ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২

ঢাকার দুই লাখের অধিক ভূমি মালিক ক্ষতিগ্রস্ত

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০০:৪৩, ২৭ জুলাই ২০২৫

ঢাকার দুই লাখের অধিক ভূমি মালিক ক্ষতিগ্রস্ত

ঢাকা শহরের দুই লাখের বেশি ভূমি মালিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন

বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের ত্রুটিপূর্ণ ড্যাপ ২০২২-২০৩৫ ও বৈষম্যমূলক ফারের (এফএআর) কারণে ঢাকা শহরের দুই লাখের বেশি ভূমি মালিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। একটু একটু করে জমানো আজীবনের সঞ্চয়, পেনশনের টাকা কিংবা ব্যাংক ঋণ করে স্বপ্নের এক টুকরো জমি কেনাই এখন ভূমি মালিকদের জন্য দায় হয়ে পড়ছে। কারণ তারা সেই জমিতে বাড়ি নির্মাণ করতে পারছে না। আবাসন উন্নয়ন প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। ফলে ভূমি মালিকদের কয়েক লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়েছে। 
এছাড়া বৈষম্যমূলক ড্যাপের কারণে দ্রুত বাড়ছে ফ্ল্যাটের দাম এবং বাড়ি ভাড়া। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা ২০০৮ অনুসারে ভবন নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন ঢাকার ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিক সমিতির নেতারা। ক্ষতিগ্রস্ত ঢাকার ভূমি মালিক সমিতি ঢাকা সিটি ল্যান্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক প্রফেসর ড. দেওয়ান এম. এ. সাজ্জাদ জানিয়েছেন, ড্যাপ ২০২২-২০৩৫ এ ঢাকা শহরের মাত্র ২০ শতাংশ পরিকল্পিত এরিয়ায় সু-উচ্চ ভবন নির্মাণের ব্যবস্থা রেখে অবশিষ্ট ৮০ শতাংশ এরিয়াকে অপরিকল্পিত এরিয়ার ট্যাগ দিয়ে ভবনের উচ্চতা ও আয়তন হ্রাস কমিয়ে দেওয়া হয়। ফলে এই শহরের প্রকৃত ভূমি মালিকরা ভবন নির্মাণ করতে পারছেন না। নতুন করে কোনো ভবন নির্মাণ করতে গেলে সমস্যা তৈরি হচ্ছে।

একই পরিমাণ জমিতে আগে যেখানে ১০ তলা ভবন হতো ফার ইস্যুতে এখন সেখানে ৫ তলা ভবন পাওয়া যাচ্ছে। এতে ব্যাপক ক্ষতি ও চরম বৈষম্যের সম্মুখীন হচ্ছে জমির মালিকরা। এতে ঢাকা শহরের প্রকৃত ভূমি মালিকদেরকে এই শহরের বাহিরে বের করে দেওয়ার সূক্ষ্ম পরিকল্পনা করা হয়েছে। ত্রুটিপূর্ণ ড্যাপ ২০২২-২০৩৫ ও বৈষম্যমূলক ফারের (এফএআর) সংশোধন চান ভূমি মালিকরা। অভিযোগ করে আরও বলেন, রাজধানীকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তোলার ট্যাগ দিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে রাজউকের কতিপয় কর্মকর্তার ছত্রছায়ায় ২০২২ সালের ২৩ শে আগস্ট ড্যাপ ২০২২-২০৩৫ প্রণয়ন করা হয়।

ঢাকা শহরের বহুবিধ সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে একমাত্র ভবন নির্মাণের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে এটা করা হয়। যা নাগরিকদের মধ্যে বিশাল বৈষম্য সৃষ্টি তৈরি করে। অভিযোগ রয়েছে, বৈষম্যমূলক ড্যাপ তৈরি করেছে কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা মিলে। ভূমির মালিকদের অভিযোগ, ড্যাপের নামে রাজউক বিভিন্ন এলাকায় হঠাৎ করে প্লটের ব্যবহারযোগ্যতা কমিয়ে দিয়েছে। কোথাও খোলা জায়গা বা রাস্তার নামে জমি অন্তর্ভুক্ত করে মালিকদের আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলা হয়েছে।

