ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২

সুচের ফোঁড়ে অর্থনীতি চাকা ঘোরে

এস এম মুকুল

প্রকাশিত: ২১:২৪, ২৬ জুলাই ২০২৫

সুচের ফোঁড়ে অর্থনীতি চাকা ঘোরে

নকশিকাঁথার চাহিদা

যুগে যুগে বাংলাদেশের নারীরা গৃহের কাজের অবসরে মায়াবী হাতের সুনিপুণতায় চিত্রিত করেছেন মা, মাটি, মানুষ আর ভালোবাসার প্রতিকৃতি। বলছিলাম সুচি শিল্পের কথা। দৃষ্টির আড়ালে থাকা এই বিশাল সম্ভাবনাময় শিল্পকে জাগিয়ে তুলেছেন বাংলার নারীরা। তাদের সুনিপুণ হাতের কাজ করেছে বিশ্বজয়। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাড়ছে নকশিকাঁথার চাহিদা। সে সঙ্গে বাড়ছে সুনামও। এক সময় গ্রামের নারীরা পরিবারের প্রয়োজনে নকশিকাঁথা তৈরি করতেন।

এখন রাজশাহী, রংপুর, বগুড়া, পাবনা, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, যশোর এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও সিলেট অঞ্চলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তৈরি হচ্ছে নকশিকাঁথা। এই নকশিকাঁথা শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নকশিপল্লী। আর এই সুবাদে স্বাবলম্বী হচ্ছেন নারীরা। নকশিকাঁথা এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। আর রপ্তানির সুবাদে ডলার আসছে বিদেশ থেকে। 
নকশিকাঁথার এলাকা ময়মনসিংহের জামালপুর। জামালপুরের চোখ জুড়ানো নকশিকাঁথা শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও সুনাম কুড়াচ্ছে। কর্মদক্ষ মহিলা উদ্যোক্তারা জামালপুরে গড়ে তুলেছেন শতাধিক ছোট-বড় সুচিশিল্প প্রতিষ্ঠান। এছাড়া রয়েছে ব্র্যাক পরিচালিত আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন। এ প্রতিষ্ঠানে ২০ হাজারের বেশি গ্রামীণ দরিদ্র মহিলা কাজ করছেন। তৈরি করছে বেড কাভার, বটুয়া, হ্যান্ডপার্স, কয়েন পার্স, ভ্যানিটি ব্যাগসহ নানা দ্রব্য। জামালপুরের নকশিকাঁথার শো রুম রয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো দেশের বড় বড় শহরে।
তখন ১৯৮৫ সাল। যশোরের শার্শা উপজেলায় ১৬ জন মহিলা নিয়ে জাপান-বাংলাদেশ কালচারাল এক্সচেঞ্জ অ্যাসোসিয়েশন (জেবিসিইএ) যাত্রা শুরু করে নকশিকাঁথা প্রকল্পের। তারপর ১৯৯৭ সালে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয় এই প্রকল্পটি। ধীরে ধীরে এগুতে থাকে গ্রাম বাংলার নারীদের স্বপ্নগাঁথা নকশিকাঁথার গল্প। ক্রমশ নকশিকাঁথা হয়ে ওঠে বাংলার গর্বগাথা। বর্তমানে শার্শার নিশ্চিন্তপুর ও পশ্চিম কোটা গ্রামসহ প্রায় ১০টি গ্রামের চারশ’ গৃহবধূ এবং স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীরা পড়াশোনা আর গৃহকর্মের পাশাপাশি তৈরি করছেন চিরায়ত বাংলার গর্বগাথা এই নকশিকাঁথা।

এসব কাঁথা চলে যাচ্ছে জাপানের টোকিও শহরে। সেখানে রয়েছে রসুন নামে একটি বিক্রয়কেন্দ্র। সেখান থেকে বিভিন্ন দেশের মানুষ এই আকর্ষণীয় নকশিকাঁথা কিনে নেয় উচ্চমূল্যে। নাভারনের নিশ্চিন্তপুর গ্রামে ১৫০জন মহিলার নকশিকাঁথা কার্যক্রম দেখাশোনা করেন দলের সভানেত্রী তাসলিমা বেগম। তাসলিমা লাউ ডিজাইনের ওপর হাতের কাজ করে সুনাম অর্জন করেছেন। 
স্বাবলম্বী হচ্ছেন অনেক গৃহবধূ। সচ্ছলতা আসছে অনেক টানাপোড়েনের সংসারে। চাহিদা অনুযায়ী নিত্যনতুন আকর্ষণীয় ডিজাইনের দস্তরখান, বেড কাভার, হাত ব্যাগ, ওয়াল ম্যাট ও টেবিল ক্লথ থেকে শুরু করে সুচ ও সুতা দিয়ে তৈরি হয় অনেক জিনিস। মহিলাদের সুচের ফোঁড়ে ফোঁড়ে টাকা আসছে বিদেশ থেকে। যা কেউ কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। বাস্তবে ঘটছে তাই। বিদেশিদের কাছে বাংলার সুচিশিল্প পণ্যের কদর বেড়েছে বহুগুণে। 
গ্রামবাংলায় কাঁথা সেলাইয়ের ঐতিহ্য বহুকাল আগের। পুরনো শাড়ি ও লুঙ্গি মাটিতে বিছিয়ে চারদিকে খেজুরের কাঁটা দিয়ে বাড়ির মহিলারা অবসর সময়ে নিজেদের প্রয়োজনে কাঁথা সেলাই করেন। নতুন কাঁথা বিছিয়ে অতিথিকে বসতে দেয়ার রেওয়াজ গ্রামে রয়েছে এখনো। গ্রামে বেকার, অভাবী, দুস্থ ও অসহায় মহিলারা সূচিশিল্পের জন্ম দেয়। সেই ইতিহাস অনেক পুরানো কথা। তারই ধারাবাহিকতায় যশোরে নকশিকাঁথা ও সূচিশিল্প গড়ে ওঠে। যার নামকরণ হয় ‘যশোর স্টিচ’।

যশোর থেকে সূচিশিল্প পণ্য রফতানি হচ্ছে নরওয়ে, ডেনমার্ক ও সুইডেনসহ বিভিন্ন দেশে। সংসারের কাজকর্ম করার পরও বাড়তি অর্থ প্রতিটি পরিবারে এনে দিয়েছে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে যশোরের নকশিকাঁথা। যশোর শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে বাঘারপাড়া উপজেলার খাজুরার পান্থাপাড়া। ধীরে ধীরে এলাকার দুস্থ, অভাবী ও অসহায় মহিলারা নকশিকাঁথা শিল্পে জড়িত হয়ে পড়েন। একটি কাঁথা সেলাই করতে একজন মহিলার সময় লাগে ১৫/১৬ দিন।

কয়েকজন মিলে করলে তা ২/১ দিনেই হয়ে যায়। ঘন ডিজাইনের নকশিকাঁথা সেলাইয়ের জন্য একজন মহিলা ১ হাজার ৮শ’ টাকা পাচ্ছেন। কাপড়, সুতা ও সেলাইসহ একটি নকশিকাঁথা তৈরি করতে খরচ হয় ৩ হাজার টাকা। বিদেশে বিক্রি হয় উচ্চমূল্যে। ঘন ও ভালো ডিজাইনের নকশিকাঁথা বিদেশের বাজারে ১৮-২০ হাজার টাকায়ও বিক্রি হয়।

প্যানেল হু

×