
ঘাড়ে টান ধরে থাকা বা ব্যথা নিচে নেমে হাতে ছড়িয়ে পড়া এই অভিজ্ঞতা অনেকেরই পরিচিত। এমনকি প্রায় প্রতিটি পরিবারেই এমন একজন সদস্য আছেন, যিনি এ সমস্যায় ভুগছেন। এটি শুধু একটি সাধারণ ব্যথা নয়, বরং অনেক সময় এটি হয়ে দাঁড়ায় ঘাড়ের স্নায়ুবাহিত সমস্যার লক্ষণ। চিকিৎসাবিজ্ঞানে একে বলা হয় সার্ভাইক্যাল ব্র্যাকিয়াল র্যাডিকুলোপ্যাথি।
কেন হয় ঘাড় থেকে হাতে ব্যথা?
ঘাড় থেকে যে স্নায়ু বের হয়, তা গিয়ে হাত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এই স্নায়ুগুলোর একটি জটিল গঠন রয়েছে, যাকে বলে ব্র্যাকিয়াল প্লেক্সাস। যখন ঘাড়ের কোথাও এই স্নায়ুতে চাপ পড়ে বা ‘কমপ্রেশন’ হয়, তখন সেই ব্যথা শুধু ঘাড়ে সীমাবদ্ধ না থেকে নিচে হাত পর্যন্ত নেমে যায়।
চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, অনেক রোগী বলেন, “আমার তো ব্যথা হাতে, আপনি ঘাড়ে কেন চিকিৎসা করছেন?” বিশেষ করে অনেক সাধারণ মানুষ ঘাড়ের চিকিৎসা নিতে চান না যদি ব্যথা সরাসরি হাতে না থাকে। অথচ আসল ব্যথার মূল থাকে ঘাড়ে, এবং সেটিই ধীরে ধীরে স্নায়ুর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে হাতে, আঙুলে বা কাঁধে।
কোথায় চাপ পড়ে?
ঘাড়ের মেরুদণ্ডে বিভিন্ন স্তরে এই কমপ্রেশন হতে পারে। সাধারণত সি-৪, সি-৫, সি-৬, সি-৭, সি-৮ পর্যন্ত স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হলে হাতের বিভিন্ন অংশে ব্যথা, ঝিনঝিনি বা দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে টি-১ বা টি-৩ স্তর পর্যন্ত সমস্যা বিস্তৃত হয়।
সম্ভাব্য কারণ কী?
ঘাড় থেকে হাতে ব্যথা হবার প্রধান কারণ হলো নার্ভ কমপ্রেশন, যা সাধারণত হয় নিচের যেকোনো একটি বা একাধিক কারণে:ডিস্ক স্লিপ বা ডিস্ক ডেজেনারেশন,খারাপ দেহভঙ্গি (ব্যাড পোস্টার),সঠিক উচ্চতার বালিশ ব্যবহার না করা,ঘুমানোর সময় ঘাড়ে চাপ পড়া,দীর্ঘসময় ডেস্কে বসে কাজ করা,মোবাইল, ল্যাপটপ বা কম্পিউটারে নিচু হয়ে দেখা,ফোন কানে নিয়ে ঘাড়ে চেপে কথা বলা।
এই সবকিছুই ঘাড়ে অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি করে, যা থেকে স্নায়ু আক্রান্ত হয় এবং ব্যথা হাতে পৌঁছায়।
উপসর্গ কী হতে পারে?
যদি স্নায়ুতে চাপ পড়ে, তাহলে নিম্নলিখিত উপসর্গ দেখা দিতে পারে:হাতে তীব্র ব্যথা,আঙুলে ঝিনঝিনি বা টিংলিং,বাহু বা হাত নাড়াতে সমস্যা,মাসলের শক্তি কমে যাওয়া,কোনো বস্তু ধরতে গেলে হাত কাঁপা বা দুর্বলতা,কিছু ক্ষেত্রে স্পর্শে অসাড়তা বা অবশ ভাব।
অনেক সময় রোগীরা বুঝতেই পারেন না, যে তাদের ব্যথার উৎস ঘাড়ে ফলে তারা শুধু হাতের চিকিৎসা করাতে গিয়ে সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলেন।
করণীয় ও চিকিৎসা
১. সঠিক ভঙ্গি মেনে চলুন: ডেস্কে বা মোবাইলে কাজ করার সময় ঘাড় সোজা রাখুন, মনিটর চোখের সমান উচ্চতায় রাখুন।
২. বালিশে পরিবর্তন আনুন: মাঝারি উচ্চতার বালিশ ব্যবহার করুন যাতে ঘাড়ে চাপ না পড়ে।
৩. হালকা স্ট্রেচিং ব্যায়াম করুন: ঘাড় ও কাঁধের জন্য বিশেষ স্ট্রেচিং করতে পারেন, তবে ব্যথা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নয়।
৪. ব্যথা হলে বিশ্রাম নিন: প্রাথমিক অবস্থায় বিশ্রাম ও গরম সেঁক কার্যকর হতে পারে।
৫. চিকিৎসকের পরামর্শ নিন: নিয়মিত ও তীব্র ব্যথা হলে নিউরো-অর্থোপেডিক বা স্পাইন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন।
ঘাড় থেকে হাতে ব্যথা হবার বিষয়টি যতটা সাধারণ মনে হয়, ততটাই জটিল এর কারণ ও প্রভাব। একে অবহেলা করলে তা দীর্ঘমেয়াদে স্নায়ুর স্থায়ী ক্ষতি বা হাতের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তাই উপসর্গ শুরু হলে দ্রুত সচেতন হোন, জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনুন এবং প্রয়োজনে চিকিৎসা নিন। ব্যথামুক্ত জীবন শুধু স্বস্তিদায়ক নয়, বরং একটি সচল ও কর্মক্ষম জীবনের পূর্বশর্ত।
সূত্র:https://tinyurl.com/34kf79f8
আফরোজা