ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বাজেটকে যেভাবে প্রভাবিত করবে আইএমএফ ঋণের শর্ত

প্রকাশিত: ১৫:৪৭, ৩১ মে ২০২৩; আপডেট: ১৫:৫২, ৩১ মে ২০২৩

বাজেটকে যেভাবে প্রভাবিত করবে আইএমএফ ঋণের শর্ত

দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। ফাইল ফটো

বাংলাদেশে নতুন অর্থবছরের জন্য যে বাজেট আসছে তাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের দেয়া ঋণের শর্ত সামাল দিতে সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে সেটি এখন মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, এবার রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং ভর্তুকির পুনর্বিন্যাসে সরকার বাজেটে কী ঘোষণা দেয় সেদিকেই নজর থাকবে সবার। কারণ এগুলোই জনগণের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে।

এ বছরের জানুয়ারির শেষের দিকে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ। যার প্রথম কিস্তির ৪৭৬ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার আসে গত ফেব্রুয়ারিতে।

বাংলাদেশকে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭টি কিস্তিতে এই অর্থ দেয়া হবে। এই ঋণের পেছনে আইএমএফ বেশ কিছু সংস্কারের শর্তও বেঁধে দিয়েছে।

এগুলোর মধ্যে রয়েছে- রাজস্ব সংস্কার, মুদ্রা ও বিনিময় হারের সংস্কার, আর্থিক খাতের সংস্কার, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সংস্কার এবং সামষ্টিক কাঠামোগত সংস্কার। এসব শর্ত ২০২৬ সাল পর্যন্ত চলতে থাকবে। তবে আগামী এক বছরের মধ্যে কয়েকটি শর্ত বাস্তবায়ন করতে হবে জরুরি ভিত্তিতে।বাড়ছে নিত্য পণ্যের দাম। ফাইল ফটোঅর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সেখান থেকে উত্তরণের জন্য আগামী বাজেটে কিছু পদক্ষেপ সরকারকে অবশ্যই নিতে হবে। এসব পদক্ষেপের মধ্যে অনেকগুলো আইএমএফ-এর শর্তের মধ্যেও রয়েছে।

অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আইএমএফ'র একটা শর্ত আছে, আবার আমাদেরও একটা প্রয়োজনীয়তা আছে। আইএমএফ-এর এই শর্ত এই বাধ্যবাধকতাটাকে আরো শক্তিশালী করে দিলো।


কর দেবে কে?
আইএমএফ’র একটি অন্যতম শর্ত হচ্ছে- দেশে কর-জিডিপির অনুপাত বাড়াতে হবে। সংস্থাটি চায়, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব আয় সন্তোষজনক পর্যায়ে বাড়ুক এবং খেলাপি ঋণ কমুক।

সংস্থাটির মতে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত সবচেয়ে কম। যার কারণে বিনিয়োগের যথেষ্ট অর্থ থাকে না সরকারের হাতে।

আইএমএফ’র শর্ত অনুযায়ী, অর্থ মন্ত্রণালয়কে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যাতে আগামী এক বছরে জিডিপির শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় হয়।

অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, রাজস্ব বাড়াতে হলে কর বাড়াতে হবে। এর মানে হচ্ছে বাজেটে কর নিয়ে নতুন প্রস্তাব আসবে। তবে এই প্রস্তাবের ধরনের উপর নির্ভর করবে যে, সেটা আসলে মানুষের উপর কতটা প্রভাব ফেলবে।

অতি ধনীদের উপর কর বসিয়ে, পাচার হওয়া টাকা উদ্ধার করে, এবং ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ উদ্ধার করে রাজস্ব আয় বাড়ানো হবে- তাহলে তা সাধারণ মানুষের উপর করের বোঝা কমাবে।

যদি রাজস্ব আয় বাড়াতে ভ্যাট বা পরোক্ষ কর বাড়িয়ে দেয়া হয় তাহলে তা মানুষের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। এই বিষয়টি আগামী বাজেটের মূল দেখার বিষয় হবে।

কর অবশ্যই বাড়াতে হবে কারণ আইএমএফ বলেই দিয়েছে যে, একটি নির্দিষ্ট হারে কর-জিডিপির অনুপাত বাড়িয়ে তিন বছর পর একটা নির্দিষ্ট অনুপাতে পৌঁছাতেই হবে।

অর্থনীতিবিদ এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আইএমএফ এর শর্ত অনুযায়ী, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বাড়িয়ে আগামী তিন বছরের মধ্যে আড়াই লাখ কোটি টাকা নতুন রাজস্ব আদায় করতে হবে।

এর জন্য বর্তমানে আমাদের রাজস্ব আয়ের যে সক্ষমতা তাতে বড় ধরনের পরিবর্তন দরকার।

ভর্তুকির পুনর্বিন্যাস
আইএমএফ এর শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে- বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের ভর্তুকি কমানো। তবে সরকার সে সময় বলেছিল, তারা নির্বিচারে ভর্তুকি কমাবে না। বরং সুনির্দিষ্ট খাত ধরে ভর্তুকি কমাবে।

এমএম আকাশ বলেন, আইএমএফ এর এই শর্তের প্রেক্ষিতে কৃষি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মতো খাতে ভর্তুকি কমাতে সরকার আগ্রহী নয় বলে জানিয়েছিল। এছাড়া তেল, গ্যাস বা পেট্রোলিয়ামের মতো জ্বালানিতেও ভর্তুকি কমানোর চিন্তা নেই সরকারের।

