ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৬ মার্চ ২০২৫, ২ চৈত্র ১৪৩১

বাংলার রাখাল বালক

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ০১:০৪, ১৪ জুলাই ২০২৪

বাংলার রাখাল বালক

রাখাল বালক

বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী উপন্যাসিক শ্র্রী শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মহেম-আমেনা-গফুরের কথা এখন আর কেউ মনে রাখে যদিও এক সময় পাঠ্য পুস্তিকাতে শিক্ষার্থীদের পাঠন-পঠনের এটি আলেচিত বিষয় ছিল। ছোট বেলায় বাল্যশিক্ষা বইতে ‘রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে, শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে’ পড়ে আমরা বড় হয়েছিলাম আজ থেকে পাঁচ দশক আগে।

স্যার আজিজুল হক এক সময়কার নদীয়া জেলার জমিদার, বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির স্পিকার ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তার প্রখ্যাত গ্রন্থ ‘ম্যান বিহাইন্ড দি প্লাউ’ বইতে বাংলার রাখাল বালকদের জীবনের গল্প সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যা এখনো প্রাণবন্ত। এ অঞ্চলের রাখালদের রাজা শ্রীকৃষ্ণ, পৌরাণিক এই চরিত্র গরু চরানো বালক থেকে অবতার হয়ে মানুষকে পথ দেখিয়েছেন।

সহজ যে বিষয়টি আমরা অনুধাবন করতে পারি, বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজে গরু ও রাখাল বিষয়টি খুবই সাধারণ বিষয় ছিল। এর কোনো বিকল্প চিত্র বা চরিত্র নেই। বরং এর আদর্শিক চিত্র আঁকা আছে আমাদের মনে। এত সব ভাব-কল্পনার যে ‘রাখাল’, তা এ অঞ্চলে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো বিষয় ছিল না, যেভাবে খামারনির্ভর পশ্চিমে ‘কাউবয়’ নামে বিশেষ একটা পরিচয়, তার মেজাজ ও চিহ্ন আছে। বরং পশুপালন কৃষির মতো অন্য আট-দশটা পারিবারিক কাজের একটি। মাঠে বাঁশি বাজাচ্ছে রাখাল বালক, বাংলার আবহমান কোনো বর্ণনা এই চিত্র ছাড়া পূর্ণতা পায় না।
আজ থেকে কয়েক দশক আগেও আমরা প্রায় গৃহস্থ বাড়িতে গোয়াল ঘর দেখতাম যেখানে গবাদিপশু পরিবারের সদস্য বলেই গণ্য হতো, কোনো না কোনো সদস্য এই পোষ্যদের সকালে মাঠে নিয়ে যেত, বিকেলে ঘরে ফেরাত। এর ফাঁকে পরিবারের গরু চরানো বড় বা কনিষ্ঠ সন্তানের স্কুল-খেলাধুলাও চলত, সব পরিবার দরিদ্র বাস্তবে সবাই সাহিত্যের গফুরের মতো নয়, বরং এই পশু চাষাবাদ ও পরিবারের শিশুদের পুষ্টি উৎসের পাশাপাশি ছিল খেলার সঙ্গী।

আজকাল পশুপালনকে যতটা খামারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়, তাতে ততটা থাকে না পশু ও মানুষের সহাবস্থানকেন্দ্রিক ঘনিষ্ঠতা। বরং শিক্ষা পদ্ধতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ‘রাখাল’ ও ‘পশুপালন’কে নেতিবাচক অর্থে দেখানো হয়, পড়াশোনা না করা বালকদের রাখালের সঙ্গে তুলনা দেওয়া হয়। রাখাল বালক আর যাই হোক গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে না, যদিও এর ব্যতিক্রম আমরা বাস্তবে দেখেছি।

আমরা যে ধরনের পশুপালন ও রাখাল নিয়ে কথা বলছি, তার সংখ্যা কমলেও অপ্রাতিষ্ঠানিক পশুপালনে গত এক দশকে বেশ ভালো জোয়ার দেখা যাচ্ছে দেশে। এর কারণে পশুর সঙ্গে মানুষের সম্পর্কও বদলে যাচ্ছে দিন দিন। যার ফলে রাখাল নিয়ে তেমন সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্র কিংবা ভাসান যাত্রা আর চোখে না পড়লেও সময়ের আবর্তে রাখালদের পশু চড়ানোর গল্প তাদের স্বরূপ বদলিয়েছে, অন্য নামে প্রকৃতিতে উপস্থিত হয়েছে।

জীবনমান নয়, বরং জীবনযাত্রার পরিবর্তনে গরু চরানোর সময় কোথায়? পরিবার ভেঙে ছোট হচ্ছে দিন দিন, বাড়ছে অভিবাসন, গ্রামীণ বাড়িগুলোর অবকাঠামোগত পরিবর্তন এর সঙ্গে যুক্ত বলে জানালেন ‘প্রাকৃতিক কৃষি’ নামে অর্গানিক এগ্রিকালচারের সঙ্গে যুক্ত উদ্যোক্তাগণ। তাদের মতে পশুপালনের একটা প্রতিবন্ধকতা হলো জায়গার অভাব, আগের বড় পরিসর নিয়ে  খোলামেলা উঠানের বাড়ি এখন কমে যাচ্ছে, এর বদলে গ্রামে ফ্ল্যাট বাড়ির আদলে বাড়ি হচ্ছে, ওই ধরনের পরিবেশে গোয়ালঘর বেমানান আবার অনেক ক্ষেত্রে গোয়ালঘর তৈরির মতো স্থানও থাকে না।

