
বিমা গ্রাহকদের আমানতের সুরক্ষা
বিমা গ্রাহকদের আমানতের সুরক্ষা এবং বিমা কোম্পানিগুলোকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে ২০১৯ সালে ইউনিফাইড মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম (ইউএমপি, পরবর্তীতে আইআইএমএস নামকরণ) চালু করে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। বিগত সরকারের আমলে কেউ এ নিয়ে টুঁ শব্দ না করলেও ৫ আগস্ট পরবর্তী এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় বিমা খাতের প্রায় সবগুলো কোম্পানি। তোলা হয় অনিয়মের অভিযোগ। শুধু তাই নয়, আইডিআরএ’কে এই বাবদ অর্থ প্রদান থেকেও বিরত থাকে কেউ কেউ।
এমন পরিস্থিতিতে আইডিআরএ’র পক্ষ থেকে কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে তথ্য গোপনের পাল্টা অভিযোগ তোলা হলেও প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে তথ্য বেহাতের শঙ্কা প্রকাশ করা হয়। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থার মনিটরিং ও সুপারভিশনের খরচ কোম্পানিগুলোর তহবিল থেকে দিতেও নারাজ। ফলে আইআইএমএস নিয়ে আইডিআরএ এবং বিআইএ ও কোম্পানিগুলোর এমন টানাপড়েনে চলছে স্থবিরতা।
বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার একটি সূত্রে জানা গেছে, বিমা খাতের দীর্ঘদিনের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিতার অভাবের কারণে গ্রাহকদের মধ্যে এক ধরনের আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়। ফলে খাতের উন্নয়ন, নিয়ন্ত্রণ সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ গ্রাহক সুরক্ষা নিশ্চিতে জাতীয় বিমা নীতি ২০১৪ অনুসারে ‘ইলেকট্রনিক ডাটা ও তথ্যের বিনিময় চালুকরণ’ নিশ্চিতে চালু করা হয় ইউনিফাইড মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম বা ইউএমপি। কিন্তু সে সময় এই সিস্টেম পরিচালনায় দক্ষ জনবল ও আনুষঙ্গিক সুবিধা নিয়ন্ত্রক সংস্থার না থাকায় আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ২০১৯ সালে এই কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
ইউএমপিতে শুধু গ্রাহকদের মোবাইলে মেসেজই পাঠাত না। বরং পলিসি সংক্রান্ত ডিজিটাল তথ্যভা-ার, ই-রিসিপ্ট, ই-মেইল নোটিফিকেশন, তথ্য যাচাইয়ের প্রমাণক, ই-কেওয়াইসি, বিমা গ্রাহককে তার পলিসিসংক্রান্ত তথ্যের জন্য পোর্টাল, বিমা তথ্য মোবাইল অ্যাপ, বিমা এজেন্টদের অনলাইনে নিবন্ধন এবং বিজনেস ইন্টেলিজেন্স টুলস ব্যবহারের সুযোগ থাকত।
এর মাধ্যমে শুধু যে গ্রাহকরা বা বিমা কোম্পানি উপকৃত হতো তা নয়, নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আইডিআরএ’ও কোম্পানিগুলোর তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে পেয়ে যাওয়ায় কার্যক্রম মনিটরিং ও অফসাইট সুপারভিশনের কাজটি সহজ হতো। এতে বিমা খাতে অনিয়ম বন্ধসহ সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির সুযোগ ছিল বলে জানানো হয় সংস্থাটির তরফে। একইসঙ্গে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধেও এই ব্যবস্থাটি কাজ করত।
কিন্তু গত ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এই সিস্টেমের বিপরীতে অর্থ ও তথ্য প্রদান বন্ধ রাখে বিমা কোম্পানিগুলো। অভিযোগ ওঠে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সিস্টেম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ‘দুয়ার সার্ভিসেস লিমিটেড’কে নিয়োগ না করার। ফলে পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানটির কাছে সামগ্রিক বিমা খাত ও গ্রাহকের তথ্য সুরক্ষিত থাকবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়।
