা নিয়েই অনেক দেশ মার্কিন যুদ্ধবিমান কেনার জন্য মুখিয়ে থাকে। তবে বাস্তবে, যুদ্ধবিমান কেনার সঙ্গে সঙ্গে নানা শর্ত, নিষেধাজ্ঞা ও 'টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনস' মেনে চলতে হয়, যা মাঝে মাঝে দেশগুলোর জন্য অনেক সীমাবদ্ধতা তৈরি করে।
যখন কোনো দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে যুদ্ধবিমান কেনে, তখন শুধু একটি বিমানই কেনা হয় না। এর সঙ্গে যুক্ত থাকে একগুচ্ছ শর্ত ও বিধি-নিষেধ, যা জানিয়ে দেয়, বিমানটি আপনির হলেও, এর আসল মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ থাকে ওয়াশিংটনের হাতে। অতীতে পাকিস্তান, ইরান, ভেনেজুয়েলা, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো এই চুক্তির শিকার হয়ে নিজেদের কেনা বিমানও যুদ্ধের সময়ে ব্যবহার করতে পারেনি। বহু সময় তাদের যুদ্ধবিমানগুলো শুধু হ্যাঙ্গারে পড়ে থেকেছে, কারণ আমেরিকা কোনো যুদ্ধের মিশনে এর ব্যবহারের অনুমতি দেয়নি।
এই শর্তের প্রথম ধাপ হচ্ছে 'এন্ড ইউজার এগ্রিমেন্ট' (EUA), যেখানে দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তারা বিমানটি নিজের মর্জিমতো ব্যবহার করতে পারবে না। যুদ্ধের সময়, কোথায়, কিভাবে এবং কার বিরুদ্ধে এটি ব্যবহার করা হবে, তা নির্ধারণ করবে আমেরিকা। এর মানে, বিমানটি আপনার হলেও, এর উপর আমেরিকার সরাসরি নিয়ন্ত্রণ থাকে। নিজস্ব ইচ্ছায় কিছু করতে গেলে একে একে আসতে পারে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৯ সালে পাকিস্তান তাদের এফ-১৬ যুদ্ধবিমান দিয়ে ভারতীয় সীমান্তে অভিযান চালাতে চেয়েছিল, তবে EUA অনুযায়ী, আমেরিকার অনুমতি ছাড়া এটি সম্ভব হয়নি। ফলে, বিমানগুলো শুধুমাত্র সীমান্তের উপর চক্কর দিয়ে ফিরে আসত এবং কোনো যুদ্ধের মিশনে ব্যবহার করা হয়নি।
এরপর আসে 'আইটিএআর' (International Traffic in Arms Regulations), যা শুধুমাত্র মার্কিন অস্ত্র-বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ করে না, বরং অস্ত্রের প্রতিটি যন্ত্রাংশ ও সফটওয়্যার কোডের উপর আমেরিকার নজরদারি নিশ্চিত করে। এর ফলে, কোনো দেশ চাইলেও তাদের কেনা বিমান মেরামত বা আপগ্রেড করতে পারবে না, যদি না আমেরিকা তা অনুমোদন করে। ন্যাটো সদস্য দেশ বা মার্কিন মিত্র দেশগুলোতে কিছুটা সহজ নিয়ম প্রযোজ্য হলেও, তারা পুরোপুরি মুক্ত নয়। ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যের অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বিএই সিস্টেমকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করা হয় আইটিএআর লঙ্ঘনের জন্য।
শুধু চুক্তিপত্র বা সফটওয়্যারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সমস্যা আরও গভীরে। আধুনিক আমেরিকান যুদ্ধবিমানগুলো এতটাই জটিল যে, তাদের রক্ষণাবেক্ষণ, যন্ত্রাংশ বদল, সফটওয়্যার আপডেটসহ সবকিছুর জন্য মার্কিন প্রস্তুতকারকদের সহায়তা প্রয়োজন। যদি কোনো কারণে আমেরিকা অসন্তুষ্ট হয় বা মনে করে যে, কোনো দেশকে শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন, তখনই বন্ধ হয়ে যেতে পারে এই সাপ্লাই চেইন। যেমনটা ঘটেছিল ইরানের ক্ষেত্রে। ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, ইরান যখন আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল, তখন তারা প্রায় ৮০টি অত্যাধুনিক এফ-১৪ টমকেট যুদ্ধবিমান কিনেছিল। তবে ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর, আমেরিকা সব ধরনের স্পেয়ার পার্টস এবং সফটওয়্যার আপডেট সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। ফলে, এই যুদ্ধবিমানগুলো একে একে অচল হয়ে পড়ে।
এছাড়াও, মার্কিন যুদ্ধবিমান চুক্তির অন্যতম শর্ত হলো, আপনি এই বিমান অন্য কোনো দেশের কাছে বিক্রি করতে পারবেন না—এতে যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি লাগবে।
যদিও বিকল্প রয়েছে, যেমন ফ্রান্সের রাফায়েল, সুইডেনের গ্রিফেন, রাশিয়ার এসইউ-৩৫ এবং চীনের জে-৬এক্স, তবে এসবের পেছনেও আলাদা আলাদা শর্ত ও জটিলতা রয়েছে। এটি এমন একটি সিদ্ধান্ত, যেখানে স্বাধীনতা কখনোই বিনা খরচে আসে না। যদি আপনি মার্কিন যুদ্ধবিমান না কেনেন, তবে আপনাকে অন্য বিকল্পের সাথে কোনো না কোনো শর্ত মেনে চলতে হবে।
যেমনটি তুরস্ক প্রমাণ করে দেখাচ্ছে, তারা নিজের সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে নজর দিয়েছে। ফলে, যুদ্ধবিমান কেনার পর, যে কোনো দেশ আসলে শুধু একটি আকাশপথের যোদ্ধাই কেনে না, তারা কিনে নেয় রাজনৈতিক আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি, যা কখনো কখনো বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
মারিয়া