ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কপ ২৭তম পর্যালোচনা: ব্যর্থ সামিটের যুগান্তকারী অর্জন 

কাওসার রহমান 

প্রকাশিত: ১৫:৫৬, ২৮ নভেম্বর ২০২২; আপডেট: ১৬:২৫, ২৮ নভেম্বর ২০২২

কপ ২৭তম পর্যালোচনা: ব্যর্থ সামিটের যুগান্তকারী অর্জন 

২৭তম জলবায়ু সম্মেলনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছেন মিশরের পররাষ্ট্র মন্ত্রী

দীর্ঘ প্রতিক্ষিত এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত হয়েছে এবারের জলবায়ু সম্মেলনে। তিন দশক পর জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি পূরণে ক্ষতিগ্রস্ত গরিব দেশগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তা দিতে লস এন্ড ডেমেজ তহবিল গঠনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে ২৭তম জলবায়ু সম্মেলন। 

অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত দিনের মধ্যরাতে আফ্রিকা কপ হিসাবে পরিচিত এবারের জলবায়ু সম্মেলনে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল গঠনে ঐতিহাসিক ঐকমত্যে পৌঁছেছেন বিশ্বনেতার। দীর্ঘ দিন পর হলেও এই ল্যান্ডমার্ক সিদ্ধান্তের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর শত কোটি জনগণের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। যুগান্তকারী এই সিদ্ধান্তের পর জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও বলেছেন, ‘ন্যায়বিচারের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।’

অথচ এই মানুষগুলো ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একেবারেই দায়ী নয়। কিন্তু প্রতিনিয়ত সামনের কাতারে থেকে জলবায়ু সংকটের বিরুপ প্রভাব মোকাবিলা করছে। দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে বন্যা, খড়া, ঘুর্ণিঝড় ও সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো জলবায়ুর প্রভাবের। মিশরের শার্ম আল শেখে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে এই সিদ্ধান্তের ফলে দুর্ভোগের শিকার ওই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো কিছুটা হলেও ক্ষতি লাঘবে আশার আলো দেখবে। 

কিন্তু আফ্রিকা কনফারেন্স অব দ্যা পাটি (কপ) জলবায়ু সংকটের পরিণতি মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ জীবাশ্ব জ্বালানির হ্রাস টেনে ধরতে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ধরে রাখতে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তির ব্যাপারে কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেননি। সেই সঙ্গে কয়লা, তেল ও গ্যাসের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনার ব্যাপারেও কোনো চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেনি। ফলে তহবিল গঠনে খুশী হলেও জলবায়ু মোকাবিলায় কোনো চুক্তি না হওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ঝুঁকিতে থাকা দেশ এবং পরিবেশ কর্মীরা।

মিশরের শার্ম আল-শেখে রাতভর ব্যাপক আলোচনার পর ভোরের দিকে কপ-২৭ সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শামেহ শুউক্রি সম্মেলনের চূড়ান্ত এজেন্ডা উপস্থাপন করেন। কোনো আপত্তি ছাড়াই সেটি মেনে নেন আলোচকরা। এর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার দেশগুলোকে সহায়তা দিতে একটি তহবিল গঠনে সম্মত হয় ১৯৮টি দেশ। তার অর্থ হলো, বিশ্বের যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের এই ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল থেকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে।

দুই সপ্তাহ ধরে চলা জলবায়ু সম্মেলনে এই সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে সম্মেলনের বৃহত্তম নেগোসিয়েশন গ্রুপ জি-৭৭ প্লাস চীনের অবিস্মরণীয় ঐক্যের কারণে। এই গ্রুপের মোট সদস্য সংখ্যা ১৩৪টি দেশ। এই ১৩৪ দেশ এবার সম্মেলনে লাস এন্ড ডেমেজ তহবিলের ব্যাপারে ছিল অবিচল এবং একাট্টা। যার কারণে, এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। 

