
টনসিল বিষয়ে সাধারণ মানুষের ভিতর এক ধরনের ভীতি কাজ করে যেমন, এখান থেকে ভবিষ্যতে ক্যান্সার হবে। আসলে এই ধারণা সম্পূর্ণ অবাস্তব। ক্যান্সার হয় ধূমপান থেকে। গলায় টনসিলে ক্যান্সার নিয়ে অনেকেই খুব দুশ্চিন্তায় ভোগেন। টনসিলাইটিস থেকে বাতজ্বর হতে পারে কিন্তু সম্ভাবনাও খুব কম। বাচ্চার হাত পা ব্যথা হলেই সেটা বাতজ্বর নয়, বাচ্চাদের হাড় বৃদ্ধির সময় হাত পায়ে ব্যথা হয় এটাকে এৎড়রিহম চধরহ বলা হয়।
সামান্য গলা ব্যথা হলেই টনসিলাইটিস না হতেও পারে। টনসিলের ইনফেরশন আসলে খুবই কষ্টকর। রোগীর গলার দুই পাশে মারাত্মক ব্যথা হয়, তীব্র জ্বর থাকে। রোগী কিছু খেতে পারে না, এমনকি নিজের লালাটুকুও গিলতে পারে না। শয্যাশায়ী হয়ে স্যালাইন/ইনজেকশনের মাধ্যমে চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। গলার ভিতর দেখলে টনসিল দুটো লাল হয়ে ফুলে যায় এবং সাদা বিন্দু বিন্দু দাগ দেখা যায়। ৫/৭ দিন পর্যন্ত রোগীর কাজকর্ম/স্থল কলেজ বন্ধ রাখতে হয়। তবে সব সময় টনসিলাইটিস এত তীব্র নাও পারে। এরকম টনসিলাইটিস যদি বছরে ৫/৭ বার হয় বিগত ২/৩ বছর ধরে তাহলে টনসিল অপারেশন করা হয়।
অনেক সময় একদিকের/দুইদিকের টনসিলের নিচে পুজ জমা হয়। এটি খুবই কষ্টকর। একে বলা হয় পেরিটনসিলার এ্যাবসেস, এরকম ক্ষেত্রে একবার হলেই অপারেশন করা হয় (এক থেকে দেড় মাস পর)।
অনেক রোগীর গলায় সবসময় মৃদু ইনফেকশন টনসিলের মধ্যে থেকে যায়, ফলে টনসিল দুটি সবসময় ফোলা থাকে, গলার বাইরের দুই পাশে লিম্পয়েড গ্রন্থি ফোলা থাকে এবং টনসিলের ওপর চাপ দিলে ভিতর থেকে সাদা এক প্রকার পদার্থ বেরিয়ে আসে। এক্ষেত্রে রোগীর সমস্যা তীব্র হলে অপারেশন করা হয়।
বাচ্চাদের (৪-১০ বছর) ক্ষেত্রে বার বার সর্দি কাশি হলে গলার ভিতর টনসিল এবং এ্যাডিনয়েড ফুলে যায়। সাধারণত একটু ফুলে গেলে সেটা নিয়ে বিচলিত হবার কারণ নেই কিন্তু যদি সে কারণে বাচ্চার খাবার খেতে, রাতে ঘুমের ভিতর শ্বাস নিতে সমস্যা হয় তাহলে এটা বাচ্চার অনেক ক্ষতি করতে পারে। এক্ষেত্রে দ্রুত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে, প্রয়োজন হলে অপারেশন করিয়ে নেয়া উচিত। বর্তমানে এটিই টনসিল অপারেশনের সবচেয়ে বড় কারণ। এক্ষেত্রে টনসিল অপারেশনের সঙ্গে একবারে অফবহড়রফবপঃড়সু করা হয়।
কখনও কখনও অস্বাভাবিকভাবে একদিকের টনসিল বড় হয়ে গেলে, টনসিলের গায়ে সন্দেহজনক ক্ষত দেখা গেলে অপারেশন করে ঐরংঃড়ঢ়ধঃযড়ষড়মু পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যান্সার আছে কিনা নিশ্চিত করা হয়।
যদি কোন বাচ্চার সুস্পষ্টভাবে বাতজ্বরের লক্ষণ থাকে এবং টনসিলের ইনফেকশন থাকে তাহলে অবশ্যই টনসিল অপারেশন করা প্রয়োজন।
যাদের এলার্জির সমস্যা থাকে, তাদের সামান্য ঠা-া বা ধুলাবালিতে গলা খুশখুশ করে, সামান্য ব্যথা হয়, আবার গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করলে ব্যথা চলে যায়। এক্ষেত্রে এটিকে চযধৎুহমরঃরং বলা হয়। গলার ভিতর দেখলে জিহ্বার গোড়ার উল্টাদিকে লালচে দানা দানা দেখা যায়। এক্ষেত্রে টনসিল অপারেশন করে রোগীর কোন লাভ হয় না। সতর্কতার সঙ্গে চললে সমস্যার হাত থেকে মুক্ত থাকা যায়।