কোম্পানিগুলো বলছে, যে কোম্পানিটি আইআইএমএস সেবা দিচ্ছে তাদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় কাজ দেওয়া হয়নি। কোনো দরপত্র আহ্বান ছাড়াই কাজটি দেওয়া হয়েছে দুয়ার সার্ভিসেস লিমিটেডকে, যাদের এ ধরনের কার্যক্রমের কোনো পূর্ব ইতিহাস নেই। ফলে বিমা কোম্পানির স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসহ গ্রাহকের তথ্যগুলোও বেহাত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। যদিও তথ্য সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেওয়া নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব, কিন্তু প্রতিষ্ঠানের গোপনীয়তা রক্ষা করাও আমাদের দায়িত্ব।
আমরা নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে অবশ্যই তথ্য দেব, কিন্তু তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে নয়। অপরদিকে আইআইএমএসের মাধ্যমে বিমা কোম্পানির মনিটরিং ও অফসাইট সুপারভিশন সম্পর্কে বিমা কোম্পানিগুলোর বক্তব্য, আইআইএমএস বাবদ কোম্পানিগুলো থেকে যে ফি নেওয়া হয় সেটা বিমা কোম্পানিরগুলোর জন্য চাপ তৈরি করে। বিমা খাত মনিটরিং ও সুপারভিশন আইডিআরএ’র কার্যক্রমের অধীন।
আইডিআরএ’র এই কার্যক্রম পরিচালনায় কোম্পানিগুলো থেকে অর্থ প্রদান গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এমনিতেই প্রতিবছর কোম্পানিগুলো একটি নির্দিষ্ট হারে ফি প্রদান করে বিমা কোম্পানিকে। কাজেই এই কার্যক্রম পরিচালনায় যাবতীয় সবকিছুই আইডিআরএ’র নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় করা উচিত।
নাম গোপন রেখে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং ২য় প্রজন্মের একটি বিমা কোম্পানির সিইও বলেন, আইআইএমএস সেবার জন্য আইডিআরএ যে তৃতীয় পক্ষকে নির্ধারণ করেছে, এক্ষেত্রে সরকারি ক্রয় নীতিমালা অনুসরণ করেনি। কোনো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন/দরপত্র দেয়নি এবং অন্যূন ৩ সদস্যের একটি কমিটি থাকতে হয়, সেটাও করেনি। এরপর যে কাজ আইডিআরএর করার কথা নয়, যেমন গ্রাহককে মেসেজ দেওয়া- সেটাও তারা করেছে।
আবার আইডিআরএ’র সুবিধার্থে এই সিস্টেম চালু হলেও তারা প্রতিটি পলিসির বিপরীতে ৩ মাস পরপর একটি ফি নিত, এটা কোম্পানিগুলোর খরচ বাড়িয়ে ফেলেছে। আমি প্রথম থেকেই এ বিষয়ে আপত্তি করেছিলাম, কিন্তু তা টেকেনি, কারণ সরকারের একটি বিশেষ সংস্থা থেকে আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল এটা করতে।
এখন ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর আমরা ইড্রাকে জানিয়েছি আমাদের যে কাজ সেটা আমাদের করতে দেন এবং আপানারা আমাদের মনিটরিং করেন কিন্তু প্রতি পলিসির বিপরীতে মনিটরিং খরচ আমরা কেন দেব? তিনি বলেন, যতদূর জানি বাংলাদেশের বিমা খাত উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন হয়েছে এবং সেই অর্থায়নে দুটি সফটওয়্যার তৈরি করার কথা। যদি এগুলো হয়ে যায়, তাহলে আমাদের কোম্পানিগুলো থেকে তো টাকা নেওয়ার প্রয়োজন নেই।
