ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ৫ মাঘ ১৪৩১

ফের সক্রিয় সিন্ডিকেট ॥ শুল্ক কমালেও আমদানি বাড়েনি

বেশিরভাগ দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেল মিলছে না

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২২:৫৬, ৭ ডিসেম্বর ২০২৪

বেশিরভাগ দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেল মিলছে না

.

ভোজ্যতেল নিয়ে   ফের সক্রিয় সেই পুরনো সিন্ডিকেট। উৎপাদকদের এই সিন্ডিকেট বাজারে তেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে সংকট তৈরি করছে। এমন কি শুল্ক-কর কমানোর পরও এই সিন্ডিকেট ভোজ্যতেলের আমদানি বাড়ায়নি। অন্যদিকে, দাম বাড়বে আগাম খবর পেয়ে সরাদেশেই বাজার থেকে বোতলজাত সয়াবিন তেল উধাও করে দিয়েছে খুচরা ব্যবসায়ীরা। ফলে রান্নার তেল নিয়ে আবারও চরম দুর্ভোগের মুখে পড়েছে ক্রেতারা।
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, গত এক সপ্তাহ ধরে বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ কম। বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট সবচেয়ে বেশি। ফলে বিক্রেতারা পর্যাপ্ত তেল পাচ্ছেন না। কোনো কোনো বিক্রেতার অভিযোগ, রমজান মাস শুরুর আগে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আরও এক দফা দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা করে নিতে চাইছে কোম্পানিগুলো।
মিরপুর ১২ নম্বরে মুসলিম বাজারের ৫-৬টি মুদি দোকান ঘুরেও মেলেনি সয়াবিন তেল। আলিমুদ্দিন নামের একজন বিক্রেতা বলেন, কোম্পানি দাম বাড়াবে, এখন সরবরাহ বন্ধ। দু-তিন দিন ধরে কোনো সয়াবিন তেল বাজারে ঢুকছে না।
সরকার দফায় দফায় শুল্ক-কর কমালেও সয়াবিন তেলের আমদানি বাড়েনি। অন্য একজন বিক্রেতা জানান, অনেক দোকানে সয়াবিন তেল নেই। অনেকেই আবার মজুত করছেন, যাতে দাম বাড়লে বেশি দামে বিক্রি করতে পারেন। এসব কারণে ভোজ্যতেলের সংকট তৈরি হয়েছে। ক্রেতারা দোকানে এসে তেল না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
কয়েকটি দোকানে প্যাকেটজাত সয়াবিন পাওয়া গেছে। সেই দোকানগুলোতে নির্ধারিত দামে বা কিছুটা বাড়তি দামে তেল বিক্রি হচ্ছে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রূপচাঁদা এক লিটার সয়াবিন তেলের গায়ের দাম ১৬৭ টাকা, দুই লিটার ৩৩৪ টাকা ও পাঁচ লিটার ৮১৮ টাকা। বেশিরভাগ দোকানে এ দামের চেয়ে ৫-১০ টাকা বেশি নিচ্ছেন বিক্রেতারা।
বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সম্প্রতি পাম ও সয়াবিন তেল আমদানিতে শুল্ক-কর কমিয়েছে সরকার। এতে প্রতি কেজি ভোজ্যতেল আমদানিতে শুল্ক-কর ১০-১১ টাকা কমানো হয়। কিন্তু এতেও আমদানি বাড়েনি। বরং বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট সবচেয়ে বেশি। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, তারা চাহিদার ১০ শতাংশ তেলও পাচ্ছেন না। উল্টো দাম বাড়েছে লিটারপ্রতি অন্তত ৫ টাকা।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ দোকানে বোতলজাত ভোজ্যতেল নেই। কিছু দোকানে পাঁচ লিটারের বোতল থাকলেও তা খুবই সীমিত। এক বা তিন লিটারের বোতল একেবারেই নেই। অনেকে দোকানি শুধু নিয়মিত ও পরিচিত ক্রেতাদের কাছে তেল বিক্রি করছেন। সেখানেও নেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত দাম। কিছু ক্ষেত্রে খোলা বা লুজ তেল বিক্রির অভিযোগ মিলেছে।
দোকানিরা বলছেন, মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েল লিটারপ্রতি ৫ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে খোলা পাম অয়েল ১৬০-১৬২ এবং সয়াবিন ১৭০-১৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন ১৬৭ টাকা, দুই লিটার ৩৩৪ টাকা ও ৫ লিটার ৮১৮ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
