ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২১ জুলাই ২০২৫, ৬ শ্রাবণ ১৪৩২

টাইপ-২ ডায়াবেটিস কি আপনার মানসিক স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি করছে? নতুন গবেষণায় মিলল অপ্রত্যাশিত তথ্য

প্রকাশিত: ২৩:১০, ১৯ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ২৩:১১, ১৯ জুলাই ২০২৫

টাইপ-২ ডায়াবেটিস কি আপনার মানসিক স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি করছে? নতুন গবেষণায় মিলল অপ্রত্যাশিত তথ্য

প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসজনিত কারণে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর পেছনে থাকে হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা হৃদ্‌রোগ সংক্রান্ত সমস্যা। তবে সম্প্রতি PLOS Medicine সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি নতুন গবেষণা জানাচ্ছে, টাইপ-২ ডায়াবেটিসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ও অনেকাংশে অবহেলিত প্রভাব রয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য।

বিশেষত ৪০ বছর বয়সের আগে যাঁরা টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন, তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যজনিত কারণে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য হারে বেশি, আর এই প্রবণতা নারীদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি। গবেষকরা বলছেন, ডায়াবেটিস চিকিৎসায় মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নকেও অন্তর্ভুক্ত করা এখন সময়ের দাবি।

কম বয়সে ডায়াবেটিস মানেই মানসিক রোগের বেশি ঝুঁকি
হংকংয়ে পরিচালিত এই গবেষণায় টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এবং আক্রান্ত নন এমন সমানসংখ্যক (প্রায় ১৫ লাখ ১৬ হাজার) মানুষকে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পর্যালোচনা চালানো হয়। গবেষকরা ২০০২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত হংকং হসপিটাল অথরিটির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেন, টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা গড়পরতায় হাসপাতালে বেশি দিন ভর্তি থাকেন।

৪০ বছরের পর ডায়াবেটিস ধরা পড়া রোগীদের হাসপাতাল-ভর্তি হওয়ার কারণ সাধারণত ছিল রক্তসঞ্চালন ও শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা। তবে যাঁদের বয়স ৪০-এর নিচে, তাঁদের মধ্যে ৩৮.৪ শতাংশ ‘হাসপাতালের শয্যা দিন’ ছিল মানসিক স্বাস্থ্যজনিত রোগের কারণে। মানসিক রোগের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়া নারীর সংখ্যা ছিল পুরুষের তুলনায় বেশি।

এই মানসিক রোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে স্কিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিজঅর্ডার এবং ডিপ্রেশন।

গবেষকরা তাঁদের প্রতিবেদনে লেখেন, "তরুণ বয়সে টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্তদের মানসিক স্বাস্থ্যজনিত শয্যাদিবসের পরিমাণ অত্যন্ত উদ্বেগজনক। স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে এখনই যথাযথ সম্পদ বরাদ্দ দিয়ে এই সমস্যার জন্য লক্ষ্যভিত্তিক কৌশল তৈরি করতে হবে।"

ডায়াবেটিস ও মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পর্ক কী?
আগের বহু গবেষণাই দেখিয়েছে, টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও মানসিক রোগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইপিডেমিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ব্রায়ানা মেজুক জানান, এই সম্পর্কটি ‘দ্বিমুখী’। অর্থাৎ, ডায়াবেটিস যেমন মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায়, তেমনি মানসিক রোগও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে ডিপ্রেশনের ঝুঁকি সাধারণ মানুষের তুলনায় দুই থেকে তিন গুণ বেশি। UTHealth Houston-এর এন্ডোক্রিনোলজিস্ট ড. আবসালন গুটিয়ারেজ বলছেন, ডায়াবেটিস ও ডিপ্রেশনের মধ্যে রয়েছে একাধিক জৈব-রসায়নিক যোগসূত্র, যার মধ্যে রয়েছে স্নায়ুতন্ত্রের অতিসক্রিয়তা এবং শরীরের প্রধান স্ট্রেস রেসপন্স সিস্টেম হাইপোথ্যালামিক-পিটুইটারি-অ্যাডরিনাল অ্যাক্সিসের ভারসাম্যহীনতা।

এগুলো একসঙ্গে করটিসল ও ক্যাটেকোলামিন নামক হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে, যা দুই রোগকেই আরও জটিল করে তোলে।

এছাড়া প্রায় ৪০ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগীই উদ্বেগ বা অ্যাংজাইটি সমস্যায় ভোগেন। আবার স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সাধারণ মানুষের তুলনায় দুই থেকে পাঁচ গুণ বেশি।

বয়স ও লিঙ্গের ভূমিকা কী?
গবেষণায় দেখা গেছে, তরুণ এবং নারীরা টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে মানসিক রোগে ভোগার আশঙ্কা বেশি থাকে। কেন এমন হয়?

ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. অ্যারন ব্রিডলাভ বলছেন, এখনো স্পষ্ট কোনো উত্তর নেই, তবে বিভিন্ন হরমোনগত, স্নায়বিক এবং সামাজিক উপাদান এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। সাধারণত মানসিক রোগের শুরু হয় অল্প বয়সে, যখন অধিকাংশ টাইপ-২ ডায়াবেটিসের সংক্রমণ ঘটে মধ্যবয়সের পরে।

নিউইয়র্কের লাইসেন্সপ্রাপ্ত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ স্টেফানি ফ্রাইটাগ জানাচ্ছেন, ৫০ শতাংশ মানসিক রোগ শুরু হয় ১৪ বছর বয়সের মধ্যে এবং ৭৪ শতাংশ ২৪ বছরের মধ্যে।

নারীদের বিষয়ে তিনি বলেন, নারীরা তুলনামূলকভাবে বেশি ডিপ্রেশন, উদ্বেগ এবং ট্রমা-সংক্রান্ত মানসিক রোগে ভোগেন। নারীদেহের হরমোনগত ও শারীরবৃত্তীয় পার্থক্য, ইনসুলিন সংবেদনশীলতা এবং হৃদরোগের ঝুঁকি সব মিলিয়ে তাদের শারীরিক অবস্থা মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে। তাছাড়া, নারীরা অনেক সময় পুরুষদের তুলনায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন।

মানসিক চাপ, ডায়াবেটিস ও আত্মপরিচয়ের সংকট
ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেকোনো বয়সেই মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। নিয়মিত ইনসুলিন নেওয়া, রক্তে চিনির মাত্রা পরিমাপ করা, ডায়েট ও ব্যায়ামের ওপর নজর রাখা এই প্রতিদিনকার ‘স্ব-পরিচালনার’ চাপ দীর্ঘমেয়াদে মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে।

মেজুক বলেন, "ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তরুণরা দীর্ঘ সময় ধরে নিজেদের অসুস্থতা সামলাতে গিয়ে মানসিকভাবে আরও দুর্বল হয়ে পড়ে।"

ব্রিডলাভের মতে, বিশের কোঠায় কেউ যখন এমন রোগে আক্রান্ত হয়, তখন সেটি আত্মপরিচয়ের গঠনের সময়কালেই বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সে তুলনায় বয়সভিত্তিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বয়স্করা সহজে মানিয়ে নিতে পারেন।

তরুণরা পারিপার্শ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে অতিমাত্রায় সচেতন থাকে। ফলে "নিজেকে ‘ভিন্ন’ বা ‘পর্যবেক্ষণের নিচে’ মনে হওয়াও মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে," বলেন মেজুক।স্ট্রেস হরমোন করটিসল ইনসুলিন সংবেদনশীলতা কমিয়ে ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণ আরও কঠিন করে তুলতে পারে।

ইনফ্লেমেশন: শরীরের অগ্নিদাহ আর মানসিক রোগের গোপন সংযোগ
ইনফ্লেমেশন বা অঙ্গ-তন্ত্রের ক্ষুদ্রতর প্রদাহ সাধারণত হৃদ্‌রোগ বা আর্থ্রাইটিসের মতো রোগে পরিচিত হলেও, গবেষকরা বলছেন এটি ডায়াবেটিস ও মানসিক রোগ উভয়েরই সম্ভাব্য কারণ।

ব্রিডলাভ জানান, ইনফ্লেমেশন মস্তিষ্কের স্নায়ুব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে ডিপ্রেশন বা উদ্বেগ বাড়িয়ে দিতে পারে। অপরদিকে, মানসিক রোগ যেমন ডিপ্রেশন ইমিউন সিস্টেমে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে ইনফ্লেমেশন ঘটাতে পারে। এতে ইনসুলিন রিসেপটরগুলোর কার্যকারিতা ব্যাহত হয়ে রক্তে চিনির মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং ডায়াবেটিস জটিল হয়ে ওঠে।

ইনসুলিনের প্রভাব কি শুধু রক্তেই সীমাবদ্ধ?
না, ইনসুলিন শুধু রক্তে চিনির মাত্রাই নিয়ন্ত্রণ করে না, এটি মস্তিষ্কে মুড নিয়ন্ত্রণকারী নিউরোট্রান্সমিটার যেমন সেরোটোনিন ও ডোপামিনের উপরও প্রভাব ফেলে। ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স হলে এসব রাসায়নিক ভারসাম্য হারায়, যা মানসিক অবসাদ সৃষ্টি করতে পারে।

ওষুধের দ্বৈত প্রভাব
ডায়াবেটিস ও মানসিক রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধগুলো কখনও কখনও একে অপরের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধ যেমন ওজন বাড়ায় এবং মেটাবলিক সমস্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের জন্ম দেয়। আবার টাইপ-২ ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইনসুলিন ওষুধ কখনও কখনও রক্তে চিনি বিপজ্জনকভাবে কমিয়ে দেয়, যার ফলে দেখা দেয় উদ্বেগ, ঝাঁকুনি, ঘাম, বিভ্রান্তি এবং হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া।


টাইপ-২ ডায়াবেটিস শুধু শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে তরুণ বয়সে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে মানসিক সমস্যার আশঙ্কা বহুগুণ বেড়ে যায়। চিকিৎসাব্যবস্থায় এ দুয়ের আন্তঃসম্পর্ক বুঝে সার্বিক সমন্বিত কৌশল গ্রহণ এখন অপরিহার্য। শুধু রক্তের চিনি নয়, মনও নজরে রাখুন এটাই হতে পারে ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনার পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।

 

 


সূত্র:https://tinyurl.com/m2yk225f

আফরোজা

×