কোম্পানিগুলো আইআইএমএসের বিরোধিতা করছে মূলত তথ্য গোপনের স্বার্থে এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা সত্যি যে আমাদের অনেক কোম্পানিই বিগত সময়ে কিছু কিছু তথ্য আইডিআরএকে দেয়নি। এটা বিআইএ’র সঙ্গে আলোচনা করেই করেছে। কারণ যে তৃতীয় পক্ষকে নির্ধারণ করা হয়েছে তার মাধ্যমে যে আমাদের তথ্য গোপন থাকবে তার নিশ্চয়তা কি? সরকারি নীতিমালা না মানায় এখানে কোনো ভালো কোম্পানি আসেনি। ফলে যেনতেন একটি কোম্পানিকে তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে আনা হয়েছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আইডিআরএ তথ্য চাইতেই পারে, কিন্তু একটা তৃতীয় পক্ষকে আমরা তথ্য কেন দেব? কারণ তারা তো ডাটা বিক্রিও করে দিতে পারে অন্য কারো কাছে। বিআইডিপি’র মাধ্যমে আমাদের কাছে তথ্য চাইলে আমরা দেব। আমরা ইড্রার আইনসঙ্গত নির্দেশনা মানব, বেআইনি নির্দেশনা দিলে সেটা মানতে বাধ্য নই।
অপরদিকে একটি নন-লাইফ বিমা কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান ও বিআইএ’র সাবেক একজন প্রেসিডেন্ট বলেন, দুয়ার সার্ভিসের নিয়োগ নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে এটা বিমা খাতের সবাই জানে, কিন্তু কারো কাছে তো এখন পর্যন্ত তথ্য-প্রমাণ নেই যার ভিত্তিতে এটা বলা যাবে। আর কোম্পানিগুলো অর্থ দেয়নি, এটার জন্য ইড্রা কখনো জরিমানা করেনি, তবে তথ্য না দেওয়ার কারণে একটি কোম্পানিকে জরিমানা করেছে বলে শুনেছি।
তিনি বলেন, মনিটরিংয়ের জন্য ইড্রা কোনোভাবেই কোম্পানিগুলো থেকে অর্থ চাইতে পারে না। এটা ইড্রাও জানে। কারণ বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইনের ১৫(ঝ) ধারা অনুসারে কোনো ফি চাইতে গেলে সরকারের পূর্বানুমোদন লাগবে। এখানে সরকারের পূর্বানুমোদন মানে কোনো আইন, বিধি-প্রবিধি বা গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে। সরকারের পূর্ব অনুমোদন ছাড়া ইড্রা কোম্পানিগুলোর কাছে যে টাকা চেয়েছে, সেটা বৈধ না। কিন্তু বিগত সময়ে অনেকেই ভয়ের কারণে এই টাকা দিয়েছে।
কোম্পানিগুলোর এমন অভিযোগের বিষয়ে বিআইএ’র একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, কয়েকদিন আগে বিআইএ’র প্রেসিডেন্ট সাংবাদিকদের একটি অনুষ্ঠানে এ বিষয়টি উত্থাপন করেন বলেই এখন এটি আলোচনায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে বিআইএ থেকে আইডিআরএ’র কাছে আইআইএমএস সিস্টেমের বিষয়ে কোনো চিঠি প্রদান করা হয়নি।
কিন্তু বিআইএ থেকে কোনো চিঠি না পেলেও দুয়ার সার্ভিসেস লিমিটেডের নিয়োগ বিষয়ে স্বউদ্যোগী হয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে চিঠি দিয়েছে আইডিআরএ। চিঠিতে আইআইএমএস সার্ভিস পরিচালনায় দুয়ার সার্ভিসকে নিয়োগকালে কোনো অনিয়ম হয়েছে কিনা, তা তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে অনুরোধ করা হয়েছে।
বিআইএ এবং কোম্পানিগুলো এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার মুখপাত্র সাইফুন্নাহার সুমির কাছে। বার্ষিক ফির বাইরে কোম্পানিগুলো থেকে আইআইএমএস সেবা প্রদানের বিপরীতে ফি নেয়ার বিষয়ে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, যে বার্ষিক ফির কথা বলা হচ্ছে সেটা হলো ২০১৯ সালের আগেও ১ হাজার টাকা প্রিমিয়ামের বিপরীতে ৩ টাকা চার্জ দিতে হতো। কিন্তু এরপর চার্জ মাত্র ১ টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে।
অপরদিকে দুয়ার সার্ভিসের নিয়োগে অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, আইআইএমএস সেবা পরিচালনার জন্য যে জনবল ও অবকাঠামো দরকার তা আইডিআরএর নেই। তাই তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমেই এটা পরিচালনা করা হয়েছে। তবে দুয়ার সার্ভিসকে এই কার্যক্রমে নিয়োগ করার সময়ে কোনো অনিয়ম হয়েছে কিনা, তা যাচাইয়ে উদ্যোগ নিয়েছে আইডিআরএ। ইতোমধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে তদন্ত করতে একটি কমিটি গঠনের অনুরোধ জানানো হয়েছে।