বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেই শেষ হয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থবছর
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেই শেষ হয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থবছর। রাশিয়া-ইউক্রেন, ফিলিস্তিন-ইসরাইল আগ্রাসন কিংবা উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্য সবকিছু মিলিয়ে মন্দা প্রভাব থেকে বের হতে পারেনি বিশ্ব। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে বৈশ্বিক নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি ছিল।
ব্যবসা-বাণিজ্যের শ্লথ গতির সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে দেশের রাজস্ব আহরণে। যার প্রমাণ সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুতে কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতা ও জরুরি অবস্থা নতুন করে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে দেশের অর্থনীতিতে। যার সরাসরি প্রভাব রাজস্ব আহরণে পড়বে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
সদ্য সমাপ্ত অর্থবছর শেষে চূড়ান্ত হিসাবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৭ হাজার ৪৩৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা কম রাজস্ব আদায় করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। যদিও বকেয়া রাজস্ব আহরণসহ বিভিন্ন উদ্যোগে লক্ষ্যমাত্রার ৯৩.৩১ শতাংশ আদায় হয়েছিল। তারপরও বড় ঘাটতি এড়াতে পারিনি প্রতিষ্ঠানটি।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এনবিআরে সংশোধিত ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৫৬২ কোটি ৯ লাখ টাকা। যেখানে আগের অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছিই যেতে পারেনি এনবিআর, সেখানে চলতি অর্থবছরে দেওয়া হয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার বড় লক্ষ্যমাত্রা। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করাটা এখন তাদের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ।
তার ওপর দুশ্চিন্তার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অর্থনীতিতে বড় ধরনের অস্থিরতা। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, গত এক সপ্তাহে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে ৮৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। চলমান স্থবিরতায় দিনে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা।
অর্থনীতির ক্ষতি হয়তো টাকার অঙ্কে মাপা যায়, কিন্তু দেশের ভাবমূর্তির যে ক্ষতি হয়েছে, তা মাপার কোনো বাটখারা নেই। অন্যদিকে ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) মনে করছে, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ফলে দেশের অর্থনীতিতে ১০ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় এক লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে গেছে।
আর ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুধু ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকার কারণে ১০ দিনে ই-কমার্স খাতে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এত এত লোকসানের মধ্যে দেশের রাজস্ব আহরণ কীভাবে আসবে সেটিই এখন বড় প্রশ্ন বলে মনে করছেন এনবিআরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
এনবিআর আয়কর ও কাস্টমস বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, দেশই যেখানে স্থবির ও অস্থিতিশীল পর্যায়ে রয়েছে, সেখানে রাজস্ব আদায়ের সুযোগ কোথায়। অর্থনীতির চাকা চলমান না থাকলে অর্থনীতির চলকগুলো কাজ করবে না, এটাই স্বাভাবিক। আর দেশ স্থিতিশীল ও স্বাভাবিক অবস্থায় না ফিরলে যেকোনো কৌশল কিংবা এনফোর্সমেন্ট উদ্যোগ কাজে আসবে না।
এই মুহূর্তেও যদি সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে যায়, নেতিবাচক প্রভাব থাকবে আরও বেশ কয়েক মাস। শুধু জুলাই মাসেই প্রত্যাশার তুলনায় রাজস্ব আদায় কমবে অন্তত ৪০-৬০ শতাংশ। বর্তমানে ধৈর্য ধারণ করা ও সীমিত পরিসরে যতটুকু কাজ করা যায়, আপাতত করণীয় এটাই।
চলমান অস্থির পরিবেশে এনবিআরের কী করণীয় থাকতে পারে- জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, পুরো অর্থনীতি এমনিতেই নেতিবাচক ছিল, আরও নেতিবাচক হয়ে গেল। এর পেছনে দুর্নীতিবাজ চক্রেরও হাত থাকতে পারে। তবে কাউকে দোষ দেওয়া বা দায়ী করার চেয়েও বড় কথা হলো সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশের। এই মুহূর্তে এনবিআরের তেমন কিছু করার নেই।
তিনি বলেন, যেটা করতে পারে সেটা হলো যেসব কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া রয়েছে সেটা আদায়ের প্রচেষ্টা বাড়ানো। অন্যদিকে যেসব প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছে, তাদের বিষয়ে মনিটরিং করতে পারে। এনবিআর চাইলে তারা ব্যাংক ও ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে জানতে চাইতে পারে টাকাগুলো কোথায় কোথায় বিনিয়োগ হয়েছে। ওই ফাইলগুলো ভালো করে দেখা উচিত। এটা দেখার আইনি দায়িত্ব তাদের রয়েছে। দুদকেরও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে চলমান কার্যক্রম ভালো করে চালিয়ে যাওয়া উচিত।
করোনা মহামারির সময়ে সরকারি সাহায্য হিসেবে ৩০ হাজার কোটি টাকা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছায়নি উল্লেখ করে আবদুল মজিদ বলেন, দেশের যেকোনো দুর্যোগের সময়ে সরকারি সহায়তা সুবিধা বড় বড় ব্যবসায়ীরা হাতিয়ে নিয়েছে। ২০১৩ সালের রাজনৈতিক সংকটের সময়ও একই চিত্র দেখা গেছে। এবারও হয়ত ব্যবসায়ীদের ক্ষতির কথা বিবেচনায় সরকারি সহায়তা আসবে। আমার কথা হলো ক্ষতি কিংবা সহায়তা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
কিন্তু ঋণ নেওয়ার নামে যারা আত্মসাৎ করেছে, তাদের বিষয়ে কি করা হয়েছে? ওই ব্যবসায়ী গোষ্ঠী কি টাকা ফেরত দিয়েছে? এ বিষয়ে অন্তত এনবিআর চিঠি দিয়ে জানতে চাইতে পারে টাকাগুলো কোথায় গেল? আমার মতে ঋণ খেলাপিদের ধরে সুশাসনের আওতায় আনা প্রয়োজন। সুশাসনের বিকল্প নেই।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মোট ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। যা জিডিপির ৯.৭ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। আর অন্যান্য উৎস হতে ৬১ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে আয়কর, মুনাফা ও মূলধনের ওপর কর থেকে আসবে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬২০ কোটি টাকা, ভ্যাট থেকে ১ লাখ ৮২ হাজার ৭৮৩ কোটি, সম্পূরক শুল্ক ৬৪ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা, ৪৯ হাজার ৪৬৪ কোটি, রপ্তানি শুল্ক ৭০ কোটি, ৫ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা ও অন্যান্য কর থেকে আসবে ১ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা।