ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকল্পের বিরোধিতায় কলকাতা হাইকোর্টে মামলা

আদানির বিদ্যুতে অনিশ্চয়তা

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২৩:১২, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

আদানির বিদ্যুতে অনিশ্চয়তা

ঝাড়খ- থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলা হয়ে আদানির বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে

ঝাড়খ- থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলা হয়ে আদানির বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে। কিন্তু গত বছরই কৃষি জমি নষ্টের অভিযোগ তোলে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কার চাষিরা। গত বছরের জুলাই মাসে এই নিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে গ্রামবাসী। এরপর গত মঙ্গলবার বাংলাদেশে আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ রপ্তানি প্রকল্পের বিরোধিতা করে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে মামলা দায়ের করেছেন পশ্চিমবঙ্গের ৩০ চাষি। আর এতেই বিদ্যুৎ রপ্তানির ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

রপ্তানি আয়ের এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই সম্মিলিতভাবে আদানি গ্রুপ এ পর্যন্ত মূলধন হারিয়েছে ৭ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। এরফলে এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির তকমা হারালেন ভারতের বৃহত্তম শিল্পগোষ্ঠী আদানি গ্রুপের কর্ণধার গৌতম আদানি। তাকে টপকে আবারও এশিয়ার শীর্ষ ধনীর স্থান দখল করছেন আরেক ভারতীয় ব্যবসায়ী মুকেশ আম্বানি। 
গত কয়েকদিন আগে আদানি গ্রুপের শেয়ারবাজার কারসাজি, অর্থপাচার আর কর ফাঁকি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শেয়ারবাজার বিশ্লেষক সংস্থা হিনডেনবার্গ রিসার্চের একটি বিশেষ প্রতিবেদন হুলস্থূল ফেলে দিয়েছে বিশ্বজুড়ে। ভারতীয় শিল্পগোষ্ঠী আদানিকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিনডেনবার্গ রিসার্চ বলেছে, সংস্থাটি জাতীয়তাবাদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। আদানি গোষ্ঠীর দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবাদ এবং যাবতীয় যুক্তি নাকচ করে হিনডেনবার্গ বলেছে, ‘আমরা বিশ্বাস করি জালিয়াতি জালিয়াতিই। এভাবে পৃথিবীর অন্যতম ধনী হলেও তা জালিয়াতিই।’ এদিকে শেয়ারবাজারে আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক দরপতনের পাশাপাশি ভারতের ব্যাংক খাতে দেখা দিয়েছে চরম উদ্বেগ। কারণ ব্যাংকগুলোতে প্রতিষ্ঠানটির বিপুল অঙ্কের ঋণ রয়েছে।
আলোচিত এই আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তি রয়েছে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের। আগামী মার্চ মাসে এ বিদ্যুৎ আসার কথা রয়েছে। হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদনের জেরে আদানি গ্রুপের মূলধন কমে যাওয়ায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে এ বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে এক ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনে এলে জ্বালানির ব্যয় হিসেবে বড় ধরনের বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে আদানির।

এদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বিদ্যুতের দাম ও ক্যাপাসিটি চার্জ তুলনামূলক বেশি বলে পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। এর মধ্যে গত মঙ্গলবার বাংলাদেশে আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ রপ্তানি প্রকল্পের বিরোধিতা করে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে মামলা দায়ের করেছে পশ্চিমবঙ্গের ৩০ চাষি। আর এতেই বিদ্যুৎ রপ্তানির ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। 
জানা যায়, ঝাড়খ- থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলা হয়ে আদানির বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু গত বছরই কৃষি জমি নষ্টের অভিযোগ তুলে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কার চাষিরা। গত বছরের জুলাই মাসে এই নিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে গ্রামবাসী। আহত হয় একাধিক গ্রামবাসী ও পুলিশ। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ না দিয়েই জোরপূর্বক আম-লিচু বাগানের উপর দিয়ে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুতের লাইন বাংলাদেশে নিয়ে যাচ্ছেন আদানি। গ্রামবাসীদের দাবি, এলাকাটি জনবসতিপূর্ণ।