তিনি মনে করেন, সেখান থেকে সরকার সরে এসেছে। সরকার নিয়ম করেছে যে আন্তর্জাতিক বাজারের দর অনুযায়ী পেট্রোলিয়াম ও আমদানিকৃত জিনিসপত্রের দাম নির্ধারণ করতে হবে।

সে অনুযায়ী, পেট্রোলিয়ামের দাম কমার কথা। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে এই পণ্যটির দাম কমেছে। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যাচ্ছে না। তার মতে, এর পেছনে কারণ হচ্ছে সরকার আসলে ভর্তুকি কমিয়ে দিয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারের উপর ভর্তুকির কী ধরনের চাপ রয়েছে এবং সে অনুযায়ী তারা কোন কোন পণ্যে ভর্তুকি কমাবে আর আইএমএফ এর শর্তের কারণে কোন কোন পণ্যে ভর্তুকি কমাতে পারবে না- সে সম্পর্কে জানা যাবে আসছে বাজেট থেকে। বাজেটে এই বিষয়টি বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ভর্তুকি কমানোর ব্যাপারে আইএমএফ এর কোন সুনির্দিষ্ট খাত নেই। তবে তারা ভর্তুকি পুর্নবিবেচনার শর্ত দিয়েছে। বাংলাদেশেরও নিজেদের স্বার্থেই এটা পুর্নবিন্যাস করা উচিত।

তিনি বলেন, খাদ্য ভর্তুকিতে অবশ্যই দেশের নিজস্ব চাহিদাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।

জ্বালানি, বিদ্যুতের ভর্তুকির পুনর্বিবেচনার একটা চাপ আইএমএফ এর পক্ষ থেকে আছে। সেটার কিছুটা বাজেট প্রণয়নের সময় বিবেচনায় রাখতে হবে।

যে ধরনের চ্যালেঞ্জ আসবে
আইএমএফর তৃতীয় শর্ত ছিল ডলারের দাম বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন যে, অনেক আগে থেকেই দেশে ডলারের বিনিময় হার বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটি না করার কারণে আইএমএফ এর শর্ত অনুযায়ী, হঠাৎ করে এটি বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া হলে একটা ‘শক’ লাগার ব্যাপার কাজ করবে।

এম এম আকাশ বলেন, ডলারের দাম বেড়ে গেলে সব ধরনের আমদানিপণ্যের দাম বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে আমদানিকৃত পণ্য ব্যবহার করে যা উৎপাদন করা হয়ে সেগুলোরও দাম বাড়বে।

 চেইন ইফেক্টে মুদ্রাস্ফীতি হবে এবং সেই মুদ্রাস্ফীতি কী হারে হয়েছে ইতিমধ্যে এবং শর্তের কারণে আরো কতখানি হবে - সেটা এবারের বাজেটে দেখতে হবে।

আইএমএফ বাংলাদেশের সরকারকে যে ঋণ দিয়েছে তা পরিশোধ করতে হবে আগামী আগস্ট মাস থেকেই।

কারণ ফেব্রুয়ারি মাসে ঋণ দেয়া হয়েছে এবং সেই অনুযায়ী ছয় মাস পর থেকে ২.২ শতাংশ হারে সুদসহ কিস্তিতে ফেরত দিতে হবে।

আকাশ বলেন, সেটার জন্য ডলার সরকারের রিজার্ভে থাকতে হবে। কিন্তু আমাদের এক্সপোর্ট বাড়িয়ে, ইম্পোর্ট কমিয়ে, রেমিটেন্স বাড়িয়ে, সেই পরিমাণ ডলার রিজার্ভে রাখতে পারবে কিনা সেটাও এবারের বাজেটে হিসাব করে বাজেট প্রণয়ন করতে হবে।

অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে সেগুলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন না করা হলে সংস্থাটির পরবর্তী ৬টা কিস্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে।

আর আইএমএফ এর কিস্তি পেতে অসুবিধা হলে অন্যান্য যেসব দাতা গোষ্ঠী আছে যারা সংস্থাটির পরামর্শে এগিয়ে আসতে সম্মত হয়েছিলো তারাও পিছিয়ে যাবে। তার মতে, সেটারও একটা পরোক্ষ অভিঘাত আছে।

আইএমএফ’র কিছু কিছু শর্ত এরই মধ্যে মানতে শুরু করেছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। ভোক্তা ঋণের সুদহার তিন শতাংশ বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যাংক আমানতের বেঁধে দেওয়া সুদহার তুলে দেওয়া হয়েছে।

অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিনিময় হার, ভর্তুকির পুনর্বিন্যাস, সুদের হার বাজারের উপর ছেড়ে দিলে মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান-এগুলোর উপর বিরূপ প্রভাব কোনো কোনো ক্ষেত্রে পড়বে।

সেখানে সরকারের শুল্কনীতি বা রাজস্ব নীতির সঙ্গে আর্থিক নীতির সমন্বয় করার দরকার পড়বে। যেমন, যে পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তে থাকবে তার শুল্ক কমিয়ে সেটার দাম দেশীয় বাজারে সহনীয় রাখার মতো ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে। এক্ষেত্রে বার্ষিক মুদ্রানীতির সমন্বয়ের প্রয়োজন হবে।

অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, কর নীতির বোঝাটা যাতে গরীবের উপর না বেড়ে ধনীদের উপর বাড়ে। তবে সেক্ষেত্রে ধনীদের উপর সরকারের নির্ভরতা কমাতে হবে।

সূত্র: বিবিসি

 এসআর

×