
ছবিঃ সংগৃহীত
ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের ধানবাদ শহরের উপকণ্ঠে এক খনিতে রঙিন শাড়ি পরিহিত এক নারী শ্রমিক মাথায় কয়লার বোঝা বহন করছেন। সম্প্রতি রাজ্য সরকার একটি নতুন বিল পাস করেছে যার মাধ্যমে কয়লা থেকে শুরু করে বক্সাইটসহ অন্যান্য খনিজে খনন কর আদায় করা হবে। এতে এসব খনিজের দাম আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ভারতের দৈনন্দিন জ্বালানির চাহিদা মেটাতে কয়লার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে হয়। দেশটি সবসময় কয়লার পক্ষে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, যুক্তি দিয়েছে যে এটি তাদের জ্বালানি নিরাপত্তা এবং উন্নয়নমূলক প্রয়োজন মেটাতে অপরিহার্য।
কিন্তু বর্তমানে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা বলছেন, যদি কয়লা পুরোপুরি বাদ দেওয়া সম্ভব না-ই হয়, তাহলে অন্তত কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে কার্বন নির্গমন কমানো উচিত।
১ জুলাই অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে ভারতের প্রাক্তন অর্থ ও পরিবেশ সচিব অশোক লাভাসা বলেন, "আপনি কয়লাকে অগ্রাহ্য করে ফেলতে পারবেন না। যদি কয়লা রাজা হয়, তবে প্রশ্ন হলো সে কি সদয় রাজা হতে পারে?"
এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, আন্তর্জাতিক জলবায়ু আলোচনায় কয়লা পুরোপুরি বাদ দেওয়ার আহ্বান থাকলেও, বাস্তবতা হলো – ভারত সম্ভবত পরিচ্ছন্ন কয়লার ওপরই নির্ভর করেই শক্তি উৎপাদন চালিয়ে যাবে।
তবে প্রশ্ন হলো, বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম কার্বন নিঃসরণকারী দেশ হিসেবে ভারত কেন এখনও কয়লাকেই আঁকড়ে ধরে আছে, যেখানে তাদের আন্তর্জাতিকভাবে নির্গমন কমানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে এবং ২০৭০ সালের মধ্যে নেট-জিরো লক্ষ্যও রয়েছে?
এর একটি বড় কারণ হচ্ছে দেশটির ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা।
২০২১ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ভারতের বিদ্যুৎ চাহিদা ৯% বেড়েছে, যা পূর্বাভাসিত ৬.৬%-এর চেয়েও বেশি। ২০৩০ সালের মধ্যে এই চাহিদা দ্বিগুণ হওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
২০০০-এর দশকের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রতি বছর দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৭০%-এর বেশি এসেছে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে – এবং এই চিত্র এখনও অপরিবর্তিত।
তবে এর পরিবেশগত মূল্য অনেক বেশি।
ভারতের বিদ্যুৎ উৎপাদন একাই দেশের বার্ষিক কার্বন নিঃসরণের ৪০%-এর বেশি ঘটায় – যার মধ্যে তিন-চতুর্থাংশের বেশি কয়লা পোড়ানো থেকেই আসে।
যদিও ভারত নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে – বর্তমানে এটি দেশের মোট স্থাপিত ক্ষমতার ৪৬%। তবে সৌর বা বায়ু বিদ্যুৎ সবসময় বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে না।
দিনের বেলায়ও এই উৎসগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ওঠানামা করে, কিন্তু কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সবসময় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করে এবং সন্ধ্যা বা রাতের সময়ে চাহিদার শীর্ষে তা পূরণে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
ভারতের বিদ্যুৎ গ্রিড নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘গ্রিড ইন্ডিয়া’র পরিচালক রাজীব পোর্ল বলেন, “যতক্ষণ না আমাদের বড় পরিসরের বিদ্যুৎ সংরক্ষণ ব্যবস্থা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তাপবিদ্যুৎকেই নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানির উৎস হিসেবে নির্ভর করতে হবে।”
তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সাহায্যে গ্রিডের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হয়, যেখানে বড় ধরনের চাহিদা-সরবরাহের অসমঞ্জস্য থাকলে তা বিদ্যুৎ বিভ্রাট বা ব্ল্যাকআউটের দিকে নিয়ে যেতে পারে – সম্প্রতি স্পেনে এমনই পরিস্থিতি হয়েছিল।
এই পরিস্থিতিতে, ভারত এখন কয়লা ব্যবহার বন্ধ না করে, বরং কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকে আরও কম নিঃসরণকারী করার পথে হাঁটছে।
সম্প্রতি সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (CSE)-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ডিকার্বনাইজেশন একাই দেশের মোট গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ৩০% পর্যন্ত কমিয়ে আনতে পারে।
এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ, ভারত জাতিসংঘ জলবায়ু চুক্তির আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে নির্গমন তীব্রতা ৪৫% কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
তবে এর বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো দিনের বেলাতেও ন্যূনতম ৫৫% সক্ষমতায় চালু রাখতে হয়, কারণ সেগুলো হুট করে সন্ধ্যার শীর্ষ চাহিদার সময়ে সর্বোচ্চ উৎপাদনে ফিরে যেতে পারে না।
ভারতের বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রক কমিশনের সদস্য রমেশ ভীরাভল্লি বলেন, “প্রযুক্তিগতভাবে কেন্দ্রগুলোকে আরও দক্ষ করে তাদের নিম্ন সক্ষমতায় চালু রাখার ব্যবস্থা করা সম্ভব।”
আরেকটি পন্থা হলো কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি ব্যবহার করে বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণ আটকে রাখা।
তবে বিশ্ব রিসোর্স ইনস্টিটিউটের মতে, এই প্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী মাত্র ০.১% কার্বন নিঃসরণ আটকে রাখতে সক্ষম হয়েছে এখন পর্যন্ত।
তৃতীয় আরেকটি উপায় হলো কৃষি বর্জ্য ব্যবহার করে কয়লার বিকল্প জ্বালানি হিসেবে তা পোড়ানো।
CSE-এর কর্মসূচি ব্যবস্থাপক পার্থ কুমার বলেন, “এতে করে দিল্লি এবং আশেপাশের এলাকায় কয়লার ব্যবহার অনেক কমানো গেছে। কিন্তু দেশের অন্য অংশে এটি এখনও সেভাবে বাস্তবায়ন হয়নি, যদিও বিধিমালায় তা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গমন কমাতে হলে একটি বড় মাত্রার কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে, যা বিশাল ব্যয়ের সঙ্গে জড়িত।
কিন্তু সেই ব্যয়ের পরিমাণ কত হবে এবং কে এই ব্যয় বহন করবে – সে প্রশ্নের এখনো সহজ কোনো উত্তর নেই।
সূত্রঃ বিবিসি
নোভা