ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

গেঁটে বাতের মূল কারণ ইউরিক অ্যাসিড! জানুন ঝুঁকি, লক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের উপায়

প্রকাশিত: ০৮:২৬, ১২ জুন ২০২৫; আপডেট: ০৮:২৬, ১২ জুন ২০২৫

গেঁটে বাতের মূল কারণ ইউরিক অ্যাসিড! জানুন ঝুঁকি, লক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের উপায়

গেঁটে বাত একটি বেদনাদায়ক প্রদাহজনিত বাতজাতীয় রোগ, যা হঠাৎ করে গাঁটে ব্যথা, ফোলা, লালভাব ও স্পর্শে অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা তৈরি করে। এটি শরীরের যেকোনো গাঁটে হতে পারে, তবে সাধারণত পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে বেশি দেখা যায়।এই ব্যথা এমনভাবে শুরু হয় যেন মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যায় তীব্র যন্ত্রণায়। অনেক সময় হালকা চাদরটিও যেন অসহনীয় মনে হয়।

গেঁটে বাতের উপসর্গগুলো মাঝে মাঝে হঠাৎ দেখা দেয় এবং কিছুদিন পর আবার নিঃশব্দে মিলিয়ে যায়। তবে বারবার ফিরে আসে বলে এটিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।চিকিৎসা সাধারণত লক্ষণ নিয়ন্ত্রণ ও ভবিষ্যতের অ্যাটাক প্রতিরোধে কেন্দ্রিক থাকে। তবে আগে থেকে সতর্ক হলে এই যন্ত্রণাদায়ক রোগ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

ইউরিক অ্যাসিডই গেঁটে বাতের মূল কারণ
গেঁটে বাত মূলত ইউরিক অ্যাসিড অতিরিক্ত হলে দেখা দেয়। শরীরে যখন ইউরিক অ্যাসিড মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায়, তখন তা গাঁটে স্ফটিক (ক্রিস্টাল) আকারে জমা হয়। এই স্ফটিকগুলোই গাঁটে প্রদাহ ও ব্যথার সৃষ্টি করে।
ইউরিক অ্যাসিড শরীরের কোষে থাকা 'পিউরিন' নামক যৌগ ভাঙার ফলে তৈরি হয়। সাধারণত এটি রক্তের মাধ্যমে কিডনিতে পৌঁছে প্রস্রাবের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়। কিন্তু যখন শরীর খুব বেশি ইউরিক অ্যাসিড তৈরি করে অথবা কিডনি ঠিকভাবে তা বের করতে না পারে, তখন তা জমে গিয়ে গেঁটে বাতের জন্ম দেয়।

একটি গবেষণা অনুযায়ী, যাদের রক্তে ইউরিক অ্যাসিড বেশি, তাদের মধ্যে ৩৬ শতাংশের গেঁটে বাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

কারা বেশি ঝুঁকিতে?
পুরুষদের ক্ষেত্রে গেঁটে বাত বেশি দেখা যায়, বিশেষ করে ৩০ বছরের পর থেকে। মহিলাদের মধ্যে মেনোপজের পরে এই ঝুঁকি বাড়ে। এছাড়া যারা অতিরিক্ত ওজনের, মেটাবলিক সিনড্রোমে ভোগেন, যাদের কিডনি ঠিকমতো কাজ করছে না কিংবা যাদের পরিবারে এই রোগের ইতিহাস রয়েছে, তাদের মধ্যে গেঁটে বাতের প্রবণতা বেশি।

অতিরিক্ত মদ্যপান, পিউরিনসমৃদ্ধ খাবার (যেমন: লাল মাংস, অর্গান মিট, সামুদ্রিক মাছ) খাওয়ার অভ্যাস এবং কিছু নির্দিষ্ট ডায়ুরেটিক ওষুধও ইউরিক অ্যাসিড বাড়িয়ে গেঁটে বাতের সম্ভাবনা তৈরি করে।

গেঁটে বাতের উপসর্গ
গেঁটে বাত সাধারণত হঠাৎ করে একটি গাঁটে শুরু হয়। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির গাঁট। তবে হাঁটু, গোড়ালি, কবজি, হাত ও কনুইতেও এই রোগ হতে পারে।

