বর্ষায় স্বাস্থ্য সচেতনতা ও সতর্কতা
গ্রীষ্মের প্রখর তাপদাহের পর প্রকৃতিতে শান্তির বার্তা নিয়ে আসে বর্ষাকাল। বছরের এই সময় প্রকৃতিতে চলে রোদ-বৃষ্টির খেলা। ফলে আবহাওয়ায় যে তারতম্য ঘটে তার সাথে শরীরকে প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে বেগ পেতে হয়। বর্ষায় পথ-ঘাট থাকে কর্দমাক্ত, বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানিতে হয় মশার বসতি, ময়লা পানিতে সয়লাব থাকে চারদিক। সর্দি, কাশি, জ্বর ইত্যাদি সাধারণ রোগের পাশাপাশি প্রতিবছর ডেঙ্গুর প্রকোপও বাড়ে এসময়।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, বর্ষাকালে আবহাওয়া স্যাঁতস্যাঁতে থাকায় কিছু রোগের প্রাদূর্ভাব বেড়ে যায়। তবে, একটু সচেতন থাকলে এসব রোগ থেকে নিজেকে ও পরিবারের অন্যদেরকে রক্ষা করা সম্ভব।
বর্ষায় সবুজ-শ্যামল প্রকৃতি দেখে মন ভরে গেলেও বাড়ির ছাদের কার্ণিশে জমে থাকা পানিতে বা ফেলে রাখা গাড়ির টায়ারে জমা পানিতে ডিম পারে এডিস মশা বা ডেঙ্গু মশা। বিশেষ করে, গতবছর দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
স্বাস্থ্যবিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৩ সালে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয় এবং মারা যায় এক হাজার ৭০৫ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২৪ সালে জানুয়ারী থেকে এখন পর্যন্ত মোট আক্রান্ত হয়েছে এক হাজার ৯৩ জন এবং মারা গিয়েছে ১৫ জন। তাই এ সময় ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে নিজেকে ও পরিবারের অন্যদের বাঁচতে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
বর্ষাকালে প্রায়শই দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করে। এসময় পানিবাহিত রোগের প্রকোপও বৃদ্ধি পায়। এসব রোগ দূষিত পানি ও জীবাণুযুক্ত খাবার থেকে ছড়াতে পারে। কলেরা, ডায়ারিয়া, আমাশয়, জন্ডিস, টাইফয়েড জ্বর ইত্যাদি বর্ষা মৌসুমেই বেশি দেখা দেয়। তাই পুরানো বাসি খাবার এবং স্ট্রিট ফুড (যেমন- চটপটি, ফুচকা, ভেলপুরি ইত্যাদি) পরিহার করা উচিত ও সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা উচিত।
অন্যদিকে, প্রচন্ড জ্বর ও জ্বরের সাথে মাথা ব্যথা, শরীর ব্যথা, খুসখুসে কাশি, দূর্বলতা, বমি ভাব ইত্যাদি লক্ষণ থাকলে সেটি ভাইরাস জ্বর হিসেবে ধরে নিতে হবে, যা বর্ষায় প্রায় সব বয়সী মানুষেরই হয়ে থাকে। এ জ্বরে শরীর এতই দূর্বল হয় যে দাঁড়িয়ে থাকাও কষ্টকর মনে হয়। এ জ্বর অত্যন্ত ছোঁয়াচে এবং বাড়ির একজনের হলে অন্য সদস্যদেরও তা হতে পারে। বিশেষ করে, ছোট শিশুদের ভাইরাস জ্বর বেশি হয়। এসময় স্যালাইন ও পানি জাতীয় খাবার ইত্যাদি বেশি করে খেলে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব।
বর্ষাকালে শিশু ও বয়স্কদের দিকে একটু বেশি খেয়াল রাখতে হবে। বেশিরভাগ শিশুরাই এসময় সর্দি জ্বরে ভোগে। সমস্যা জটিল হলে হতে পারে নিউমোনিয়াও। এছাড়া, প্রয়োজন ব্যতীত শিশু ও বৃদ্ধদের বাড়ি থেকে বের হতে না দেওয়াই ভালো। কেননা বর্তমানে বৃষ্টির সাথে ঝড় ও বজ্রপাতের প্রকোপও বাড়ছে।
বর্ষাকালীন রোগবালাই থেকে সুস্থ থাকার সবচেয়ে কার্যকরী সমাধান হলো সচেতনতা ও সতর্কতা। বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকলে বাড়ির বাইরে গেলে ছাতা সাথে রাখা উচিৎ। বর্ষাকালে সর্দি কাশি বা জ্বর বেশি হয়। সাধারণত সর্দি কাশি বা ভাইরাস জ্বর দুই-এক দিনের মধ্যে ভালো হয়। তবে জ্বর বেশিদিন স্থায়ী হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এছাড়া, বর্ষায় চর্মরোগের প্রকোপও দেখা দেয়। এর থেকে বাঁচতে অবশ্যই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে, বিশেষ করে হাত-পায়ের নখ পরিষ্কার রাখা জরুরি।
যাদের অ্যাজমা বা সাইনাসের সমস্যা আছে, তাদের একটু বেশি সতর্ক থাকতে হবে। শরীর ভেজা রাখা যাবে না। স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে থাকা যাবে না, আলো বাতাস আছে এমন ঘরে থাকতে হবে। এসময় শিশুদের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ ঠান্ডায় শিশুদের টনসিলের ব্যথা এমনকি নিউমোনিয়াও হতে পারে। শিশুদের ডায়রিয়া হলে বারবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে। বর্ষাকালে বাড়িতে খাবার স্যালাইন, প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধ সবসময় হাতের নাগালেই রাখুন।
ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে ফুলের টবে জমা পানি, পরিত্যাক্ত টায়ারে জমা পানি, ছাদের কার্নিশে জমা পানি ফেলে দিয়ে সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। এছাড়া দিনে ও রাতে মশারি ব্যবহার করুন।
এছাড়া বর্ষায় সাপ, পোকামাকড়, জোঁকের উপদ্রব বেশি হয়। সেকারনে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
অসুস্থ হলে নিজের বুঝ মতো বা অন্যদের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ না খেয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ। নিজে সুস্থ থাকতে ও পরিবারকে সুস্থ্য রাখতে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
লেখকঃ
ডা: কে এফ এম আয়াজ
সিনিয়র কনসালটেন্ট
ইন্টারনাল মেডিসিন ডিপার্টমেন্ট
এভারকেয়ার হসপিটাল ঢাকা
এবি