
মানসিক সমস্যা
পরিসংখ্যান মতে : ব্রাজিলে স্কুল পড়ুয়া শিশুদের মধ্যে মানসিক সমস্যার প্রায় প্রকট ১২.৭% যদিও বাংলাদেশে এর কোন পরিসংখ্যান নেই- তবে ধারণা করা হয় এর চেয়েও বেশি হবে। ডঐঙ-এর মতে প্রায় ৫০% বয়স্ক মানসিক রোগের উৎপত্তি শিশু-কিশোর বয়সে।
অতএব মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে হলে শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ নজর, গুরুত্ব ও যত্ন দিতে হবে এবং খুঁজে বের করতে হবে ঝুঁকিপূূর্ণ শিশুদের।
শিশুরা নিজেদের সমস্যা বুঝতে পারে না, বলতে পারে না। শিশুরা বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন রকম আচরণ করতে পারে কোন আচরণ-কোন বয়সে স্বাভাবিক ও কোনটি অস্বাভাবিক। এগুলো অনেক বাবা-মা আত্মীয়স্বজনরা বুঝতে পারে না। যেমন- ধরুন কনডাক্ট ডিজঅর্ডারের শিশু-কিশোরদের বেলায় অনেক মুরব্বিরা বলে থাকেন বয়স হলে এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এ কথা ঠিক না।
আরও একটি ঘটনা বলছি- সামিনার বয়স ১৩ বছর কিছুদিন আগে বিয়েও হয়েছে, বিয়ের চার দিন পর স্বামী তাকে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। কারণ মেয়েটি বিছানায় প্রস্রাব করে। এই লজ্জা, অপমান সহ্য করতে না পেরে মেয়েটি এখন খাওয়া-দাওয়া, ঘুম বন্ধ করে দিয়ে ধীরে ধীরে বিষণ্ণতার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
শিশু-কিশোরদের কয়েকটি বিশেষ সমস্যা
১. বিছানায় প্রস্রাব করা চার বছর বয়সের পর স্বাভাবিক না।
২. কাপড়ে মল ত্যাগ করা (চার বছর বয়সের পরে)।
৩. খাদ্য গ্রহণে শিশুর অনিচ্ছা।
৪. ঘুমের সমস্যা।
৫. স্কুল পালানো, স্কুল ভীতি।
৬. পড়াশোনায় অমনোযোগী
৭. হিস্টেরিয়া
৮. সুচিবাই
৯. কনডাক্ট ডিজঅর্ডার বা আচরণের ত্রুটি- এই শিশুগুলো সাধারণত অবাধ্য থাকে, কারও কথা শোনে না, মিথ্যা কথা বলে।
১০. মৃগী রোগী।
১১. মাথাব্যথা
১২. অহেতুক ভয়ভীতি।
১৩. হঠাৎ খেপে যাওয়া, রেগে যাওয়া, জিনিসপত্র ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলা।
১৪. অটিজম।
১৫. বিষণ্ণতা
১৬. বুদ্ধি প্রতিবন্ধী
শিশু-কিশোরদের সমস্যাগুলো বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেতে পারে-
১. একটি ৭-৮ বছরের ছেলে কেবল ভয় পায় আর কান্না করে। আত্মীয়স্বজনরা প্রথমেই ফকির কবিরাজের কাছে নিয়ে গেল কিন্তু কোন উন্নতি না দেখে ৬ মাস ভোগান্তির পর চিকিৎসা শুরু হলো। এখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ জীবন-যাপন করছে।
২. একটি ১০-১২ বছরের মেয়ের মাথাব্যথা। এই ডাক্তার ওই ডাক্তার করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট নরমাল। কিন্তু মাথা ব্যথা কমছে না। এসব রোগীগুলোর ক্ষেত্রে হয় সমস্যা তার নিজের ভেতরে অথবা ঘরের ভেতরে অথবা বাইরের পরিবেশের উপর এই ব্যাপারগুলো ক্ষতিয়ে দেখা উচিত।
৩. সুমনের বয়স ১০ বছর। বাবা-মার কথা শোনে না কেবল বাইরে বাইরে ঘুরে-বেড়ায় আর টাকা চায়। মিথ্যা কথা বলে চুরি করে। এটা যে মানসিক সমস্যা তা তার বাপ-মা মানতে নারাজ।
৪. স্কুলপড়ুয়া মেয়ে সুমী কেবল হাত ধোয়, শুধু ময়লার ঘৃণা কিছুতেই মাথা থেকে ময়লার ঘৃণা যায় না। হাত একদম সাদা করে ফেলছে।
৫. সাথী প্রেম করে পাড়ার একটি ছেলের সঙ্গে। জানাজানি হওয়ার পর বাবা-মা কিছুতেই মানতে নারাজ। এই ঘটনার পর মেয়েটি বারবার ফিট হয়ে যায়। তারপর চলে হুজুর, তাবিজ কবজওয়ালাদের চিকিৎসা।
৬. মৃগী রোগীকে অনেক জায়গায় আলগা দোষ, বাতাস লাগছে, জিন-ভূতের ব্যাপার বলে কবিরাজরা দিনের পর দিন চিকিৎসা করে যাচ্ছে। অনেক ভোগান্তির পর নাকে মুখে পোড়ার দাগ ও ব্রেনের সমস্যা নিয়ে আসে ডাক্তারের কাছে।
কি কি সামাজিক ও পারিবারিক কুসংস্কার জড়িত
কুসংস্কার শুরু হয় রোগী, ঘর ও সমাজ থেকে।
১. মানসিক হাসপাতাল ও ডাক্তারের কাছে গেলে কেউ দেখে ফেলল কি না?
