ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

ঋষি সুনাকের বিলিয়নিয়ার শ্বশুর

প্রকাশিত: ১৪:১৩, ২৬ অক্টোবর ২০২২

ঋষি সুনাকের বিলিয়নিয়ার শ্বশুর

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের শ্বশুর নারায়ণ মূর্তি

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাজনীতিবিদ ঋষি সুনাকের শ্বশুর নারায়ণ মূর্তি একজন বিলিয়নিয়ার হিসেবেই পরিচিত। তিনি ৩.৯ বিলিয়ন পাউন্ডের মালিক। কিন্তু এই বিশাল অর্থের মালিক হয়েও নারায়ণ মূর্তি রয়ে গেছেন ঠিক আগের মতোই নিতান্ত সাদাসিধা মানুষ। এখনো স্ত্রী সুধা মূর্তিকে নিয়ে ব্যাঙ্গালুরুতে সেই একই ফ্ল্যাটে থাকেন তিনি, যেখানে থাকতেন তারা কয়েক দশক আগে। নারায়ণ মূর্তি এখনো একটা ছোট গাড়ি চালান, খাওয়ার পর থালাবাসন পরিষ্কার করেন, এমনকি নিজের টয়লেট পর্যন্ত নিজেই পরিষ্কার করেন এই ভারতীয় বিলিয়নিয়ার!

নারায়ণ মূর্তি ১৯৮১ সালে সফটওয়্যার ফার্ম 'ইনফোসিস' প্রতিষ্ঠা করেন । ৪১ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এই বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান বাজারমূল্য ৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন পাউন্ড এবং সেখানে কর্মরত আছেন ৩ লাখ ৪৫ হাজার মানুষ।

বিলিয়নিয়ার হয়ে ওঠার আগের নারায়ণ মূর্তি-সুধা জুটির সঙ্গে বর্তমানের এই জুটির একমাত্র পার্থক্য হলো, তাদের ফ্ল্যাটটির দেয়াল ছুঁই ছুঁই করছে বই! তাদের জীবনে নেই চাকচিক্য কিংবা দামি পোশাকের বাহার, নেই কোনো ব্যক্তিগত বিমান, বিলাসবহুল বাড়ি কিংবা নামিদামি ব্র্যান্ডের ছোয়া। তাদের জীবনের সবকিছুই পরিমিত এবং সাদামাটা। নারায়ণ মূর্তি একজন অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ, যিনি শুধুই বই পড়তে পছন্দ করেন।

সুধার ২০১৭ সালে প্রকাশিত বই 'থ্রি থাউজেন্ড স্টিচেস'-এ তিনি জানিয়েছেন কিভাবে তার স্বামী নিজের টয়লেট নিজেই পরিষ্কার করেন- যে কাজটি বহু ভারতীয় নিচু জাতের মানুষদের দিয়ে করিয়ে নেয়, এবং খাওয়ার পর নিজের বাসনও নিজেই পরিষ্কার করেন নারায়ণ মূর্তি।

শুধু ঘরের ভেতরেই নয়, নারায়ণ মূর্তি তার প্রতিষ্ঠান 'ইনফোসিস'-এও রেখেছেন সেই একই প্রভাব, যা তার কর্মীদের মুখে শোনা যায়। ইনফোসিস'র কর্মীরা জানান, নারায়ণ মূর্তি শ্রমের মর্যাদায় বিশ্বাসী একজন মানুষ। প্রতিষ্ঠানের ক্যান্টিনের বৈদ্যুতিক সমস্যাও নিজ হাতে ঠিক করতে দেখা গেছে তাকে। কর্মীদের ভাষ্যে, তিনি সততা ও বিশুদ্ধতায় পূর্ণ একজন মানুষ যিনি কখনো কাউকে ঘুষ দেননি।

বই পড়া ব্যতীত নারায়ণ মূর্তির প্রিয় কাজ হলো মানবসেবা। তার একটি বিখ্যাত উক্তি হলো- "টাকার সবচেয়ে বড় শক্তি নিহিত এটি বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যেই।"

সফটওয়্যার কোড লেখার জন্য কিভাবে একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো যায়- তা নিয়ে ছয় ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুর সাথে নিজের ফ্ল্যাটে বসে বিতর্কের মধ্য দিয়েই জন্ম হয় 'ইনফোসিস'-এর। সেসময় এমনকি কোনো কম্পিউটারও ছিল না তাদের। সুধার কাছ থেকে ১০,০০০ রূপি ধার করে ফ্লাটের সামনের কক্ষে অফিস খুলে বসেন নারায়ণ মূর্তি।

গত চার দশকে ইনফোসিস'র কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়েছে সফটওয়্যার অবকাঠামো, কনসাল্টিং, প্রযুক্তি ও আউটসোর্সিং সেবা খাতে। চলতি শতাব্দীর প্রথম দশকে যখন মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো সফটওয়্যার ডেভলপমেন্টের কাজ ভারতের দিকে নিয়ে আসতে শুরু করে সস্তা বলে, তখন ইনফোসিস'র প্রসার বেড়ে যায়। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে ইনফোসিস'র আয় বেড়ে ১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটির মূল্য ১১ বিলিয়ন ডলার।