আর একটি কথা হলো তীব্র ব্যথা/জ্বর/কাশি/সর্দি এরকম অবস্থায় টনসিল অপারেশন করা হয় না। সেক্ষেত্রে ১/২ মাস পর অপারেশন করা হয়। ইতোমধ্যে ওষুধ দিয়ে রোগী সুস্থ হয়। টনসিল অপারেশনের সময় রোগীকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করা হয়, বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে মুখ হাঁ করিয়ে মুখের ভিতর দিয়ে টনসিল দুটি অপারেশন করে বের করে আনা হয়। সাধারণ বিশেষ ধারণের সিজার, ফোরসোপস, ইত্যাদি যন্ত্রপাতির মাধ্যমে অপারেশন করা হয় তবে বর্তমানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিও ব্যবহার করা যায়। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ইরঢ়ড়ষধৎ ঈধঁৎঃবৎু ঝুংঃবস এছাড়াও ঈড়নষধঃরড়হ, খঅঝঊজ, ঐধৎসড়হরপ ঝপধষঢ়বষ, ইত্যাদি প্রযুক্তির ব্যবহার করা যায়। তবে মূলত পুরনো পদ্ধতিতে অপারেশনই সর্বোত্তম বলে স্বীকৃত। নতুন পদ্ধতিগুলোতে খরচ বেশি হলেও বাড়তি সুবিধা নিতান্তই কম, বরং কিছু ঝুঁকির মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
খাবার : রোগী অপারেশনের পর অজ্ঞানের প্রভাব মুক্ত হয়ে গেলে বা ঘুম থেকে জাগার ৩-৪ ঘণ্টা পর রোগীকে চামচ দিয়ে আইসক্রিম অল্প অল্প করে খাওয়াতে হবে। তবে রোগী যদি খেতে না পারে জোর করার দরকার নেই। প্রথম ১২ ঘণ্টায় ২-৩টা আইসক্রিম খাওয়ালে চলবে। ১২ ঘণ্টা পর ঠা-া তরল খাবার যেমন : ঠা-া জুস, পানি খেতে পারে। সমস্যা না হলে নরম পাউরুটি দুধে ভিজিয়ে খেতে পারে। তবে খাবার পর রোগী ঠা-া পানি দিয়ে কুলি গড়গড়া করবে, যেন খাবার মুখে জমে না থাকে।
১২ ঘণ্টা পর থেকে ১ গ্লাস পানিতে ২ ছিপি হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড মিশিয়ে দৈনিক ৩-৪ বার গড়গড়া করবে যাতে গলা পরিষ্কার থাকে। এছাড়া প্রতি বার খাবার পর ঠা-া পানি দিয়ে গড়গড়া করবেন। ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রোগী নরম খাবার খাবে যেমন মাড়ি ভাত, নরম খিঁচুড়ি, দুধে ভেজা নরম পাউরুটি অথবা তরল করা খাবার। ৪৮ ঘণ্টা পর রোগী স্বাভাবিক খাবার খাবে এতে রোগীর কষ্ট হলেও স্বাভাবিক খাবার খেলে রোগীর গলাব্যথা তাড়াতাড়ি কমবে এবং রোগী তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে।
ধারালো/শক্ত খাবার যেমন : শুকনা চিড়া, মুড়ি, খৈ, টোস্ট ইত্যাদি ছাড়া সব স্বাভাবিক খাবার যেমন : ভাত-তরকারি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, টক-ঝাল, মিষ্টি সব খাবার রোগী খেতে পারে। টক, দুধ ইত্যাদির জন্য রোগীর কোন নিষেধ নেই। ২৪ ঘণ্টা পর রোগী গোসল করতে পারবে এবং স্বাভাবিক চলাফেরা ও হাল্কা কাজকর্ম করতে পারে। অনেক রোগী গলাব্যথার জন্য ঠিকমতো খেতে পারে না। সেক্ষেত্রে খাবার ২০-২৫ মিনিট পূর্বে একটি ঠড়ষঃধষরহ ঝঁঢ়ঢ়ড়ংরঃড়ৎু, ৬ বছরের নিচে ১২.৫ মি. গ্রাম, ৬-১২ বছর ২৫ মি. গ্রাম, ১২ বছরের বেশি ৫০ মি. গ্রাম নির্দেশমতো ব্যবহার করবে। তাতে ব্যথা কমলে এরপর খাবার খাবে। এভাবে তিনবেলা খাবার পূর্বে ওষুধ ব্যবহার করলে এবং পেট ভরে খাওয়া-দাওয়া করলে এবং নির্দেশমতো গড়গড়া করলে দ্রুত ব্যথা কমবে। অনেক সময় ব্যথা কানে অনুভূত হয়। সেক্ষেত্রে এটা গলা ব্যথার থেকেই কানে ব্যথা আসে এবং ভয়ের কোন কারণ নেই। তবে, হঠাৎ বেশি রক্ত এলে, বেশি জ্বর এলে বা গলাব্যথা মারাত্মক হলে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