ঘুষ ছাড়া প্ল্যান পাস করানো যাচ্ছে না। অন্যদিকে ড্যাপ পরিবর্তন না করার কারণে নির্মাণ কাজ থেমে যাওয়ার ‘ধারণা ভুল’ বলে মনে করেন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম। তিনি সম্প্রতি এক আলোচনা সভায় বলেন, একটা ভুল ধারণা আছে, যে ড্যাপ পরিবর্তন না করার কারণে নির্মাণ কাজ থেমে আছে, বাস্তবে তা নয়। আমরা রাজউক থেকে প্রতিনিয়ত নিয়ম মেনে নির্মাণ অনুমোদন দিচ্ছি। নক্সা অনুযায়ী সরেজমিনে যতটুকু রাস্তা আছে তা মেনেই আমরা নির্মাণ অনুমোদন দেব।

উল্লেখ্য, ফার কমিয়ে দেওয়ার ফলে ভূমি মালিকগণ ভবন নির্মাণে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। ফলশ্রুতিতে পাড়া-মহল্লার রাস্তা-ঘাটগুলো অপ্রশস্তই থেকে যাচ্ছে এবং ফাঁকা জায়গাগুলো/সেমিপাকা জায়গাগুলো/পুরাতন জরাজীর্ণ ভবনগুলো অস্থাস্থ্যকরই থেকে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি কর্মসংস্থান হ্রাস পাচ্ছে, কারণ নির্মাণ কাজ কমে যাওয়ায় শ্রমিকরা কর্মসংস্থান হারাচ্ছেন। ফ্ল্যাটের দাম এবং বাড়ি ভাড়া দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের জন্য আবাসনের সুযোগ আরও কঠিন করে তুলছে। জমির মালিকরা তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। 
এই পরিস্থিতিতে, ঢাকা শহরের ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিক সমিতি ড্যাপের বিধিমালা সংশোধন করে একটি জনবান্ধব ড্যাপ প্রণয়নের দাবি জানাচ্ছে। তারা মনে করেন, বর্তমান ড্যাপে কিছু দুর্বলতা রয়েছে, যা সংশোধন করা প্রয়োজন। ভূমি মালিক তানভীরুল ইসলাম বলেন, যে ড্যাপ কৃষি জমি ধ্বংস করে, জলাধার ধ্বংস করে পরিবেশের বিপর্যয় ডেকে আনে সেই ড্যাপ বাতিল চাই।

ভূমি মালিক আমিনুর রহমান বলেন, ‘পতিত সরকারের কতিপয় দোসরদের প্রেসক্রিপশনে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে তড়িঘড়ি করে দেশের স্বার্থবিরোধী বেআইনি ড্যাপ ২০২২-২০৩৫ প্রকাশ করা হয় এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কেড়ে নেওয়া হয় ঢাকা মহানগরের ভবন নির্মাণের অধিকার।’ তিনি বলেন, নগরবাসীর মধ্যে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সৃষ্টি করা হয় চরম বৈষম্য। যার ফলে কৃষি জমি ও বন্যা প্রবাহ এলাকা দ্রুত গতিতে হ্রাস পাচ্ছে।

ভূমি মালিকদের নেতা এজাজ খান বলেন, এই বৈষম্যমূলক ড্যাপের জন্য এখনো পতিত স্বৈরাচারী সরকারের সুবিধাবাদী কয়েকজন নগর পরিকল্পনাবিদ মায়াকান্না করে বেড়াচ্ছেন। তারা একটি মহলের হয়ে ঢাকা থেকে নাগরিকদের বের করে দিতে চাচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রেজাউল ইসলাম বলেন, পরিতাপের বিষয়, দেশের আইন হয় জনস্বার্থে, জনস্বার্থ পরিপন্থি হলে হয় না। প্ল্যান অনুমোদন নিতে হয়, নক্সা নিতে একেক সময় একেক আইন করা হয়। প্রকৃত অবস্থা দেখে আইন করে না। অন্যদের কথায় করা হয়। 
তিনি বলেন, গুলশান, বারিধারায় এক আইন আর অন্য এলাকায় আরেক আইন- এটা হয় না। ২০০৮ সালের যে আইন কার্যকর ছিল সেটাই যথাযথ ছিল। বিনা টাকায় নক্সা হয় না, নক্সার জন্য আবেদন করা হলে এক মাসের মধ্যে পাশ করা সম্ভব। কিন্তু টাকা না হলে মাসের পর মাস ফেলে রাখা হয়।

প্যানেল হু

×