ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ জুলাই ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সূতিকাগার

শাহরিয়ার নাজিম সীমান্ত

প্রকাশিত: ২১:১৬, ৫ জুলাই ২০২৫

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সূতিকাগার

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে একটি ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটেছে

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে একটি ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটেছে। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর থেকেই ধীরে ধীরে জনসম্পৃক্ততা হারাতে শুরু করে বিগত সরকার। একসময় এটি জনবিস্ফোরণে রূপান্তরিত হয়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান সেই জনবিস্ফোরণ যা দেশের জনগণকে পূর্ণ স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের শাসনামলে নানা আন্দোলন ও প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর সরকার নানা প্রচেষ্টায় দমাতে সক্ষম হলেও, কোটা নিয়ে চলমান বৈষম্য দেশের তরুণদের একত্রিত করে, সারা দেশে গণজোয়ার তৈরি করে এবং একটা সময়ের পর গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়।
২০২৪ এর জুলাইয়ের আন্দোলনটি শুরু হয় কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে। পরবর্তীতে এটি ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয় এবং তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটায়। এটি যেমন আওয়ামী লীগের গত ১৬ বছরের অপশাসনের ফলাফল বয়ে এনেছে, একইসঙ্গে দেশে নতুন গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা সৃষ্টি করেছে এবং জনগণকে নতুন সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনে একাত্ম করেছে। 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের পুরোপুরি বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আন্দোলনে হলের আবাসিক শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বন্ধ করতে সিট বাতিলের হুমকি, গেস্টরুমগুলোতো মানসিক ও শারীরিক লাঞ্ছনা, দলীয় প্রোগ্রামগুলোতে দীর্ঘ সময় আটকে রাখাসহ নানান প্রচেষ্টা চালিয়েছে। আন্দোলন চলাকালে হলের মূল ফটক বন্ধ রাখার মতো ঘটনাও ঘটেছে। ছাত্রলীগের এই ধরনের আগ্রাসন ও নিপীড়ন শিক্ষার্থীদের আরো অনেক বেশি সংগঠিত করেছে ও আওয়াজ উঠাতে সাহায্য করেছে।
১৪ জুলাই, চীন ফেরত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে বিতর্কিত মন্তব্য করেন এবং শিক্ষার্থীদের রাজাকারদের সাথে তুলনা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা সেদিন রাতেই এই ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানায়। বিশেষত রোকেয়া হলের মেয়েরা সর্বপ্রথম জড়ো হয়ে স্লোগান দিতে থাকে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল থেকে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী রাজু ভাস্কর্যে একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ জানায়।

‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ স্লোগানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। এ ঘটনা সারাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ও পরদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এর ব্যানারে দেশব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়।
১৪ জুলাই রাতের ঘটনায় ঢাবি শিক্ষার্থীদের দমাতে ১৫ জুলাই ঢাকার আশপাশে থেকে ছাত্রলীগ এর ভাড়াটে কর্মীরা সরকারি ইশারায় ঢাবি ক্যাম্পাসে একত্রিত হয় এবং দুপুরের ঠিক পরপরই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে আক্রমণ করে। সেদিন গভীর রাত পর্যন্ত ঢাবি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের উপর আক্রমণ চলতে থাকে। রক্তাক্ত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ।

নির্বিচারে আক্রমণ, সন্ত্রাসী কায়দায় আন্দোলন দমন এর ছবি-ভিডিও তড়িৎ গতিতে দেশের সকল সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছড়িয়ে পড়ে এবং জনমনে চরম উত্তেজনা তৈরি করে। বিশেষত নারী শিক্ষার্থীদের উপর আক্রমণের ঘটনা সারাদেশের মানুষকে স্পর্শ করে ও প্রতিবাদী হয়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করে।
আন্দোলনে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ অবিস্মরণীয় এবং ১৬ জুলাই ঢাবি রক্তাক্ত হওয়ার পর থেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রায় একা হাতে আন্দোলনে এগিয়ে নিয়েছে। ১৮ জুলাই এর পর থেকে নানা পেশাজীবীর মানুষ, রিক্সাচালক, দিনমজুর, গার্মেন্টস শ্রমিকসহ দেশের সর্বস্তরের জনগণ এ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে ও রাস্তায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীরা এক দফা ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে। এবং দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন শিক্ষার্থীরা। 
এই গণ-অভ্যুত্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ ইতিহাসে সমুজ্জল হয়ে থাকবে। একটি গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই আপোসহীন ভূমিকা রেখেছে। জ্ঞানভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আমাদের অনেক ঋণ। বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক মুক্তি ও সংগ্রামের আন্দোলনে প্রতিষ্ঠানটির অসামান্য ভূমিকা রয়েছে।

একইসঙ্গে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছে। বর্তমানে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের জনগণের আকা-আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতীক হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। কবি সুকান্তের ভাষায় আশা রাখছি, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চর্চা, ন্যায় বিচার ও জনগণের অধিকার সুরক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চরম অস্থিরতার দিনেও দুঃসাহসের সঙ্গে পথ দেখাবে, কখনোই মাথা নোয়াবে না।

×