যদিও বেশির ভাগ রোগী নিরাপদে অপারেশনের পর ভালভাবে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে যায়। খুব অল্প সংখ্যক রোগীর ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা হতে পারে। সব সমস্যা একজন রোগীর ক্ষেত্রে হয় না। সম্ভাব্য সকল প্রকার সমস্যার বিষয়ে অবগত হওয়া উচিত।
অপারেশন বিষয়ক ঝুঁকিসমূহ
১. রক্তপাত : এটি অপারেশনের সময় বা ২ সপ্তাহ পরে হতে পারে। অপারেশন থিয়েটার হতে বের হবার পরপরই রক্তক্ষরণ হলে তৎক্ষণিকভাবে কিছু উপায়ে তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে কখনও কখনও রোগীকে পুনরায় অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে অজ্ঞান করে রক্ত বন্ধ করা প্রয়োজন হতে পারে। বিশেষ ক্ষেত্রে রক্ত বন্ধ করা প্রয়োজন হতে পারে। বিশেষ ক্ষেত্রে রক্ত সঞ্চালন প্রয়োজন হতে পারে। ছুটি হবার পর সাধারণত গলার ইনফেশন হতে সামান্য রক্তপাত হতে পারে যা সাধারণ চিকিৎসাতেই ভাল হয়। এক্ষেত্রে পুনরায় ভর্তি খুব কম প্রয়োজন হয়।
২. ইনফেকশন : মুখের থেকে ক্রমাগত দুর্গন্ধ এলে, জ্বর হলে, গলার ব্যথা বৃদ্ধি পেলে রোগীর গলায় ইনফেকশন হচ্ছে বলে ধরে নেয়া যায়। এক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিক পরিবর্তন করা লাগতে পারে। অনেক সময় ইনফেকশন হতেও গলা থেকে রক্ত ঝরতে পারে। ৩. ব্যথা : গলা ব্যথা ৫-৭ দিন পর্যন্ত থাকে যা সাধারণ ব্যথার ওষুধেই সরে যায়। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে এই ব্যথা ২ সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে। ব্যথা অনেক সময় কানে অনুভূত হতে পারে। স্বাভাবিক খাবার একটু খেলে ও গলা পরিষ্কার রাখলে ব্যথা দ্রুত নিরাময় হয়।
৪. দাঁত, মাড়ি, জিহ্বা ঠোঁট এসব জায়গায় অনেক সময় ছোটখাটো আঘাত লাগাতে পারে। রক্ত বন্ধ করতে ব্যবহার করা ডায়াথার্মি মেশিনের অনিচ্ছাকৃত ছোয়া লেগে অনেক সময় মুখের ভিতর/পাশে খুব সামান্য জায়গা ইঁস হতে পারে। এগুলোর জন্য বাড়তি কোন সমস্যা হয় না।
৫. টনসিল অপারেশনের পর অনেকের ক্ষেত্রে গলার ভিতর ক্ষত স্থানটি শুকানোর সময় অতিরিক্ত ঋরনৎড়ংরং হতে পারে। এতে করে কারও খাবার খেতে, মুখ হাঁ করতে কিছুটা অসুবিধা হতে পারে।
৬. প্রাপ্ত বয়স্ক রোগীদের টনসিল অপারেশনের পর কারও কারও গলার ব্যথা পুরোপুরি সারে না। এমনকি খুব কম ক্ষেত্রে কোন রোগীর গলা ব্যথা বৃদ্ধিও পায় যাকে চড়ংঃ. ঞড়হংরষষবপঃড়সু ঘবঁৎধষমরধ বলা হয়। এটি কোন মারাত্মক সমস্যা নয়। আতঙ্কিত না হয়ে নিয়মিত ওষুধ সেবনে রোগী ভাল থাকতে পারে।
লেখক : এমবিবিএস, এফসিপিএস (ইএনটি)
জুনিয়র কনসালটেন্ট, নাক-কান-গলা বিভাগ
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল