
সোনাদিয়া দ্বীপ
সোনাদিয়া দ্বীপ এক বিস্ময়কর নৈঃশব্দ্যের নাম। বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে শুয়ে থাকা এই ক্ষুদ্র দ্বীপ যেন প্রকৃতির অপার দান। যেখানে মানুষ নিজেকে খুঁজে পায়। হারিয়ে যেতে চায় নিজের ভেতরের নীরবতায়। চারিদিকে ঝাউগাছের বন। সুনসান নিস্তব্ধ রজনী। তাঁবুর ভিতরে আসা সমুদ্রের উত্তাল গর্জন। এ যেনো এক সেরা অনুভূতি। সোনাদিয়া শুধু একটি দ্বীপ নয়, এটি একান্ত অনুভবের স্থান।
সোনাদিয়া দ্বীপ বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার অর্ন্তগত কুতুবজোম ইউনিয়নে অবস্থিত একটি দ্বীপ। এটি জীববৈচিত্রের দ্বীপ নামেও পরিচিতি এবং এ দ্বীপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পিপাসুদের জন্য অন্যতম পর্যটন স্থান।চারদিকে গভীর সমুদ্রের সাগরের ঢেউ সমৃদ্ধ এটি মূলত প্যারাদ্বীপ নামে পরিচিতি।
অপরূপ সৌন্দর্যের আধার এ দ্বীপ কক্সবাজার শহর থেকে ৭ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমের দূরে সাগর গর্ভে অবস্থিত। দ্বীপটির আয়তন প্রায় ৯ বর্গকিলোমিটার। তিন দিকে সমুদ্র সৈকত,সাগর লতায় ঢাকা বালিয়াড়ি, কেয়া- নিশিন্দার ঝোপ, ছোট-বড় খাল বিশিষ্ট প্যারাবন। বিচিত্র প্রজাতির জলচর পাখি দ্বীপটিকে করেছে অনন্য বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত। এটি মহেশখালী চ্যানেল দ্বারা কক্সবাজারের মূল ভূখণ্ড থেকে বিছিন্ন হয়েছে।
এটি দেশের প্রধান শুটকি মাছ উৎপাদন কেন্দ্র। এখানকার ম্যানগ্রোভ বন এবং উপকূলীয় বনভূমি, সাগরে গাঢ় নীল পানি, কেয়া বন, লাল কাঁকড়া, বিভিন্ন প্রকারের সামুদ্রিক পাখি পর্যটকদের মনে দোলা দেয়।
সোনাদিয়া: হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের দ্বীপ
ছোট্ট এক দ্বীপ সোনাদিয়া, যেটি এখনো অনেকের কাছে অপরিচিত। অথচ এই দ্বীপ একসময় ছিল জীবনের রঙিন গল্পে ভরা। আজ তা যেন নিঃসঙ্গ, নিস্তব্ধ, ও একাকী হয়ে পড়েছে। তবুও এখানকার প্রতিটি ঢেউ, প্রতিটি গাছ আর প্রতিটি মানুষ বয়ে চলেছে ইতিহাস আর জীবনের ছাপ।
সোনাদিয়াতে এখন খুব অল্প কিছু মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। একসময় এখানে অনেক জেলে পরিবার ছিল, শুটকি পল্লী ছিল, শিশুদের কোলাহল ছিল। কিন্তু উপকূলভাঙন, জীবিকার সংকট আর অবহেলার কারণে মানুষজন একে একে দ্বীপ ছেড়ে চলে গেছে।
এখনও যারা আছেন, তারা মূলত মাছ ধরা, শুটকি তৈরি, কিংবা ক্ষুদ্র কৃষিকাজ করে দিন চলে। বর্ষায় দ্বীপ যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখন জীবন আরও কষ্টের হয়ে ওঠে।
সোনাদিয়া শুধু মানুষে নয়, প্রকৃতিতেও সমৃদ্ধ। এখানে একসময় ছিল বিস্তীর্ণ ম্যানগ্রোভ বন, বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক পাখি, কচ্ছপ, শামুক, ঝিনুকসহ নানা প্রাণী। এটি ছিল বিপন্ন পাখি লালচে কুড়ালি ঠুঁটো (Spoon-billed Sandpiper)-এর গুরুত্বপূর্ণ বিচরণক্ষেত্র।
কিন্তু সেই প্রকৃতিও এখন ক্ষয়ে যাচ্ছে। বন কাটা, অতিরিক্ত শুটকি উৎপাদন ও অনিয়ন্ত্রিত চাষাবাদের কারণে পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
কয়েক বছর আগে সোনাদিয়াকে কেন্দ্র করে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কথা উঠেছিল। এতে দ্বীপবাসীর মনে যেমন আশার আলো জেগেছিল, তেমনি প্রকৃতিপ্রেমীদের মধ্যে উদ্বেগও দেখা দেয়। প্রকল্পটি এখন স্থগিত, তবে সোনাদিয়ার ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চিত।
সোনাদিয়ার মানুষ এখন শহরের মানুষের মতো স্বপ্ন দেখে না। তারা চায় শুধু একটু নিরাপদ বাসস্থান, পানির ব্যবস্থা, আর একটি চিকিৎসার ব্যবস্থা। বিদ্যালয় নেই, বিদ্যুৎ নেই, কিন্তু ছোট ছোট শিশুর চোখে এখনো শিখা জ্বলছে—ওরা এখানেই বাঁচতে চাই।
সোনাদিয়া শুধু একটি দ্বীপ নয়, এটি অবহেলা আর সম্ভাবনার প্রতিচ্ছবি। এই দ্বীপকে বাঁচানো মানে শুধু একটি ভূমিখণ্ডকে রক্ষা নয়, বরং একটি প্রজন্মের স্বপ্ন, সংস্কৃতি ও পরিবেশকে রক্ষা করা। একমাত্র সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পারে দ্বীপটি কে পূর্ণাঙ্গ পর্যটন স্পটে রুপ দিতে।
সাব্বির