ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ জুলাই ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২

ইতিহাস-ঐতিহ্য-গৌরবের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মোতাহার হোসেন

প্রকাশিত: ২১:১২, ৫ জুলাই ২০২৫

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এক আলোকবর্তিকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

১৯২১ সালের ১ জুলাই, ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে যাত্রা শুরু করে এক আলোকবর্তিকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শতাব্দী পেরোনো এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এটি বাংলাদেশের জাগরণের ইতিহাস, সংস্কৃতি আর সংগ্রামের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। এই ক্যাম্পাস শুধু একাডেমিক জ্ঞানচর্চার স্থান নয় এটি এক বিশাল মানবিক চেতনার মঞ্চ। যেখানে বইয়ের পাতার বাইরে গড়ে ওঠে সমাজ বদলের দৃষ্টান্ত, প্রতিবাদের ভাষা এবং ভাবনার পরিসর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালগুলো যেন কথা বলে, বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলে আমরাই পথ দেখাই, আমরাই পথ তৈরি করি।
দেশের প্রয়োজনে নিজেকে উৎসর্গ করাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার নিজ দায়িত্ব হিসেবে কাঁধে তুলে নিয়েছে। যে কোনো সংকটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে দেশ ও জাতি এটাই আশা করে। সাংবাদিক এবং গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদও তার বইয়ে লিখেছেন, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের ইতিহাস আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস অবিচ্ছেদ্য।


ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়। এই আন্দোলনের কেন্দ্রে ছিল ঢাকার প্রাণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীদের চেতনা, প্রতিবাদ এবং আত্মদানের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টি হয়ে ওঠে ভাষা সংগ্রামের মূল চালিকাশক্তি।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পর ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবি করে হরতাল ও বিক্ষোভ হয়। এরপর শুরু হয় আন্দোলনের ধারাবাহিকতা। তবে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল এই সংগ্রামের চূড়ান্ত প্রকাশ। সরকার কর্তৃক ১৪৪ ধারা জারি করা হলেও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহসী ছাত্ররা সেই আদেশ অমান্য করে রাস্তায় নামে। 

মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় ভূমিকা

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ কেবল একটি স্বাধীনতা সংগ্রাম নয়, এটি ছিল জাতির অস্তিত্ব ও আত্মপরিচয়ের জন্য এক সশস্ত্র লড়াই। এই সংগ্রামের সূচনালগ্ন থেকে বিজয় পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রণী ভূমিকা। রাজনৈতিক সচেতনতা, বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব ও রক্তাক্ত আত্মত্যাগÑ সব মিলিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চালিকাশক্তি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী “অপারেশন সার্চলাইট” নামে যে গণহত্যা চালায়, তার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেদিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে, জগন্নাথ হলে, রোকেয়া হলে ও বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় ঢুকে তারা নির্বিচারে ছাত্র-শিক্ষক হত্যা করে।  মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিণতির পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। এটি শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং জাতির স্বাধীনতার প্রতীক এবং সংগ্রামী চেতনার উৎসস্থল।

৯০’র স্বৈরাচার পতন 

বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ইতিহাসে ১৯৯০ সাল ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে এই বছরই, আর এই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল দেশের সূর্যসন্তানেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষক সমাজ।
১৯৮২ সালে সেনা প্রধান হিসেবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী আট বছর ধরে দেশে চলতে থাকে দমননীতি, বাকস্বাধীনতার হরণ ও রাজনৈতিক নিপীড়ন। এই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে ছাত্র সমাজ একের পর এক কর্মসূচি গ্রহণ করে জাতীয় রাজনীতিকে নাড়িয়ে দেয়।
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান 

২০২৪ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নাটকীয় পরিবর্তন আসে, যার কেন্দ্রে ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন, পরিণতিতে গণ-অভ্যুত্থান এবং শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন। এই পুরো ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দু ছিল একটাই- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাবির ছাত্ররা এই আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি। সরকার শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমনে লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল, গ্রেপ্তারসহ নানা পদক্ষেপ নেয়। এতে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ আরও বাড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর বর্বর হামলার ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

এক পর্যায়ে আন্দোলন শুধু কোটা সংস্কার নয়, বরং সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনকালকে “একনায়কতান্ত্রিক”, “নির্বাচনবিহীন” এবং “অসাংবিধানিক” বলে উল্লেখ করে শিক্ষার্থীরা সরাসরি পদত্যাগ দাবি করতে শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে ঢাকার রাজপথে লাখো মানুষের জমায়েত হতে থাকে। সারাদেশে শুরু হয় রোডমার্চ, হরতাল, অবরোধ, যা এক পর্যায়ে রূপ নেয় সম্পূর্ণ গণ-অভ্যুত্থানে। দেশজুড়ে চাপ, সরকারি অব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা বাহিনীর একাংশের অনুগত্য হারানো এবং আন্তর্জাতিক মহলের কূটনৈতিক চাপের ফলে শেখ হাসিনা পদত্যাগে বাধ্য হন।

শিক্ষার্থীদের বক্তব্য

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুবাশ্বির আলম বলেন, বাঙালি মুসলমানদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি ও পূর্ববাংলার অবহেলিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নকে লক্ষ্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার শত বছরের যাত্রায় শুধুমাত্র একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রধান চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। তবে, তবে সময়ের সাথে কিছু ব্যর্থতাও দেখা গেছে। যেমন, শতবর্ষ পার হলেও পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হতে না পারা, রাজনৈতিক প্রভাব, দলাদলি, গবেষণায় কাক্সিক্ষত আন্তর্জাতিক মান বজায় না রাখা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতার অভাব ইত্যাদি। এসব বিষয়ে যদি সমাধান করা যায় তাহলে এ বিশ্ববিদ্যালয় বৈশ্বিক র‌্যাংকিং এ ভালো করবে। 

শাখাওয়াত হোসেন সাকু নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু আমাদের শিক্ষার কেন্দ্র নয়, এটি আমাদের চিন্তা, অধিকার আর প্রতিবাদের জায়গা। একশ বছর আগের যে উদ্দেশ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আমরা মনে করি আজও সেটি প্রাসঙ্গিক। সময়ের বিবর্তনে এই বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং এটি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক জাগরণের কেন্দ্রবিন্দু। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ এবং সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দিয়েছেন বলেই আজ অনেক অর্জন সম্ভব হয়েছে।

শিক্ষাক্ষেত্রে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য দেশের অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থার নেতৃত্বে এখানকার সাবেক শিক্ষার্থীরা রয়েছেন। তবে কিছু সমালোচনাও আছে। সময়ের সঙ্গে গবেষণার মানে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে। 
রাজনৈতিক দলীয়করণ, প্রশাসনিক অদক্ষতা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং শিক্ষার গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। অনেক শিক্ষার্থী মনে করেন, প্রতিষ্ঠানটির মূল চেতনা এবং শিক্ষার পরিবেশ কিছুটা ক্ষয়ে গেছে। তবু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজও দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষার প্রতীক এবং জাতীয় চেতনার বাতিঘর। প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পেরিয়ে ভবিষ্যতে আরও আধুনিক, গবেষণাভিত্তিক ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠার প্রত্যাশা সবার।

×