.
মুসলমানদের বড় দুটি ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে একটি হলো কোরবানির ঈদ বা ঈদুল আজহা। আর মাত্র একদিন পরেই উদযাপিত হবে এই উৎসব। এ উপলক্ষে ইতোমধ্যে দেশজুড়ে অর্থপ্রবাহ বেড়েছে বহুগুণ। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় বসেছে পশুর হাট। অর্থনীতির নানা সেক্টরে দেখা দিয়েছে চাঙ্গাভাব। ঈদের অর্থনৈতিক হালচাল নিয়ে লিখেছেন- জলি রহমান-
জমে উঠেছে পশুর হাট ॥ সামর্থ্য অনুযায়ী উচ্চবিত্ত থেকে নিম্ন বিত্ত সকলেই চেষ্টা করেন পশু কোরবানি দিতে। কোরবানি হওয়া পশুর সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে ক্রমান্বয়ে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের বহু খামারি সারা বছর অনেক স্বপ্ন নিয়ে গবাদিপশু লালন-পালন করেন কোরবানির সময় বিক্রি করার জন্য। এই ঈদ একেক জনের কাছে একেক রকম। শহর থেকে অনেক মানুষ গ্রামের বাড়িতে যায় ঈদ করতে। তারা পশু কোরবানি করে দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দেয়। ফলে যাদের পক্ষে সারা বছর গরু বা খাসির মাংস কিনে খাওয়ার সামর্থ্য হয় না। তাদের এই সময়ে মাংস খাওয়ার সুযোগ হয়। এভাবেই ঈদের আনন্দ ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার মাঝে ভাগাভাগি হয়। গত আট বছরের কোরবানির চিত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২০ সালে দেশে করোনা সংক্রমণ দেখা দেওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতি বছর কোরবানি দেওয়া পশুর সংখ্যা বাড়ছিল।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৯ সালে দেশে ১ কোটি ৬ লাখ ১৪ হাজার ২৮১ পশু কোরবানি দেওয়া হয়। করোনার সংক্রমণ দেখা দিলে ২০২০ সালে কোরবানি দেওয়া পশুর সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ২৬৩। পরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে পশু কোরবানির সংখ্যা আরও কমে (৯০ লাখ ৯৩ হাজারের কিছু বেশি) যায়। অবশ্য ২০২২ সালে কোরবানি দেওয়া পশুর সংখ্যা কিছুটা বেড়ে হয় ৯৯ লাখ ৫৪ হাজার ৬৭২টি। সবশেষ গত বছর দেশে পশু কোরবানি দেওয়া হয় ১ কোটি ৪১ হাজার ৮১২টি। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে কোরবানিযোগ্য পশু আছে ১ কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭টি। এর আগে কখনো দেশীয় উৎস থেকে এতসংখ্যক কোরবানিযোগ্য পশুর জোগান ছিল না। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান বলেছেন, কৌশলে কিংবা ছলচাতুরী করে যাঁরা কোরবানির পশুর দাম বাড়াচ্ছেন, শেষ পর্যন্ত তাঁদের ‘মাথায় হাত’ পড়বে। মন্ত্রী আর বলেছেন, এবার কোরবানির পশুর চাহিদা ১ কোটি ৭ লাখ। সেখানে গরু-ছাগলসহ কোরবানির জন্য পশু প্রস্তুত আছে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ। ২২ লাখের বেশি পশু বাড়তি আছে। বাজারে যে কোনো পণ্যের দাম নির্ধারিত হয় সরবরাহ ও চাহিদার ওপর ভিত্তি করে। দেশে প্রয়োজনের চেয়ে পশুর উৎপাদন ও সরবরাহ বেশি আছে। মধ্যবিত্তের বাজেট ১ লাখের মধ্যে হলেও এই দামে গরু তেমন পাওয়া যাচ্ছে না বলেই জানা যায়।
ডিজিটাল কেনাবেচা ॥ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল হিসেবে দুনিয়াটা হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। যে কোনো প্রয়োজন এখন ঘরে বসেই মেটানো যায় ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শুরু করে বিলাসবহুল পণ্য সবকিছুই অর্ডার অনুযায়ী পৌঁছে যায় ঘরে। বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারিভাবে অনলাইনে কোরবানির পশু কেনাবেচার জন্য অনেক অনলাইন প্লাটফর্ম তৈরি হয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন খামারিরা নিজস্ব অনলাইন পেজ থেকে পশু বিক্রি করছেন। অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রি করে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ই-কমার্স প্লাটফর্ম হলোÑ বিক্রয় ডটকম, বেঙ্গল মিট, কিউকম ডটকম, ডিজিটাল হাট, দারাজ গরুর হাট, প্রিয়শপ, দেশী গরু, ই-বাজার, অথবা ডটকম, সদাগর, আজকের ডিল ইত্যাদি।