এমন পরিবেশ স্বাস্থ্যকরভাবে বেড়ে ওঠার জন্যও প্রয়োজন। আজকাল গ্রাম থেকে সেই পরিবেশটা উঠে যাচ্ছে, সেখানেও থাকছে না খেলার মাঠ বা খোলামেলা প্রান্তর। পশু চরানোর ময়দান নিশ্চিত করতে পারা মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উন্মুক্ত স্থান রাখতে পারা।
সম্প্রতি ‘কৃষি শুমারি ২০১৯’ শিরোনামের একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। সেখান থেকে জানা যায়, এক দশকে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে পালিত পশুর সংখ্যা শহর ও পল্লী দুই অঞ্চলেই বেড়েছে। ‘কৃষি শুমারি ২০০৮’ বলছে গরুর সংখ্যা ২ কোটি ৫৬ লাখ ৭৮ হাজার, এর মধ্যে ২ কোটি ৫৩ লাখের বেশি পল্লী এলাকায়, ৩ লাখ ৫৬ হাজারের বেশি শহরে। অন্যদিকে ‘কৃষি শুমারি ২০১৯’ অনুসারে এক দশক পর এই সংখ্যা হয়েছে ২ কোটি ৯৪ লাখ ৫২ হাজার, এর মধ্যে পল্লী এলাকায় ২ কোটি ৮২ লাখ ৮৩ হাজার ও শহর এলাকায় ১১ লাখ ৬৯ হাজার গরু।

তবে এ চিত্র যে পারিবারিকভাবে পালিত পশুর সঠিক চিত্র তুলে ধরে এমন নয়। বরং গ্রামের সঙ্গে পরিচয় থাকলেই দেখা যাবে, অপ্রাতিষ্ঠানিক পশুপালন মূলত খামারই, পাঁচ-দশটি গরু নিয়ে গড়ে উঠছে এসব খামার। প্রায়শ আমরা সংবাদমাধ্যমে এ ধরনের শিরোনামও দেখি, বড় ডিগ্রি নিয়ে কেউ খামার করছে, কেউ বিদেশ ফেরত বা বেকার। এই পরিসংখ্যানের কৌতুককর একটি দিক আছে। বিবিএসের শুমারিতে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত গবাদিপশুকে বাদ দেওয়া হলেও গরু উৎপাদনে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যের সঙ্গে বড় ধরনের গরমিল দেখা দিয়েছে। কৃষি শুমারিতে ২০১৯ সালে বাণিজ্যিক খামারের গরু ছাড়াই গরুর সংখ্যা দেখানো হয়েছে ২ কোটি ৯৪ লাখ ৫২ হাজার। আর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, পারিবারিক ও বাণিজ্যিক খামার মিলে ২০১৯-২০ অর্থবছরে গরু ছিল ২ কোটি ৪৩ লাখ ৯১ হাজার অথচ বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী অপ্রাতিষ্ঠানিক গরুর সংখ্যা এর চেয়েও বেশি!

প্রাচীনকাল থেকেই দেশের কৃষি খাত টিকিয়ে রেখেছেন রাখাল নামে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষিরা, বড় পরিবারগুলো ভেঙে যাওয়ায় বড় ও মাঝারি শ্রেণির কৃষক পরিবারগুলো দিন দিন ছোট হয়ে আসছে। গত ১১ বছরে বড় ও মাঝারি শ্রেণির কৃষক পরিবারের হার অর্ধেকে নেমেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশের কৃষক পরিবারগুলোর মধ্যে ৯১ দশমিক ৭ শতাংশই ক্ষুদ্র কৃষক পরিবার। ২০১৯ সালে ক্ষুদ্র কৃষক পরিবারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ কোটি ৫৫ লাখে।

অর্থাৎ পরের ১১ বছরে এ হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯১ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০০৮ সালে মাঝারি পর্যায়ের কৃষক পরিবার ছিল প্রায় সাড়ে ২১ লাখ ৩৬ হাজার বা ১৪ দশমিক ০৭ শতাংশ। পরের ১১ বছরে এ সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১৩ লাখ বা ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। মূলত বৃহৎ পরিবারগুলো দিন দিন ছোট হয়ে আসছে, ফলে পারিবারভেদে কৃষি জমির পরিমাণও কমছে, এতে মাঝারি ও বৃহৎ শ্রেণির কৃষক পরিবারের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। দেশে দিন দিন বাণিজ্যিক কৃষি খামার গড়ে উঠছে।

ছোট চাষিরা ছোট হতে হতে যখন একেবারেই ভূমিহীন হয়ে যাচ্ছে তখন তারা বাণিজ্যিক কৃষির আওতায় চলে আসছে। মানবকেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ার মাধ্যমে আমরা প্রাণ-প্রকৃতির চরিত্রের মধ্যে বিপ্লব ঘটিয়েছি, এর ক্ষতিপূরণ সম্ভব অন্য প্রাণের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি ও মানুষের মতো প্রকৃতিতে তার হিস্যা নিশ্চিতের মাধ্যমে। যার শুরু হতে পারে ‘রাখালের’ প্রতি শ্রেণিগত ঘৃণা না ছড়িয়ে নিজেদের রাখাল হওয়ার মধ্যে, রাখাল মূলত নেতৃত্বের ধারণা যেভাবে মহাপুরুষরা ‘মেষপালক’ হয়ে হাজির হয়েছিলেন এবং পথ দেখিয়েছিলেন।

একটু ভিন্ন অর্থেই এক সাংবাদিক বলেছিলেন, রাখালের বাঁশি যতই উদাসকরণ, সে সুর মূলত প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের হারানো সখ্য পুনরুদ্ধারের ডাক। তা না হলে রাখালের টাকশাল বিজয় কি সম্ভব হতো?

×