তেলের পাইকারি সরবরাহকারীরা বলছেন, মূলত ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো বোতলজাত সয়াবিন তেল বাজারে কম ছাড়ছেন। অপরদিকে, খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডিলাররা তেল সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। তেল কেনার জন্য আটা-ময়দার বস্তা কেনার শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন।
অন্যদিকে বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার কারণে তেল সরবরাহ কমেছে বলে দাবি তেল আমদানিকারক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর। তারা বলছেন, বিশ্ববাজারের হিসাবে লিটারে ১০-১৩ টাকা বেড়েছে। চাহিদার তুলনায় আমদানি কমেছে ২০ শতাংশের মতো।
তবে আমদানিকারকদের এমন দাবির সঙ্গে একমত নন ভোক্তারা। সানমুন নামের একজন ক্রেতা বলেন, তেল আমদানি হয়েছে তিন-চার মাসে আগে। অথচ এখন বলা হচ্ছে বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে। এটি আসলে অযৌক্তিক কথা।
তিনি বলেন, কর ও শুল্ক কমানোর পরও তেলের দাম না কমে উল্টো বেড়েছে। এখন আবার নতুন করে দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। সরকারের শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
টি কে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতহার তাসলিম গণমাধ্যমে জানান, সরকার শুল্ক-কর যা কমিয়েছে, তার চেয়ে বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে বেশি। কোম্পানিগুলো লোকসানের ঝুঁকিতে থাকলেও সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। গত মাসের তুলনায় চলতি মাসে সরবরাহ বাড়িয়েছে।
সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অনেক বেড়েছে। স্থানীয় বাজারে দাম বাড়াতে আমরা ১০ দিন আগে ট্যারিফ কমিশনের কাছে চিঠি দিয়েছি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত এলে এ বিষয়ে কথা বলতে পারব।
কোনো পণ্যের ওপর শুল্ক-কর কমানো মানে ওই পণ্যের আমদানি বাড়বে এবং দাম কমবে। গত অক্টোবরে সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিতে দুই দফায় শুল্ক-কর কমায় সরকার। প্রথম দফায় ১৭ অক্টোবর ও দ্বিতীয় দফায় ১৯ নভেম্বর শুল্ক-কর কমিয়ে তা নামিয়ে আনা হয় ৫ শতাংশে। কিন্তু দেশের বাজারে পণ্যটির দাম কমার বিপরীতে উল্টো বাড়তে দেখা যায়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে দেশে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৬৮ হাজার টন। গত বছরের একই সময়ে এই আমদানির পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৬০ হাজার টন। সে হিসেবে আমদানি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। এ ছাড়া রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে এবার আমদানিকারকের সংখ্যাও কমেছে।
তেলের দাম নিয়ে বৈঠক ॥ বোতলজাত সয়াবিন তেলের সাম্প্রতিক সরবরাহ সংকট শুরু হয় সপ্তাহ তিনেক আগে। এর পর সরকার ভোজ্যতেল আমদানিতে শুল্ক-কর কমায়। এতে প্রতি কেজি ভোজ্যতেল আমদানিতে শুল্ক-কর ১০ থেকে ১১ টাকা কমেছে। কিন্তু সরকার শুল্ক-কর কমালেও আমদানি বাড়েনি; বরং বাজারে বোতলজাত তেলের সংকট তৈরি হয়েছে। এম অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার ভোজ্যতেল পরিশোধন কোম্পানিগুলোকে নিয়ে এক সভা করে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)।
সভায় ব্যবসায়ীরা জানান, আসন্ন রমজান উপলক্ষে যে পরিমাণ সয়াবিন তেল আমদানি হওয়ার কথা (ঋণপত্র খোলা), তা স্বাভাবিক পর্যায়ে রয়েছে। তবে বিশ্ববাজারের দামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের বাজারেও ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয় করা প্রয়োজন।
এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএমএবি) ও ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ট্যারিফ কমিশন। শুল্ক কমানোর পরও কেন ভোজ্যতেলের দাম কমছে না, সেটি দ্রুততম সময়ে পর্যালোচনা করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেবে কমিটি।

×