ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জলবায়ু সম্মেলনে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের তোরজোর বেশি 

কাওসার রহমান, শার্ম আল শেখ ( মিশর) থেকে

প্রকাশিত: ২১:১৬, ১০ নভেম্বর ২০২২

জলবায়ু সম্মেলনে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের তোরজোর বেশি 

জাতিসংঘ আয়োজিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন বা কপ-২৭

দর কষাকসির ইতিহাসে এবার এক ব্যতিক্রম জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অন্যান্য জলবায়ু সম্মেলনের চেয়ে এবারের সম্মেলনের চরিত্র বৈশিষ্টও ভিন্ন। অন্যান্য জলবায়ু সম্মেলনে দুর্যোগের ঝুঁকিমুক্ত পৃথিবী গড়ার জন্য উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে নানা ইস্যুতে প্রতিশ্রুতি আদায়ের একটি তোরজোড় থাকে। কিন্তু এবারের জলবায়ু সম্মেলনে আদায়কৃত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের তোরজোর বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। 

বাংলাদেশও এবারের সম্মেলনে চাইছে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন। বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বলছেন, অনেক প্রতিশ্রুতি হয়েছে, এখন বাস্তবায়ন দরকার। আমরা চাই, প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়ন। প্যারিস চুক্তির আলোকে এ পযন্ত যত প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তার সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন। অন্যথায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে চলেছে তাতে বাংলাদেশের উপকূলের মানুষকে বাঁচানো যাবে না।

প্যারিস জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেই ২০১৫ সালে। এরপর ওই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য গাইডলাইন বা রুলবুক প্রনয়নের কাজ চলছিল এত বছর ধরে। সেটিও সম্পন্ন হয়ে অনুমোদন হয়ে গেছে গত বছরের গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনে। পাশাপাশি প্যারিস জলবায়ু চুক্তির আলোকে গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনে বৈশ্বিক গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ২০৩০ সালের মধ্যে ধাপে ধাপে কয়লার ব্যবহার বন্ধ করা, মিথেন গ্যাস নিঃসরণ কমানো এবং বন উজাড় বন্ধ করা। 

এছাড়া বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখতে ২০৩০ সালের কার্বন নিঃসরণ ২০১০ সালের চেয়ে ৪৫ শতাংশ কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কিন্তু গত এক বছরে সেই সব প্রতিশ্রুতির ধারে কাছেও কোন দেশ বিশেষ করে উন্নত দেশগুলো যায়নি। 

জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি প্রদান শুরু হয়েছিল সেই ২০০৯ সালে কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলন থেকে। এরপর জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ি উন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে একের পর এক প্রতিশ্রুতি এসেছে। আবার এসব প্রতিশ্রুতি আদায় করতেও বাংলাদেশে মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। এতে জলবায়ু সম্মেলনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সমঝোতাকারীদের অনেক সময় ও শ্রম ব্যয় হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতিই আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আরও বলছেন, ২০০৯ সালেই উন্নত দেশগুলো কোপেনহেগেন অ্যাকর্ডে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ২০২০ সাল থেকে প্রতিব ছর ক্ষতিগ্রস্ত  দেশগুলোকে ১০০ বিলিয়ন ডলার করে দিবে। ২০২০ সাল গিয়ে ২০২২ সালও চলে যাচ্ছে। এখন সময়ের পরিবর্তনে ১০০ বিলিয়ন ডলারের চাহিদা ৫০০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু মূল প্রতিশ্রুতিই এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। 

এর আগে ২০১০ সাল থেকে ফাস্ট ট্র্যাক ফাইনান্যান্স হিসেবে উন্নত দেশগুলো ৩ বছরে ৩০ বিলিয়ন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু সেই প্রতিশ্রতিও তারা (উন্নত দেশ গুলো) বাস্তবায়ন করেনি। উল্টো পুরনো দেয়া ঋণ ও অনুদানকে গোজামিল দিয়ে হিসাব দিয়েছিল ২০১৩ সালে জলবায়ু সম্মেলনে । 

এ প্রসঙ্গে সম্মেলন পর্যবেক্ষণকারী জলবায়ু বিশেষজ্ঞ মো: সামছুদ্দোহা বলেন, সেই কোপেনহেগেন অ্যাকর্ডে উন্নত দেশগুলোর চাপে সিদ্ধান্ত হয়েছিল বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে । ওই সম্মেলনে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডন্ট বারাক ওবামার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি কোর কমিটির মাধ্যমে গুরত্বপুর্ন ভুমিকা পালন করেছিলেন। 

