
চিত্রকর্মের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হাতেকলমে শিক্ষাদান করছেন শিক্ষক
বগুড়ার ৮০ বছরের সরকারী একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে পারে শিক্ষার উন্নয়ন মডেল। স্কুলের নাম মালতিনগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। যে স্কুলের শিশুশ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণীর কক্ষের নামকরণ হয়েছে বাঙালী মণিষীদের নামে। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শামসুর রাহমান, সুফিয়া কামাল, জসীম উদ্দীন, সুকুমার রায়, রোকানুজ্জামান খান কক্ষ। সাত বীরশ্রেষ্ঠের পরিচিতি- বঙ্গবন্ধু কর্নার, শেখ রাসেল কর্নারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাঠাগার।
শিশু শ্রেণীর কক্ষটির চারধারে সাজানো হয়েছে শিশুমনের আকাক্সক্ষার ও প্রকৃতির চিত্রকর্ম দিয়ে। মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে পাঠদানের সঙ্গে কম্পিউটার ধারণা দিতে ল্যাপটপের পরিচিতি করিয়ে দেয়া হয়। এ জন্য রয়েছেন ইনফর্মেশন কমিউনিকেশন্স ও টেকনোলজির (আইসিটি) চার শিক্ষক। স্কুলের প্রধান শিক্ষক জেসমিন আরা (এমএসএস এমএড) বললেন, কোমলমতি শিশুদের জীবনের শুরুতেই আগামীর ডিজিটাল পৃথিবীর ধারণা এবং বাঙালী মণিষীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। তিনি প্রায় ছ’বছর আগে যোগদান করার পর শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে স্কুলটি সাজিয়েছেন।
স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪০৯। মেয়ে ও ছেলে শিক্ষার্থী সমান। শিক্ষার্থীকে কোন্ ক্লাসে পড়ছো জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তর দেয় শ্রেণীর সঙ্গে কক্ষের নাম। স্কুলটি ১৯৪২ সালে স্থাপিত। ১৯৯৮ সালে পুনর্নির্মাণ করা হয়। তিনতলা ভবনের স্কুলটির একটি সমস্যা কোন বাউন্ডারি নেই। তবে স্কুলের সামনে আছে প্রাচীন একটি বিশাল কড়ই বৃক্ষ, যা স্কুলের বয়সের প্রাচীন সাক্ষী হয়ে আছে। এ ছাড়া জাতীয় দিবসগুলোতে শিক্ষার্থীরা ফলদ, বনজ, ঔষধিসহ ফুল গাছের চারা রোপণ করে। স্কুলের সামনে আছে খেলার মাঠ।
একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে অংশ নেয়। স্কুলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ করেন। যার নাম হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু। যেখানে শিশুর সৃষ্টিশীল মনোবিকাশের ধারা তৈরি করে দেয়া হয়। তারা গল্প, কবিতা, ভ্রমণ কাহিনী লেখে। পাঠদান শেষে এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটিজে শিশুর সৃষ্টিশীল কাজ ধরে রাখার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
যেমন কেউ আবৃত্তি, কেউ গান, কেউ নাটক, কেউ খেলাধুলা করে। এ জন্য স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ ১৪ শিক্ষক পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন। কোভিড-১৯ কালে স্কুলের শিক্ষার্থীরা ক্লাস্টার ভিত্তিক লিংক নিয়ে অনলাইনে পাঠ গ্রহণ করেছে। ওয়ার্কশীট (বাড়িতে পড়তে দেয়া) কার্যক্রম এখনও চালু আছে।
প্রধান শিক্ষক জেসমিন আরা বললেন, স্কুলটির অবস্থান এমন স্থানে যার বড় একটি অংশে নি¤œ আয়ের মানুষের বাস। ড্রপ আউট রোধে প্রত্যেক শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে উদ্বুদ্ধকরণ করতে হয়েছে। শিক্ষার্থীদের বাল্যবিয়ে রোধে বিশেষ ভূমিকা নেয়া হয়। বর্তমানে স্কুলের উপস্থিতির হার ৮৮ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশ।
কোন শিক্ষার্থী দীর্ঘ সময় স্কুলে না এলে বাড়িতে খোঁজ করা হয়। অভিভাবকদের বোঝানো হয়। স্কুলে নিয়মিত মা সমাবেশ, অভিভাবক সমাবেশের পাশাপাশি বাড়ি বাড়ি গিয়ে উঠান বৈঠক করা হয়। শিক্ষকরা বলেন, অনেকের ধারণা আছে, সরকারী প্রাথমিক স্কুলে লেখাপড়া ভাল হয় না। এই স্কুল সে ধারণা ভেঙ্গে দিয়েছে। প্রতিবছর এই স্কুল অধিক সংখ্যক বৃত্তি পাচ্ছে। স্কুলের শিক্ষার্থীদের একই রঙের পোশাক আছে। শিক্ষার অগ্রসরতায় স্কুলের ধারের বস্তির নামাপাড়া এলাকার নামকরণ হয়েছে শান্তিবাগ। এলাকার মানুষের মধ্যে স্কুলটি সচেতনতা বাড়িয়ে দিয়েছে। স্কুলকে কেন্দ্র করেই শান্তিবাগ নাম এমন কথা বললেন জনপ্রতিনিধি।
স্কুলে এখনও থারমাল স্ক্যানার, হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখা আছে। শিশুরা ব্যবহার করে উন্নত ওয়াশ রুম, কয়েকটি বেসিন। সততা স্টোরে শিশুরা পণ্য কিনে নির্দিষ্ট স্থানে অর্থ বিনিময় করে। প্রতিবছর স্টুডেন্ট কাউন্সিল নির্বাচন হয় জাতীয় নির্বাচনের মতো।
এ বছর ১৮ প্রার্থীর মধ্যে ৬ জন বিজয়ী হয়েছেন। স্কুলের শিক্ষার্থী মাইসা, মাহিম, সুমাইয়া, হৃদয়, আবেগ, মারুফ বলল : আমরা জেলা স্কুলের মতো ভাল স্কুলে পড়ি। আমরা কম্পিউটার জানি। তাদের কথায় যে কেউ মনে করতে পারে, এরা ডিজিটাল যুগের প্রজন্ম।
সমুদ্র হক, বগুড়া