ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

আসন্ন রমজান : ভোক্তার ভাবনা

জলি রহমান

প্রকাশিত: ০০:১৮, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪; আপডেট: ০১:২৩, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

আসন্ন রমজান : ভোক্তার ভাবনা

.

কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হবে মুসলিমদের সিয়াম সাধনার মাস। সময়ে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে আনন্দ-উচ্ছ¡াস লক্ষ্য করা যায়। একইসঙ্গে দ্রব্যমূল্য নিয়ে থাকে ৎকণ্ঠাও। বছরের অন্যান্য সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লেও দেশের সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা পেতে থাকে সময়ের জন্য। মূল্যস্ফীতি হু হু করে বাড়ে রোজার আগেই। নিয়ে কথা হলো কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে।

ঢাকার শান্তি নগরের রুনা আক্তার নামের এক গৃহিণী জানালেন, সামনে রোজা তাই চিন্তায় আছি। ছোলা, পেঁয়াজ, আদাসহ সবকিছুর দামই বেড়ে যায়। তাই শবে বরাতের পরেই কিছু পণ্য বেশি করে কিনব।  সংসারের খরচ দিনদিন বাড়ছে। এর মধ্যে আবার বাড়তি দামে পণ্য কেনা হলে ঋণ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। কয়েক বছর আগেও দুতিন হাজার টাকা নিয়ে বাজারে গেলে মাছ-মাংস কেনা যেত। এখন চিন্তারও বাইরে। প্রতিদিনকার সবজি কিনতে দেড়-দুইশটাকা কিভাবে খরচ হয় টেরই পাওয়া যায় না। আমাদের মতো সীমিত আয়ের মানুষদের জীবন ধারণ প্রতিনিয়ত কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

মালিবাগের এক সুপারশপে কেনাকাটা করছিলেন মোঃ ফখরুল আলম। তিনি একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। রোজার কেনাকাটার প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাওয়ায় বললেন, “আমার জানা মতে বিশ্বে অন্যান্য মুসলিম দেশে রোজার মাস আসলে ব্যবসায়ীরাও ধর্মভীরু হয়ে যান। পণ্যমূল্য সীমিত লাভের মধ্যে ছেড়ে দেন। আর আমাদের দেশে ঠিক উল্টো চিত্র। এমনিতেই আয় বাড়ছে না, তবে ব্যয় এতটা বেড়েছে যা বলার ভাষা নেই। আমার বেতন বাড়ছে না। তবে বাসার কাজের লোকের বেতন থেকে শুরু করে প্রতিটি সেক্টরে খরচ বেড়েছে। এমনকি বাচ্চাকে যে ভ্যানচালক আনা-নেওয়া করছে, তার ভ্যান ভাড়াও বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি আমার স্ত্রী দুজনেই চাকরি করছি। বাচ্চাদের ভালো একটা স্কুলে পড়াই। মোটামুটি একটা সামাজিক অবস্থান মেইনটেইন করতে হয়। চাইলেই এগুলো বাদ দিয়ে চলা সম্ভব না। দিন দিন আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে পরে যাচ্ছি। এগুলো কারও সঙ্গে শেয়ার করাও সম্ভব না। এর মধ্যেও বিশেষ এই মাসে কাছের মানুষদের উপহার দিতে পোশাক কেনাকাটা বাবদ অনেক ব্যয় বাড়ে। পাশাপাশি খাবার খরচও বেড়ে যায়। বছরের অন্যন্য মাসে ফলমূল তেমন না খেলেও রমজান এলে সারাদিন রোজার পরে ফলসহ মাছ-মাংস খাওয়ার একটা চাহিদা থাকে। আর এই বাড়তি চাহিদা মেটাতে প্রতিবছরই হিমশিম খেতে হয়।

বাসায় প্রতিদিন জাকিয়া নামের এক নারী আসেন আমার কাজে সহায়তা করতে। একবছর আগে গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছেন একটু ভালোভাবে খেয়ে পড়ে থাকবেন এই আশায়। এখন চার বাসায় কাজ করে পান ১০ হাজার টাকা। যার হাজার টাকা প্রতিমাসের ঋণ বাবদ চলে যায়। বাকি চার হাজার দিয়ে বাসা ভাড়া দেন। তার স্বামী রাজমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। কখনো কাজ থাকে, আবার কখনো থাকে না। তখন জাকিয়া যেসব বাসায় কাজ করেন, সেখান থেকে অ্যাডভান্স নিয়ে চাল-ডাল ক্রয় করেন। তিনটি ছেলে সন্তান থাকলেও তাদের বয়স এবং বেড়ে ওঠার কোনো সামঞ্জস্য নেই।

