
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় বর্ষা উৎসবে নৃত্য পরিবেশনা
বিদায় নিল জ্যৈষ্ঠের খরতাপ। এলো প্রশান্তির পরশমাখা আষাঢ়। সেই সুবাদে হাজির হলো রূপ-লাবণ্যে ভরপুর ঋতু বর্ষা। শনিবার ছিল বর্ষাকালের প্রথম দিন পহেলা আষাঢ়। এদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি বৃষ্টি না ঝরলেও শিল্পিত পরিবেশনায় সিক্ত হয়েছে সংস্কৃতিপ্রেমী নাগরিকের মন-প্রাণ। গানের সুরে, কবিতার ছন্দে কিংবা নাচের নান্দনিকতায় উপস্থাপিত হয়েছে রূপময় ঋতুর বন্দনা। বৈচিত্র্যময় সেসব পরিবেশনায় বর্ষারানীকে স্বাগত জানানোর সমান্তরালে উচ্চারিত হয়েছে প্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষার আহ্বান। বর্ষার আগমনী সুরে এদিন সকাল থেকে সরব হয়ে ওঠে রাজধানীর সংস্কৃতি ভুবন। বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে ‘প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও বিশ্ব বিবেক’ স্লোগানে বর্ষা উৎসবের আয়োজন করে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ঢাকা মহানগর সংসদ। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় অভিন্ন উৎসবের আয়োজন করে বর্ষা উৎসব উদ্্্যাপন পরিষদ।
সকালে বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় নাচ-গান কবিতা ও কথনে সজ্জিত উদীচীর বর্ষা উৎসব। উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী পন্ডিত অসিত কুমার দের রাগ সংগীতের আশ্রয়ে পরিবেশনা পর্ব শুরু হয়। এ পর্বে সমবেত গান, আবৃত্তি, নৃত্য পরিবেশন করেন উদীচীর ঢাকা মহানগর সংসদের বন্ধুরা। এরপর বিভিন্ন শাখার বন্ধুরা গান, নৃত্য ও আবৃত্তি পরিবেশনার পাশাপাশি ছিল আমন্ত্রিত শিল্পীদের পরিবেশনা। নজরুলসংগীত পরিবেশন করেন নাহিয়ান দুরদানা সুচি। একক আবৃত্তি করেন ডালিয়া আহমেদ। রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন সেমন্তী মঞ্জুরি। একক আবৃত্তি করেন আতিকুজ্জামান মির্জা। এ ছাড়া একক সংগীত পরিবেশন করেন মায়েশা সুলতানা উর্বি, অবিনাশ বাউল, রবিউল হাসান এবং বন্ধুদের নিয়ে কোলাজ সংগীত পরিবেশন করেন মীর।
কথন পর্বে বক্তারা বলেন, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে প্রকল্প বা স্থাপনা গড়ে তোলা চলবে না। অপরিকল্পিত নগরায়ণ বন্ধ করতে হবে। শহরে-বন্দরে সৌন্দর্য বর্ধনের নামে গাছ কাটা, পশু-পাখির আবাসস্থল ধ্বংস করা চলবে না। অবিলম্বে দেশের বিলুপ্তপ্রায় পশু-পাখি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হোক।
ঢাকা মহানগর উদীচীর সভাপতি নিবাস দের সভাপতিত্বে কথন পর্বে আলোচক ছিলেন কৃষি ও কৃষক বন্ধু রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা। আলোচনায় অংশ নেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান, সহসভাপতি ও বর্ষা উৎসব উদ্যাপন কমিটির আহ্বায়ক হাবিবুল আলম ও সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে।
রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা বলেন, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে যে উন্নয়নের ধ্বজা উড়ানো যাবে না। উন্নয়নের ধুয়া তুলে দেশের সম্পদ নদীনালা, খালবিল, বন-পাহাড়, উন্মুক্ত জমি তুলে দেওয়া হয়েছে লুটেরা গোষ্ঠীর হাতে। এর মধ্য দিয়ে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর পুঁজির নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কাজটি নিশ্চিত করেছে রাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি জানান, ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা কমেছে প্রায় চার লাখ ৯৪ হাজার ২১১ একর। এই বিশাল এলাকার গাছগাছালি ধ্বংস না হলে ৭৩.৪ মেগাটন কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ ঠেকানো যেত। দেশে বন বিভাগের মোট জমি ৩৭ লাখ ৭১ হাজার ১২৪ একর।
অন্য বক্তারা বলেন, সংসদীয় কমিটিতে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে। শিল্পপতি থেকে শুরু করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা বনভূমি দখলবাজিতে যুক্ত। বন ও পরিবেশ ধ্বংস করে রাষ্ট্রীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং প্রভাবশালীদের দখলদারির কারণে সঙ্কুচিত হয়ে আসা বনভূমিতে বিলুপ্তির মুখে পড়েছে অনেক প্রকারের বন্যপ্রাণী।
গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন ও তথ্যের ভিত্তিতে ধারণা করা যায় গত এক দশকে দেশে শতাধিক হাতি অপমৃত্যু ও দস্যুদের দ্বারা হত্যার শিকার হয়েছে। হাতি ছাড়াও চিতাবাঘ, উল্লুক, ঘড়িয়ালসহ নানা প্রাণী আজ বিপন্ন। বনভূমি রক্ষার তাগিদ দিয়ে বক্তারা বলেন, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য কোনো দেশের মোট ভূমির ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন বলে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। দেশে বর্তমানে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ১৫.৫৮ শতাংশ। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, সঠিক পরিকল্পনা এবং উন্নয়ন প্রকল্পে স্থান নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রকৃতি-পরিবেশ এবং বনভূমিকে গুরুত্ব না দিলে আগামী এক দশকে দেশের বনভূমি ঠেকবে ৫ শতাংশে।
চারুকলায় বর্ষা উৎসব ॥ বাঁশরিয়া হাসান আলীর বাঁশির সুরে চারুকলার বকুলতলায় বর্ষা উৎসবের সূচনা হয়। এরপর ছিল নাচ-গান-কবিতায় সজ্জিত বহুমাত্রিক পরিবেশনা। যেথায় মিশে ছিল রবীন্দ্র-নজরুল থেকে শচীন কর্তা থেকে বাংলার লোককবিদের সৃষ্টির নির্যাস। সাজেদ আকবর গেয়ে শোনান ‘বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় এল’। সালমা আকবর শুনিয়েছেন ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’। বিজন চন্দ্র মিস্ত্রি পরিবেশন করেন ‘বরষা ঐ এল বরষা’। অনিমা রায় গেয়েছেন ‘নীল অম্বর ঘন কুঞ্জ ছায়ায়’। নবনীতা জাইদ চৌধুরীর গাওয়া গানের শিরোনাম ছিল ‘এক বরষার বৃষ্টিতে ভিজে’। এ ছাড়া একক সংগীত পরিবেশন করেন আবিদা রহমান সেতু, শ্রাবণী গুহ রায়, স্নিগ্ধা অধিকারী, রতœা সরকার ও ফেরদৌসী কাকলী। সম্মেলক কণ্ঠে সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী পরিবেশন করে ‘গাঙ্গে যাইতাছে দেখো ভাই’। বহ্নিশিখা পরিবেশন করে ‘রুমুঝুম রুমুঝুম কে বাজায়’। সুরবিহারের শিল্পীরা গেয়ে শোনায় ‘এসো শ্যামল সুন্দর’।
এ ছাড়া দলীয় সংগীত পরিবেশন করে পঞ্চভাস্কর, সীমান্ত খেলাঘর আসর ও সুরনন্দন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’ আবৃত্তি করেন বাচিকশিল্পী মো. আহ্কাম উল্লাহ্। ত্রপা মজুমদার পাঠ করেন ইন্দ্রানী সমাদ্দারের কবিতা ‘বৃষ্টি’। জয় গোস্বামীর ‘মেঘ বালিকা’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন নায়লা তারান্নুম চৌধুরী কাকলি। উৎসবে সম্মেলক নৃত্য পরিবেশন করে ধৃতি নর্তনালয়, স্পন্দন, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি অব ফাইন আর্টস ও কথক নৃত্য সম্প্রদায়।