২. আমি কি পাগল হয়ে গেছি নাকি আমাকে পাগলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে?
৩. আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে অনেক শঙ্কা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এমনকি অস্বীকার করার পাঁয়তারা যে তাদের পরিবারে একজন মানসিক রোগী আছে।
৪. চিকিৎসার প্রতি অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা।
৫. স্কুল ভীতির বাঁচ্চাগুলো দাদা-দাদিরা বলে থাকে আজ স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই, পরেরদিন যাবে। এভাবেই বাঁচ্চাগুলো প্রশ্রয় পেয়ে বসে আর কিছুতেই স্কুলে পাঠানো যায় না।
৬. মৃগী রোগীর লেখাপড়া, বিয়ে, সংসার নিয়ে পরিবার থেকে শুরু করে সমাজে, স্কুলে ও পাড়ায় সর্বত্র থাকে কুসংস্কার যে, এদের পড়াশোনা হবে না, বিয়ে হবে না ও সংসার হবে না।
৭. এর সঙ্গে যোগ হয় ফকির, কবিরাজ, তাবিজ-কবজওয়ালাদের দৌরাত্ম্য যেহেতু রোগীগুলো তাদের কাছেই প্রথমে ধরনা দেয়। আর এই সুযোগে তাদের বিভিন্ন আলগা দোষ, জিন-ভূতের ব্যাপার এই রকম হাজারো ব্যাখ্যা শুনে রোগীর আত্মীয়স্বজনরা মুগ্ধ হয়ে যায়। আর ওখান থেকে বের হয়ে আসতে পারে না।
৮. সর্বোপরি মানসিক রোগীর চিকিৎসা নেয়ার ব্যাপারে থাকে অনেক নেতিবাচক (নেগেটিভ) ধারণা। ওষুধ খেলে ভাল হবে কি না, দীর্ঘদিন ওষুধ খেলে কোন সমস্যা হবে কিনা ইত্যাদি।
পরিত্রাণের উপায়
১. আমাদের বাস্তবতার ভিত্তিতে চাহিদা ও সামর্থ্যরে কথা বিবেচনা করে কর্মপরিকল্পনাগুলোকে ছোট ছোট করে ভাগ করে নেয়া উচিত।
কারণ হঠাৎ করে খুব একটা পরিবর্তন আনতে পারব বলে আমি বলছি না। কিন্তু আমাদের দক্ষ জনবল নেই, আমাদের দেশের মানুষ অশিক্ষিত, কুশিক্ষিত এই দোহাই দিয়ে আবার বসে থাকলেও চলবে না, এর মধ্যে দিয়েই এগোতে হবে।
২. ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের ব্যাপারে বিশেষ নজর দেয়া।
৩. বিভিন্ন মিডিয়াতে যেমন পত্রিকা, নাটক, সিনেমাতে এসব রোগ ও পারিবারিক সমস্যা নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা-পর্যালোচনা করা।
৪. যেহেতু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে দশটি জাতির বোঝা হিসেবে চিহ্নিত রোগের মধ্যে মানসিক রোগ চারটি। অতএব এই খাতকে অগ্রাধিকার দেয়া।
৫. এই খাতে সরকারের বেশি বাজেট রাখা।
৬. সরকারের পরিকল্পনা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হওয়া।
৭. শিশুদের শিক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া উচিত।
৮. সর্বোপরি শিশু-কিশোরদের নিয়ে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কাজ করে যেমন বাবা-মা, শিক্ষক, ইমাম, সমাজ সেবক, এনজিও কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে জ্ঞান দেয়া।
৯. টেলিভিশনে মারামারি রক্তাক্ত লাশের ছবি কম দেখানো উচিত।
১০. শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ভাল করার জন্য, বুদ্ধি বাড়ানোর জন্য, ভাল ব্যবহার শেখানোর জন্য সবার আগেই পিতা-মাতা ও পরিবারের লোকদের পরিবর্তন হওয়া উচিত। আমাদের জানতে হবে শিশুর সঙ্গে কিভাবে আচরণ করতে হয়, কিভাবে কথা বলতে হয়, কিভাবে খাওয়াতে হয় এবং কিভাবে প্রশংসা করতে হয়।
লেখক : এফসিপিএস (সাই)
সহযোগী অধ্যাপক
টেনশন, মাথাব্যথা, ব্রেন সমস্যা বিশেষজ্ঞ
চেম্বার : মডার্ন হাসপাতাল, ধানমণ্ডি, ঢাকা।