প্রধান উপসর্গগুলো হলো:তীব্র ব্যথা, যা সামান্য ছোঁয়াতেও বাড়ে,গাঁটে ফোলা ও লালভাব,অতিরিক্ত উষ্ণতা বা জ্বালাভাব,শক্তভাব বা চলাফেরায় বাধা।

দীর্ঘস্থায়ী ক্ষেত্রে গাঁটের নিচে ইউরিক অ্যাসিড স্ফটিকের গাঁট (টফি) দেখা যেতে পারে।গেঁটে বাতের অ্যাটাক সাধারণত ১২-২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তীব্র রূপ নেয়। এরপর ধীরে ধীরে উপসর্গ হ্রাস পায় এবং ১-২ সপ্তাহের মধ্যে সেরে যায়। তবে পরবর্তী অ্যাটাক মাস বা বছর পরেও ফিরে আসতে পারে।

কীভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়?
গেঁটে বাত নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসক সাধারণত রোগীর উপসর্গ, পারিবারিক ইতিহাস ও শারীরিক পরীক্ষা করেন। প্রয়োজনে রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়, তবে শুধুমাত্র এই পরীক্ষার উপর নির্ভর করা যায় না।

সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা হলো জয়েন্ট অ্যাসপিরেশন, যেখানে আক্রান্ত গাঁট থেকে তরল বের করে ল্যাবে পরীক্ষা করে ইউরিক অ্যাসিড স্ফটিক আছে কিনা দেখা হয়। এছাড়া আল্ট্রাসাউন্ড বা ডুয়াল-এনার্জি সিটি স্ক্যানের মাধ্যমেও গাঁটে জমা স্ফটিক চিহ্নিত করা যায়।

চিকিৎসা ও প্রতিকার
গেঁটে বাতের চিকিৎসা মূলত দুটি ধাপে হয়: অ্যাটাক চলাকালে ব্যথা ও প্রদাহ কমানো এবং ভবিষ্যতের অ্যাটাক প্রতিরোধ করা।

চলমান অ্যাটাকের সময় নিচের ওষুধগুলো ব্যবহৃত হয়:

এনএসএআইডি (যেমন আইবুপ্রোফেন),কর্টিকোস্টেরয়েড,কোলচিসিন

ভবিষ্যতের অ্যাটাক রোধে ইউরিক অ্যাসিড কমানোর ওষুধও ব্যবহার করা হয়, যেমন:

অ্যালোপিউরিনল,ফেবুক্সোস্ট্যাট,প্রোবেনেসিড,ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া পেগলোটিকেজ

ডায়েট ও লাইফস্টাইলে যেসব পরিবর্তন জরুরি
ওষুধের পাশাপাশি জীবনযাপনেও কিছু পরিবর্তন আনলে গেঁটে বাত অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যেমন:

পিউরিনসমৃদ্ধ খাবার যেমন লাল মাংস, লিভার, সার্ডিন, অ্যাঙ্কোভি এড়িয়ে চলা,অ্যালকোহল ও মিষ্টি পানীয় কমানো,প্রচুর পানি পান করা,কম চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত খাবার খাওয়া,চেরি ও চেরি জুস খাওয়ার অভ্যাস করা (গবেষণায় দেখা গেছে, এটি গেঁটে বাতের ঝুঁকি ৩৫–৪৫ শতাংশ পর্যন্ত কমায়),ওজন কমানো


গেঁটে বাত আজীবন চলতে পারে এমন এক রোগ, তবে সময়মতো সঠিক চিকিৎসা ও জীবনযাপন পরিবর্তনের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। যারা ইউরিক অ্যাসিডের সমস্যায় ভুগছেন, তাদের উচিত সময়মতো চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। কারণ অবহেলা করলে শুধু গাঁট নয়, কিডনি পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই ইউরিক অ্যাসিডকে হালকাভাবে না নিয়ে, সচেতন হোন এখনই।

 

 


সূত্র:https://tinyurl.com/4dzxyz3c

আফরোজা

×