দেখলেই বোঝা যায় এরা পুষ্টিহীনতায় ভুগছে।  ফ্যামিলি কার্ডের মতো সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না জাকিয়ার পরিবার। কিভাবে পাবে তাও জানে না। জাকিয়া মাসে একদিন একটি বয়লার মুরগি এবং দুইদিন মাছ রান্না করেন। বাকি দিনগুলো ভাতের সঙ্গে থাকে শুধু শাক বা ডাল। এসব শ্রেণির মানুষের রোজা বা ঈদ ৎসব কোনো বিষয়েই থাকে না বাড়তি খাবার চাহিদা। জনসংখ্যার এই অংশের ন্যূনতম পুষ্টির চাহিদার নিশ্চয়তা করা না গেলে দেশের উন্নয়ন কখনোই সূদুর প্রসারী হওয়া সম্ভব নয়। জন্য সরকারি যেসব দারিদ্র্র্যবান্ধব সেবামূলক কর্মসূচী রয়েছে, তা দেওয়ার ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে জরিপ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে চলছে চরম দুর্নীতি। যারা অতি দরিদ্র তাদের কাছ থেকেও  অসাধু ব্যক্তিরা ১০ বা ২০ হাজার টাকা নেয় ফ্যামিলি কার্ড দেওয়ার কথা বলে, তবে শেষ পর্যন্ত না দেওয়ার অনেক অভিযোগ রয়েছে। যারা গরিবের হক নষ্ট করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের দাবি।        

ট্রেড ইকোনমিক্সের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই মূল্যস্ফীতি সূচকটি সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো ১০ শতাংশের কাছাকাছি অবস্থান করছে। নিয়ন্ত্রণে কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে কিছু পদক্ষেপ নিলেও তা কাজে আসছে না। অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা সিন্ডিকেটের কারসাজি এই মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে দশমিক ৬৯ শতাংশ। জি-৭ভুক্ত দেশগুলোর পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ইতালিতে মূল্যস্ফীতি দশমিক শতাংশ, জার্মানিতে দশমিক শতাংশ, ফ্রান্সে দশমিক শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে শতাংশ, কানাডায় দশমিক শতাংশ এবং জাপানে দশমিক শতাংশ। আর জি- দেশগুলোর গড় মূল্যস্ফীতি হচ্ছে দশমিক শতাংশ, যা আমাদের দেশের অর্ধেকেরও কম। বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি সেপ্টেম্বর ২০২২-এর দশমিক ৯৬ শতাংশের তুলনায় সেপ্টেম্বর ২০২৩ সময়ে হয়েছে দশমিক ২৯ শতাংশ। অন্যদিকে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি সেপ্টেম্বর ২০২২-এর দশমিক ১০ শতাংশের তুলনায় সেপ্টেম্বর ২০২৩ সময়ে দশমিক ৬৩ শতাংশ হয়েছে। প্রতিনিয়ত মাছ-মাংসের বাজার মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। দেশের অধিকাংশ মানুষের আয় সীমিত। তাদের সুস্থভাবে বাঁচাতে হলে পণ্যের মূল্য সরকারিভাবে নির্ধারণ করা এবং মাঠপর্যায়ে মনিটরিং বাড়ানো একান্ত প্রয়োজন। ২০৪১ সালে উন্নত দেশ গঠনের প্রত্যয়ে এগিয়ে চলছে  দেশ।

বিভিন্ন ধরনের ভাতা প্রদান নানান রকম সুযোগ-সুবিধার কারণে বর্তমানে দারিদ্র্যের হার অনেক কমেছে। দেশের উন্নয়ন স্থিতিশীল রাখতে মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় মাত্রায় রাখা একান্ত প্রয়োজন। পবিত্র একটি মাস রোজা। অথচ মাসেও পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা সিন্ডিকেট বাহিনী সক্রিয় হয়ে ওঠে। এদের বিরুদ্ধে নিতে হবে কঠোর পদক্ষেপ।

×