বাংলাদেশর দাবি ছিল ২ ডিগ্রি নয়, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে সীমিত রাখতে হবে। বাংলাদেশের সেই দাবীও কোপেনহেগেন অ্যাকর্ডে থাঁয় পেয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা বেডে যাওয়ায় বিশ্ব জোরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা বেড়ে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পক্ষ থেকে জোড়ালো দাবি উঠে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি নয়, ১.৫ ডিগ্রির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। 

জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করা আন্ত:সরকার প্যানেল আইপিসিসি তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করে জানায়, জলবায়ু পরিবর্তন যেভাবে ঘটছে তাতে পৃথিবী কে রক্ষার জন্য তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রির মধ্যেই রাখতে হবে। জাতিসংঘ তাতে মত দেয়। শেষ পর্যন্ত উন্নত দেশগুলো তাদের ২ ডিগ্রি দাবী থেকে সরে আসে। ফলে প্যারিস চুক্তিতে ১.৫ ডিগ্রির বিষয়টি অন্তভুক্ত হয়। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত মানছে না উন্নত দেশগুলো । তাদের কারণে বর্তমানে যে হারে কার্বন নি:সরণ হচ্ছে তাতে এই শতাব্দী শেষে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২.৮ ডিগ্রি পৌছাবে। এই তথ্য খোদ জাতিসংঘ বিভিন্ন সংস্থার। 

প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের এই বাস্তবতার প্রেক্ষিতে তাই এবারের জলবায়ু সম্মেলনের উদ্যোক্তারা নতুন প্রতিশ্রুতি বাদ দিয়ে পুরনো ‘প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে’ উদ্যোগী হয়েছেন । তাই এবারের জলবায়ু সম্মেলনেকে প্রতিশ্রুতি বাস্তবাস্তবায়ের সম্মেলন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে । সম্মেলনের শুরু থেকে নতুন দরকষাকষিতে না গিয়ে আগের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে জোর দেয়া হয়েছে। 

এ ব্যাপারে মিশর প্রেসিডেন্সির সঙ্গে জাতিসংঘ গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে। সম্মেলনে ১০০টি দেশের অধিক শীর্ষ নেতারা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে একযোগে কাজ করার অঙ্গিকার ব্যাক্ত করেছেন। সকলেই একবাক্যে তাদের দেয়া বক্তব্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে কাজ শুরু করার তাগিদ দিয়েছেন।

ইতিমধ্যে সম্মেলনে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের অনুসঙ্গ হিসেবে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে । এর মধ্যে একটি হচ্ছে দুর্যোগের আগাম সতর্কতা ব্যবস্হা জোরদার করা । কারণ বিদ্যমান প্রতিশ্রুতি গুলো বাস্তবায়ন খুবই জরুরি। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিউ গুতেরেসে এই আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা কার্যক্রম উদ্বোধন করেছেন । 

একইসঙ্গে তিনি আরও উদ্ভোধন করেছেন, বিশ্বে কার্বন নি:সরণের প্রকৃত তথ্য উদঘাটনের জন্য গ্রীন হাউজ গ্যাস ইনভেন্টরি কার্যক্রম।এর মাধ্যমে বিশ্বে কার্বন নি:সরণের প্রকৃতপক্ষে তথ্য জানা যবে। বর্তমানে বিভিন্ন সংস্থার দেয়া কার্বন নি:সরণ তথ্যর সঙ্গে প্রকৃত তথ্যের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ফলে অর্থায়ন ও অভিযোজনের ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়ছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য কার্বন নি:সরণের প্রকৃত তথ্য জানা জরুরি হয়ে পড়েছে।

তাছাড়া এবারের সম্মেলনে এই প্রথমবারের মতো তরুণ এবং শিশুদের জলবায়ু পরিবতর্ন মোকাবিলা কার্যক্রমে অন্তভুক্ত করা হয়েছে । তাদের জন্য সম্মেলন কেন্দ্রে স্টল খোলা হয়েছে। এতে তরুণ ও শিশুরা আনুষ্ঠানিকভাবে জলবায়ু কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলো। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, তরুণ এবং শিশুদের জলবায়ু কার্যক্রমে অংশগ্রহণের ফলে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সচেতনতা সৃস্টিতে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে ।


 

এসআর

সম্পর্কিত বিষয়:

×