সেখানে আমগাছ, লিচুগাছ রয়েছে। ওই আম-লিচুর ফলনের ওপর নির্ভরশীল স্থানীয়রা। তা থেকেই জীবন অতিবাহিত হয় তাদের। কিন্তু ওই ফসলি জমির ওপর দিয়ে বিদ্যুতের ক্যাবল গেলে ফলনের উপর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন তারা। তাই অন্য দিক থেকে বিদ্যুতের তার নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন গ্রামবাসী। কিন্তু রাজ্য প্রশাসন ও আদানি গ্রুপ সেই প্রস্তাব নাকচ করে। এমন অবস্থায় জুলাই মাসেই হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন লুৎফর রহমান নামে এক ফল চাষি। সেই সময় বিচারপতি সব্যসাচী ভট্টাচার্য গোটা মামলা শোনার পরে আদানি গ্রুপের জমি কেনা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।

তবে বিদ্যুতের খুঁটি বসানো হওয়ায়, তাদের আদানির প্রকল্পের নিরাপত্তা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় রাজ্য সরকারকে। একইসঙ্গে মুর্শিদাবাদের জেলাশাসককে ফারাক্কা এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে নির্দেশ দেন তিনি। বলা হয়, ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ক্ষেত্রে মুর্শিদাবাদের জেলাশাসকের কাছে আবেদন করতে হবে। তিনি ক্ষতিপূরণের বিষয়টি বিবেচনা করবেন। কিন্তু দীর্ঘ ৬ মাসে রাজ্য সরকারের নিরাপত্তায় আদানির সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ হলেও ক্ষতিপূরণ মেলেনি চাষিদের।

এমন অবস্থায় ফের আদানি গ্রুপের ও রাজ্য সরকারকে অভিযুক্ত করে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন ফারাক্কার ৩০ ফল চাষি। তাদের হয়ে মঙ্গলবার কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন সিনিয়র আইনজীবী ঝুমা সেন। আদালতও মঙ্গলবার এই মামলাটি গ্রহণ করেছে। ফলে বাংলাদেশের আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি শুনানির দিন ধার্য করেছে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব ও রাজর্ষি ভরদ্বাজের ডিভিশন বেঞ্চ।
বিতর্কিত আদানির দরপতন থামছেই না ॥ হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদনের জেরে ভারতের আদানি গ্রুপের যে পতন শুরু হয়েছে তা যেন থামছেই না। বুধবারও ধস নেমেছে আদানি গ্রুপের শেয়ারে। তালিকাভুক্ত আদানি গ্রুপের মোট আটটি প্রতিষ্ঠানের এমএসসিআই ইন্ডিয়া সূচক কমেছে প্রায় ৪৯ শতাংশ। সম্মিলিতভাবে আদানি গ্রুপ এ পর্যন্ত মূলধন হারিয়েছে ৭ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। এর ফলে বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় কয়েক ধাপ নেমে যাওয়ার পর, এবার এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির তকমা হারালেন ভারতের বৃহত্তম শিল্পগোষ্ঠী আদানি গ্রুপের কর্ণধার গৌতম আদানি।

তাকে টপকে আবারও এশিয়ার শীর্ষ ধনীর স্থান দখল করছেন আরেক ভারতীয় ব্যবসায়ী মুকেশ আম্বানি। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৭ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের ক্ষতির মুখে পড়ে বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় গৌতম আদানি তিন থেকে ১৫-তে নেমে এসেছেন। ফোর্বসের বিলিয়নিয়ার ইনডেক্স অনুসারে, বুধবার গৌতম আদানির সম্পদের পরিমাণ ছিল ৮০.৩ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, ফোর্বসের বিলিয়নিয়ার ইনডেক্স অনুসারে, বুধবার বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় শীর্ষ ১০ এ প্রবেশ করেছেন ভারতীয় ধনকুবের মুকেশ আম্বানি।

৮ হাজার ৩৭০ কোটি ডলারের সম্পদ নিয়ে বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় নবম অবস্থানে রয়েছেন আম্বানি। আদানি এন্টারপ্রাইজের শেয়ার আদানির সম্পদের অন্যতম উৎস বলা হয়, যা বুধবারও ৩০ শতাংশ কমেছে। আদানি পাওয়ারের শেয়ারমূল্য কমেছে ৫ শতাংশ ও আদানি ‘টোটাল’ গ্যাসের শেয়ারমূল্য ১০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে, আদানি ট্রান্সমিশনের শেয়ারের দাম কমেছে ৬ শতাংশ ও আদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোনের শেয়ারের দাম ২০ শতাংশ কমেছে। আদানি ‘টোটাল’ গ্যাসের সঙ্গে চুক্তি রয়েছে ফ্রান্সের ‘টোটাল’ গ্যাস কোম্পানির। জানা যায়, গত কয়েকদিনে আদানি টোটাল প্রায় ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলার হারিয়েছে, যা এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় লোকসান।

×