২০১১ সালে প্রতিষ্ঠানের পর্ষদের চেয়ারপারসনের পদ থেকে অবসর গ্রহণের আগপর্যন্ত নারায়ণ মূর্তি এতটাই সময়ানুবর্তী একজন মানুষ ছিলেন যে তার সাথে কেবল ইমানুয়েল কান্ট-এরই তুলনা করা যায়।

চলতি বছরের জুলাইয়ে ইকোনমিক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নারায়ণ মূর্তি বলেন, "অবসর নেওয়ার আগপর্যন্ত আমি প্রতিদিন সকাল ৬টা ২০-এ অফিসে পৌঁছাতাম। এটা অফিসের বাকিদের সময়মতো অফিসে পৌঁছানোর ব্যাপারে একটি শিক্ষণীয় বার্তা দেয়।"

নারায়ণ মূর্তি ও সুধা দুজনের বয়সই এখন সত্তরের শেষ কোঠায়। বিলিয়নিয়ার হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে মধ্যবিত্ত দক্ষিণ ভারতীয় জুটি বলেই মনে হওয়ার পেছনে রয়েছে তাদের অতি সাধাসিধে জীবনযাপন। আর দশজন দক্ষিণ ভারতীয়র মতোই সাধারণ খাওয়াদাওয়া পছন্দ করেন তারা। মেনে চলেন পারিবারিক মূল্যবোধ এবং সততা ও কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে দিন কাটান। তাদের এই খ্যাতির কারণেই দিল্লীর বাড়িওয়ালারা এখনো বাড়িভাড়ার বিজ্ঞাপনে 'সাউথ ইন্ডিয়ানস প্রেফারড' বা 'দক্ষিণ ভারতীয় ভাড়াটিয়া হলে ভালো হয়' উল্লেখ করে দেন!

ইনফোসিস প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে যখন হাতে টাকা কম ছিল, তখন নারায়ণ মূর্তি বিদেশের ফ্লাইটগুলোতেও ইকোনমি ক্লাসে ভ্রমণ করতেন। যখন তার প্রতিষ্ঠানের আয় ১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়, তখন থেকে এটি বাদ দেন তিনি।

নারায়ণ মূর্তির প্রশংসা করেন মার্কেটিং গুরু ও কাউন্সেলাজ-এর ম্যানেজিং পার্টনার সুহেল শেঠ বলেন, "তিনি একজন রোল মডেল এবং অনুপ্রেরণা দেওয়ার মতো একজন মানুষ। মধ্যবিত্ত ভারতীয়দের তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন যে সৎ থেকেও কিভাবে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছানো যায়। তিনি একজন স্ব-প্রতিষ্ঠিত মানুষ এবং তার নম্রতা অকৃত্রিম।

নিজ প্রতিষ্ঠান ইনফোসিস'র নিয়ম মেনেই ২০১১ সালে ৬৫ বছর বয়সে কোম্পানির দায়িত্ব থেকে অবসর নেন নারায়ণ মূর্তি। তবে ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠানকে পুনরুজ্জীবিত করতে তাকে ফিরে আসতে বলে কোম্পানি। সেবছরই তিনি তার ছেলে রোহানকে কোম্পানির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে বহাল করেন।

তবে এতগুলো বছর বাদে তখনই প্রথম সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন নারায়ণ মূর্তি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডিধারী, ছেলে রোহানকে তিনি কোম্পানির নীতির বাইরে গিয়ে চেয়ারম্যানের পদে বসিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কারণ নারায়ণ মূর্তি নিজেই বলেছিলেন, স্বজনপ্রীতি এড়াতে কোম্পানিতে কোনো আত্মীয়স্বজন, বিশেষ করে সন্তানদের নিয়োগ দেওয়া হবে না।

এর এক বছর পর ২০১৪ সালে নারায়ণ মূর্তি অবসরে চলে গেলে রোহানও কোম্পানি ত্যাগ করেন। সুহেল শেষের ভাষ্যে- নারায়ণ মূর্তি হয়তো তখন বুঝতে পেরেছিলেন যে রোহানকে ওই পদে বসানো ভুল ছিল, যদিও রোহান প্রতিভাবান বলে বোর্ড তাকে রাখতে চেয়েছিল।"

তবে নারায়ণ মূর্তি সমসাময়িক বিষয়গুলো নিয়ে সাধারণত মন্তব্য করেন না। অবশ্য ২০২০ সালে একবার তিনি ভারতের কঠোর লকডাউন নীতির সমালোচনা করেছিলেন এই বলে যে- কোভিডের চেয়ে লকডাউনে বেশি মানুষ মারা যাবে।

এই নারায়ণ মূর্তির মেয়ে অক্ষতা মূর্তির স্বামী ঋষি সুনাক ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর স্বভাবতই আগের চেয়ে বেশি লাইমলাইটে আসবেন তিনি ও সুধা। তবে তাদের কাছের মানুষেরা বলছেন, নারায়ণ-সুধা দম্পতি কখনোই গণমাধ্যমকে অতটা পাত্তা দেবেন না কিংবা নিজেদের শান্তি ভঙ্গ করতে দেবেন না।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

 

কেআর

×