এই অর্জনে বড় ভূমিকা ছিল দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তানের। পাকিস্তান বর্তমানে জি-৭৭ প্লাস চীন গ্রুপের চেয়ার। অতি সম্প্রতি ভয়ানক এক প্রলয়ংকরী বন্যায় দেশটির এক তৃতীয়াংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। দেশটিতে অতীতের প্রতিটি সীমা, প্রতিটি রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে এবারের বন্যা। এর আগে কখনও এমন পরিস্থিতি দেখেনি পাকিস্তানের মানুষ। দেশটিতে বন্যায় মৃত্যু ১৩শ ছাড়িয়েছে। ব্যাপকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে অবকাঠামো। সব মিলিয়ে ক্ষতি হয়েছে ১৫শ’ কোটি মার্কিন ডলারের। এই ক্ষতিপূরণ কোনোভাবেই অভিযোজনের মাধ্যমে সম্ভব নয়। বন্যার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো কোনো দেশের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। এই ক্ষতি পোষাতে অভিযোজনের বাইরে কোনো তহবিলের অর্থের প্রয়োজন। যাকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো লস এন্ড ডেমেজ হিসাবে আখ্যায়িত করে আসছে। 

এই ক্ষতির বোঝা মাথায় নিয়েই জি-৭৭ গ্রুপের নেতা পাকিস্তান ২৭তম জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দেয়। পাকিস্তান শুরু থকেই সোচ্চার হয় লস এন্ড ডেমেজ ফান্ড গঠনের ব্যাপারে। অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশও এই দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে। বিশেষ করে আফ্রিকান দেশগুলোও এ ব্যাপারে সক্রিয় হয়ে উঠে। ফলে সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট শামেহ শুউক্রি প্রথমবারের মতো লস এন্ড ডেমেজের অর্থায়নের বিষয়টি আলোচনার এজেন্ডায় অন্তর্ভূক্ত করেন। এখান থেকেই শুরু হয় জলবায়ু সম্মেলনে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি। 

আলোচনার এজেন্ডায় আসার পর থেকেই ধনী দেশগুলো এই তহবিল গঠন ঠেকাতে উঠে পড়ে লেগে যায়। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুরুতেই বলে আসে উন্নত দেশগুলো বৈশ্বিক মন্দার কবলে পড়েছে। তাদের কাছে অর্থ নেই। ফলে জলবায়ু খাতে অর্থায়ন তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কর্মকর্তা পর্যায়ের ধনী দেশগুলো এই তহবিল গঠনকে ২০২৪ সালে ঠেলে নিতে সমর্থ হয়। কিন্তু মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকেই সব পাল্টে যায়। এই বৈঠকে এসে জি-৭৭ প্লাস চীন গ্রুপ লস এন্ড ডেমেজের ক্ষতি পোষাতে তহবিল গঠনে তৎপর হয়ে উঠে। 

তাদের ভাবনা ছিল, যেহেতু এই সম্মেলনে এই ইস্যু এজেন্ডার্ভুক্ত হয়েছে, তাই গরম গরম থাকতেই অন্তত তহবিল গঠন হয়ে যাক। পরবর্তীতে এর কাঠামো ঠিক করা যাবে। ফলে ১৩৪ দেশ একযোগে অবস্থান নেয় লস এন্ড ডেমেজ তহবিল গঠনের ব্যাপারে। সঙ্গে যুক্ত হয় আন্তর্জাতিক সিভিল সোসাইটির চাপ। কিন্তু এর সরাসরি বিরোধীতায় নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা এই তহবিল গঠণকে বাধাগ্রস্ত করার নানা চেষ্টা চালায়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগ দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি মিত্র দেশ। তারাও এই আলোচনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য উন্নয়ণশীল দেশগুলোর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু কোনোভাবেই এই তহবিল গঠনের ব্যাপারে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ভাঙন ধরানো যায়নি। এই জলবায়ু রাজনীতির খেলায় সম্মেলনের সময় পেরিয়ে যায়। আয়োজক দেশ মিশর সম্মেলন থেকে একটি ইতিবাচক ফল বের করে আনার জন্য সম্মেলনের সময় আরও একদিন বাড়িয়ে দেয়। শেষ দিন শেষে প্রায় সারারাত ধরে এ নিয়ে চলে উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনা। কিন্তু ১৩৪টি উন্নয়নশীল দেশের জোট জি-৭৭ এই তহবিল গঠনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। আলোচনায় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো এই তহবিল গঠনের পক্ষে একজোট হয়ে অবস্থান নিয়েছিল। তারা জি-৭৭ এর বর্তমান প্রধান পাকিস্তানের নেতৃত্বে জলবায়ু তহবিল গঠনের লড়াইয়ে মাঠে নামে। 