রেমিটেন্স প্রবাহ ঊর্ধ্বমুখী : বছরের অন্যান্য সময়ে রেমিটেন্স গতি স্বাভাবিক থাকলেও প্রধান দুটি ঈদ উৎসবে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অনেক বাড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মে মাসে ২২৫ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় আসে, যা গত ৪৬ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। তার মানে, গত মাসে গড়ে প্রতিদিন প্রবাসী আয় আসে ৭ কোটি ২৫ লাখ ডলার। আর চলতি মাসের প্রথম এক সপ্তাহে দৈনিক গড়ে ১০ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। তার মানে, দিনে গড়ে ৩ কোটি ১২ লাখ ডলার বেশি এসেছে। সাধারণত প্রতি বছরই দুটি ঈদ উৎসব উপলক্ষে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স বাড়ে।
চামড়া সংরক্ষণের উপযুক্ত সময় ॥ অতি মূল্যবান একটি পণ্য চামড়া। অথচ যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে প্রতি বছরই চামড়া ব্যবসায়ীরা পড়েন নানা বিপাকে। ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন তারা। দেশীয় পশুর চামড়া সংরক্ষণে প্রতিটি জেলায় একটি করে হিমাগার ও আধুনিক পশু জবাইখানা বা স্লটার হাউস নির্মাণ করা যেতে পারে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী যথাযথভাবে পশু জবাই পরিচালনা করা গেলে পশু জবাইখানাও একটি ভালো ব্যবসার উৎস হতে পারে। দেশে কাঁচা চামড়ার মোট চাহিদার প্রায় ৬০ ভাগ আসে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। কিন্তু উন্নত ব্যবস্থাপনার অভাবে সেগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না।
চামড়া শিল্প-কারখানাগুলো একসময় ছিল রাজধানীর হাজারীবাগ, বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে। প্রায় সাত বছর আগে এটি চলে যায় রাজধানীর অদূরে সাভারের হেমায়েতপুরে, ধলেশ্বরী নদীর তীরে। মূলত বুড়িগঙ্গাসহ স্থানীয় পরিবেশদূষণ রোধ এবং শ্রমিকদের জন্য উন্নত কর্মপরিবেশ তৈরি করতেই এ স্থানান্তর হয়। জানা যায়, ট্যানারি শুধু স্থানান্তর হয়েছে কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ধলেশ্বরী নদীও বুড়িগঙ্গার মতো দূষিত হচ্ছে। ২০১৭ সালে স্থানান্তারিত চামড়াশিল্প এখন বিসিক চামড়াশিল্প নগরী হিসেবে পরিচিত। সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে এখানে কর্মরত ৭০ ভাগের বেশি শ্রমিক শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি, মাথাব্যথা ও জ্বরের মতো নানা সমস্যায় ভোগেন। পরিবেশ দূষণ রোধে চামড়াশিল্প নগরীতে কঠিন বর্জ্যরে ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পনার বাস্তবায়ন একান্ত প্রয়োজন। বৈশ্বিক বাজারে চামড়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের তৈরি চামড়াজাত পণ্যের চাহিদাও বাড়ছে দিন দিন। বর্তমানে বিশ্বে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বাজার ২১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের। বাংলাদেশ এ বাজারের মাত্র শূন্য দশমিক ৫ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। অথচ বাংলাদেশ এ বাজারের একটি বড় অংশ দখল করতে পারে অতি সহজেই। দেশে পশুর কাঁচা চামড়ার অনেক প্রাপ্যতা থাকলেও চামড়াজাত পণ্য তৈরির জন্য তা বিদেশ থেকেই আমদানি করতে হয়। ট্যানারি শিল্পনগরের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারকে (সিইটিপি) দ্রুত আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাওয়া জরুরি। এটা করা গেলে চামড়া খাতে শতভাগ মূল্য সংযোজন সম্ভব হবে।