শেষ পর্যন্ত উন্নয়নশীল দেশ ও আন্তর্জাতিক সিভিল সোসাইটির লবিংয়ে সম্মেলনের অতিরিক্ত  দিনে এসে নাটকীয় অগ্রগতি ঘটে। এদিন সকালে ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফ্রান্স তিমারম্যানস ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে তহবিল গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাবনা উত্থাপন করেন। তখন দরিদ্র দেশগুলোর জন্য লস এন্ড ডেমেজ ফান্ড নামক একটি তহবিল গঠনে রাজী হয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। 

এ বিষয়ে তিমারম্যানস বলেন, ‘তহবিল প্রশ্নে আমরা অনিচ্ছুক ছিলাম। আমাদের অনিচ্ছা ছিল, কারণ আমরা জানি একটি তহবিল গঠনের আগে অনেক সময় লাগে। তবে আমরা চেয়েছি, দ্রুত জি-৭৭ গ্রুপের দাবি মেনে নিতে। তাই আমরা তহবিল গঠনে রাজি হয়েছি।’ তিনি প্রস্তাব করেন, এই তহবিল হবে শর্তাধীন এবং বহুজাতিক উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যম এ তহবিলের অর্থ ছাড় দেয়া হবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রভাবশালী দেশ জার্মানীও এই প্রস্তাব সমর্থন করে। জার্মান জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রী জেনিফার মর্গান বলেন, ‘এখানে যে সমঝোতার প্রস্তাব এসেছে, তাতে আমরা সম্মতি দিয়েছি। কারণ, আমরা সবচেয়ে ক্ষতির শিকার দেশগুলোর সঙ্গে থাকতে চাই।’

এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে মিশরীয় কপ-২৭ প্রেসিডেন্সি সামগ্রিক চুক্তির একটি খসড়া প্রকাশ করে। একইসঙ্গে এটিকে কপ-২৭ সম্মেলনের চূড়ান্ত চুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের আহ্বান করা হয়।

এই পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনেও লস এন্ড ডেমেজ তহবিল নিয়ে বাদানুবাদ ঘটে। এই বাদানুবাদ হয় মুলত শীর্ষ কার্বন দূষণকারী দেশ চীন ও ভারতকে নিয়ে। চীনের বিষয়টি উত্থাপন করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র। তাদের মতে, চীনসহ যেসব উন্নয়নশীল দেশ বৃহৎ আকারে পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী, তাদেরও এ তহবিল গঠনে অবদান রাখতে হবে। শেষ পর্যন্ত সমঝোতা হয়, চীনের মতো বৃহৎ অর্থনীতির দেশকে প্রাথমিকভাবে এ তহবিলে অর্থ দিতে হবে না, তবে চীনের বিষয়ে আগামী সম্মেলনে আলোচনা হবে। এই সমঝোতার মধ্য দিয়ে অতিরিক্ত দিন পেরিয়ে মধ্যরাতে সমঝোতার ভিত্তিতে বিশ্বের প্রায় ২০০ দেশ জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ক্ষতিপূরণে একটি তহবিল গঠনে চুক্তিতে উপনীত হয় এবং ভোটের মাধ্যমে তারা এই চুক্তি অনুমোদন করে। 

চুক্তি অনুসারে, প্রাথমিকভাবে সব উন্নত দেশ, তাদের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এই তহবিলটি অর্থদান করবে। ধনী দেশগুলোর নিঃসরণ করা কার্বনের কারণে তৈরি হওয়া এই তহবিলের টাকা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো ঝড়, বন্যা এবং অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলায় কাজে লাগাবে। তবে তহবিলে কোন দেশ, কীভাবে আর কত টাকা দেবে, সেসব বিষয় এখনো পরিষ্কার হয়নি। এই তহবিলের বিষয়ে কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত আগামী বছর পর্যন্ত মুলতবী রাখা হয়েছে। সে সময় একটি ‘অন্তর্র্বতীকালীন কমিটি’ দেশগুলোর জন্য কিছু সুপারিশ দেবে, যা ২০২৩ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য কপ২৮ সম্মেলনে আলোচিত হবে। এই সুপারিশগুলোর মধ্যে থাকবে ‘তহবিলের উৎস চিহ্নিত করা ও একে সম্প্রসারণ করা’, যার মাধ্যমে জানা যাবে কোন কোন দেশ এই তহবিল তৈরি করতে মূল ভূমিকা রাখবে।

ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সহায়তা তহবিল গঠনে একমত হলেও, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করার বৈশ্বিক সংকল্পের রূপরেখা বাস্তবায়নের বিষয়ে বৃহত্তর চুক্তি অনুমোদনে বিলম্ব করেছে দেশগুলো। গত জলবায়ু সম্মেলনেই এই রূপরেখার ব্যাপারে সমঝোতা হয়েছিল। সমঝোতা হয়েছিল বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরন ১.৫ ডিগ্রীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে দেশগুলো কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ২০১০ সালের চেয়ে ২০৩০ সাল নাগাদ ৪৫ সাল পর্যন্ত কমাবে। একে ওয়ার্ক প্রোগ্রাম অন মিটিগেশন নামে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। কিন্তু লবিষ্টদের নানাবিধ লবিং এবং উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বার্থান্বেষী মহলের বাধার কারণে তা অনুমোদন করা যায়নি। অথচ, শিল্পোন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণের ফলে গরীব দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের যে চ্যালেঞ্জ এবং ক্ষতির মধ্যে পড়েছে, সে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনার  প্রতিশ্রুতি দিয়েই সম্মেলন শুরু হয়েছিল। 

এবারের জলবায়ু সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানির পক্ষের লবিষ্টদের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছিল। তারাও ভূমিকা রেখেছে এই চুক্তিকে বাধাগ্রস্ত করতে। জীবাশ্ম জ্বালানির শিল্পগুলো ভিষণভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে এবারের সম্মেলনে যাতে জীবাশ্ম জ্বালানির বন্ধের চুক্তি না হয়। এক্ষেত্রে জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধের বিষয়ে উন্নত ও দ্রুত উন্নয়ণশীল দেশগুলোর মধ্যেও বিভেদ চরম আকার ধারণ করে। উন্নত দেশগুলো বিশ্ব থেকে কয়লা ভিত্তিক জ্বালানি বন্ধ করতে চায়, কিন্তু ভারত এবং চীনের মতো দেশগুলো তাতে রাজি নয়। বহু দরকষাকষির পর আলোচনা ঠেকেছিল একেবারে বাতিল করার পরিবর্তে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনা। কিন্তু ভারত এবং আরও কয়েকটি দেশ এখন চাইছে, জীবাশ্ম জ্বালানি সীমিত করার তালিকায় কয়লার সঙ্গে সঙ্গে যেন তেল ও গ্যাসও যুক্ত করা হয়। এ নিয়ে বিতর্কে এই সম্মেলনে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে একমত হতে পারেনি বিশ্বের দেশগুলো। ফলে জীবাশ্ম জ্বালানি ইস্যুতে সম্মেলনে কোনো উল্লেখযোগ্য সমাধান হয়নি। অথচ এবারের সম্মেলনের একমাত্র লক্ষ্যই ছিল জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য ওয়ার্ক প্রেগ্রাম অন মিটিগেশন চুক্তি স্বাক্ষর করা। শেষ পর্যন্ত এটি না হওয়ায় জীবাশ্ম জ্বালানির বিরোধিতাকারী দেশগুলো বেশ হতাশ হয়েছে।

এ বিষয়ে ২৭তম জলবায়ু সম্মেলনের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, খুব শীঘ্রই মিটিগেশন ওয়ার্ক প্রোগ্রাম শুরু হবে এবং এর কার্যক্রম শেষ হবে ২০৩০ সালে। এ ব্যাপারে প্রতি বছর দুটি করে বৈশ্বিক সংলাপ হবে। আর সরকারগুলোকে অনুরোধ করা হয়েছে, কয়লা ও অদক্ষ জ্বালানির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে ২০৩০ সালের লক্ষ্য অর্জনের জন্য। 

তবে সম্মেলনে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির ব্যাপারে দেশগুলো একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। এটি একটি স্বাগত জানানোর মতো ঘটনা হলেও জীবাশ্ম জ্বালানি পর্যায়ক্রমে বন্ধের ব্যাপারে শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ না করায় কোনো সরকারের পক্ষেই ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না। তাই জাতিসংঘের সামনেও এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ধরে রাখা। এক্ষেত্রে জলবায়ু সম্মেলনের সমান্তরালে অনুষ্ঠিত জি ২০ বৈঠকে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের গতি তরান্বিত করতে আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে ২০ বিলিয়ন ডলার প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। 

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে আগামী জলবায়ু সম্মেলনে ‘গ্লোবাল গোল অন এডাপটেশন’ গ্রহণ করা হবে। এবারের সম্মেলনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে অগ্রগতি হয়েছে। সেই সঙ্গে অভিযোজন তহবিলে নতুন করে আরও ২৩ কোটি মার্কিন ডলার প্রদান করা হয়েছে। যা বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো তাদের অভিযোজন কার্যক্রমে ব্যবহার করতে পারবে। 

প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী উন্নত দেশগুলোর প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার করে প্রদানের বিষয়ে অগ্রগতি না হওয়ায় সম্মেলনে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি পুরণের আহ্বান  জানানো হয়েছে এবং বহুজাতিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে জলবায়ু কার্যকমে আরও অর্থ যোগানোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। 

এছাড়া এবারের সম্মেলনে জলবায়ু দুর্যোগে বিপর্যস্ত দেশগুলোকে সহায়তার জন্য জি-৭ দেশগুলোর নেতৃত্বে গ্লোবার শিল্ড ফাইন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি নামে এক তহবিল উদ্বোধন করা হয়েছে। পাশাপাশি নিম্ন আয় ও উপকূলীয় দেশগুলোর অভিযোজনের জন্য ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, জার্মানী, আয়ারল্যান্ড, স্লোভেনিয়া, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড ও বেলজিয়াম অঞ্চলের দেশগুলো ১০ কোটি ৫৬ লাখ মার্কিন ডলার নতুন করে প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।  

এবারের সম্মেলনের বিশেষ বৈশিষ্ট ছিল বিশাল এই আলোচনা যজ্ঞে ৪৫ হাজারেরও বেশি মানুষ তাদের মতামত ব্যক্ত করতে পেরেছে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে তাদের চিন্তাধারা একে অন্যের সঙ্গে শেয়ার করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় তাদের উদ্যোগ ও উদ্ভাবনী এই বিশাল আয়োজনে উপস্থাপন করেছে। এই বিশাল যজ্ঞে শিশু-তরুণ থেকে শুরু করে আদিবাসী, স্থানীয় জনগণ, শহরবাসী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সরগরম উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যণীয়।    

সবমিলিয়ে, আফ্রিকার মাটিতে জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে নতুন আশা জাগিয়েছে। সৃষ্টি করেছে নতুন প্রত্যাশা। শুধু আফ্রিকান মহাদেশই নয়, পুরো দক্ষিণ বিশ্বের মানুষেরই জন্যই এই পদক্ষেপ সুফল বয়ে আনবে। এটি উন্নয়নশীল দেশের সরকার ও নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্ঠার ফসল। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ জীবাশ্ম জ্বলানির বন্ধের পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতায় কার্বন দূষণকারী দেশগুলো নতুন প্রজম্মের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে থাকবে। এতে পৃথিবীতে আরও অধিক পরিমাণে জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলন বাড়বে। ফলে বাড়বে এর ব্যবহার। আর কার্বন দূষণ আরও বেড়ে গিয়ে অধিক পরিমাণে লস এন্ড ডেমেজের ঘটনা ঘটতে থাকবে। তাই এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন দ্রুত জীবাশ্ম জ্বালানির যুগ থেকে নাবায়নযোগ্য জ্বালানির যুগে প্রত্যাবর্তন।  

সর্বপরি, এবারের জলবায়ু সম্মেলনে লস এন্ড ডেমেজ তহবিল গঠন কার্বন দূষণকারী দেশগুলোর জন্য একটিই বার্তা দিচ্ছে, তা হলো, জলবায়ু বিপর্যয়ের জন্য তোমাদেরও দায় নিতে হবে। এখন থেকে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খড়া ও সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চ বৃদ্ধিতে যে সকল মানুষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাদের ক্ষতিপূরণের জন্য অর্থ প্রদান করতে হবে। পাশাপাশি নতুন এই তহবিলকে কার্যকর করার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে উন্নত দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি অব্যাহত রাখতে হবে। চাপ সৃষ্টি করতে হবে দ্রুত নবায়নযোগ্য জ্বালানিতেও উত্তরণের জন্য। যাতে আগামী ২৮তম জলবায়ু সম্মেলনে পুরিপূর্ণভাবে জলবায়ু ন্যায্যতা নিশ্চিত করা যায়।  

এমএইচ

সম্পর্কিত বিষয়:

×