ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আয়কর রিটার্ন প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ২১:৩৮, ১ ডিসেম্বর ২০২২

আয়কর রিটার্ন প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে কর-জিডিপি অনুপাত ১৩ শতাংশে উন্নীত করতে হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড করোনার পর থেকেই জাতীয় আয়কর দিবস পালন করছে না, যদিও এটি হতে পারত আয়কর আদায়ের  একটি সুবর্ণ সুযোগ। অন্যান্য বছরের মত হয়ত এবারও সরকার ডিসেম্বর পর্যন্ত আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার সময় বৃদ্ধি করবে বলে ধরা যায়। এখন পর্যন্ত যে আয়কর রিটার্ন জমা পড়েছে তা নির্ধারিত লক্ষ্যের চেয়ে অনেক কম। উপাত্ত বলছে, বাংলাদেশে টিনধারী লোকের সংখ্যা ৭৪ লাখ যার মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছে মাত্র ২৪ লাখ। যা করযোগ্য ব্যক্তির মাত্র ৩১ শতাংশ, যাদের ৮০ শতাংশ ঢাকা ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক। তাছাড়াও দেশের ৪৯৫টি উপজেলার মধ্যে মাত্র ৮২টিতে কর পরিশোধের ব্যবস্থা রয়েছে।

প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ করই রয়েছে রাজস্ব কাঠামোর মূল চালিকাশক্তি হিসেবে। স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের পথ পরিক্রমায় পাঁচ দশক পরেও দেশের করপোরেট ব্যবসা বাণিজ্য বৃদ্ধি পেলেও কোম্পানি প্রদত্ত আয়করের প্রবৃদ্ধি তেমন হারে বাড়েনি। অপর দিকে কোম্পানি ব্যতীত করদাতাদের মধ্যে ব্যক্তি করদাতা, পার্টনারশিপ ফার্ম, অ্যাসোসিয়েশন অব পারসনস ইত্যাদি রয়েছে যাদের করপোরেট করের আওতায় আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রতি বছর জুলাই-নভেম্বর মাস আসলেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর আহরণ আয়োজন শুরু হয় কিন্তু সারা বছরব্যাপী এ ধরনের তৎপরতা চোখে পড়ে না।

অথচ বাজেটভিত্তিক সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় রাজস্ব আদায়ের বিষয়টি অতিব গুরত্বপূর্ণ যার সঙ্গে সরকারের প্রশাসনিক পরিচালনার ব্যয়ের বিষয়টি জড়িত। কারণ প্রতি বছর সরকারকে রাজস্ব আয়ের ঘাটতির কারণে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে কোটি কোটি টাকা ধার করে প্রশাসনিক ব্যয় বহন করতে হয় যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
দেশের অর্থনীতির আকার বাড়ছে এবং সরকারি বিনিয়োগও বাড়ছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় কর-জিডিপির গড় অনুপাত ৩৬ শতাংশের মতো। উদীয়মান এশীয় দেশগুলোর অনুপাতও গড়ে প্রায় ২৭ শতাংশ এবং আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর গড় অনুপাত সাড়ে ১৮ শতাংশ। এমনকি সাব-সাহারা খ্যাত আফ্রিকার দেশগুলোর কর-জিডিপির গড় অনুপাত প্রায় ১৮ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি কর-জিডিপি অনুপাত নেপালের প্রায় ১৯ শতাংশ। এরপর ভুটানের ১৬ শতাংশ।

ভারতের ১২ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার ১১ দশমিক ৬ শতাংশ, পাকিস্তানের ১১ শতাংশ, আফগানিস্তানের ৯ দশমিক ৯ শতাংশ এবং মালদ্বীপের ৯ দশমিক ১ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৮ শতাংশের ঘরে। উল্লিখিত দেশগুলোয় রাজস্ব আহরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির মূলে কাজ করছে আধুনিক, সহজ ও নির্বিঘœ কর ব্যবস্থা, দক্ষ রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা এবং সর্বোপরি একটি সহায়ক রাজস্ব সংস্কৃতি। জিডিপির বিপরীতে কর আহরণের দিক থেকে অত্যন্ত দুর্বল অবস্থানে বাংলাদেশ। এখনো দেশের কর আহরণ ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি পরোক্ষ কর। এনবিআর এর তথ্যমতে, দেশে মোট আহরিত করে প্রত্যক্ষ করের অবদান মাত্র ৩৩ শতাংশ।

বাকিটুকু আসছে পরোক্ষ করের মাধ্যমে। জিডিপির বিপরীতে প্রত্যক্ষ কর আহরণের হিসেবে শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, গোটা বিশ্বেই বাংলাদেশের অবস্থান বেশ দুর্বল বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এখানো বাংলাদেশে ২০০ বছরের পুরনো কর কাঠামো চলছে, পৃথিবীর সব দেশই তাদের কর কাঠামোর উন্নয়ন করেছে, আর বাংলাদেশের বড় সমস্যা করনীতি প্রণয়ন ও কর আহরণ কার্যক্রম একটি প্রতিষ্ঠানের ওপরই ন্যস্ত যা আলাদা করা প্রয়োজন, যারা নীতি প্রণয়ন করবে তাদের সঙ্গে কর আহরণকারীদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ থাকবে না, কোড নাম্বার অনুযায়ী কর পরিশোধ হতে হবে, উভয়পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ হবে ই-মেইলে, এক স্থানের কর্মকর্তারা অন্য স্থানে কর আহরণ করবেন, তাহলে যোগাযোগের সুযোগ থাকবে এবং স্বচ্ছতা আসবে।

যারা কর আহরণ করেন এবং যারা নীতিনির্ধারণ করেন তাদের মধ্যে ব্যবধান থাকতে হবে যা হলে কর ব্যবস্থা আধুনিক হবে, একসঙ্গে থাকলে সেখানে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। পাশাপাশি করজালও বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের সুষম উন্নয়ন না হওয়ায় রাজস্বও সুষমভাবে সব জায়গা থেকে আসছে না এবং  পৃথিবীতে রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে একটি অনুসৃত কাঠামো হলো রাজস্ব বোর্ড ফাঁকি উদ্ঘাটন করবে, কিন্তু রাজস্ব আহরণ করবে না। এক সময় মানুষ বিভিন্ন কারণে টিআইএন নিয়েছে, কিন্তু রিটার্ন দেয়নি। এখন আইন করা হয়েছে, টিআইএন থাকলে বাধ্যতামূলকভাবে রিটার্ন জমা দিতে হবে এবং এ প্রক্রিয়া আরও সহজ করা হচ্ছে যার ফলে  ধীরে ধীরে রিটার্ন বাড়বে।
বলা হচ্ছে, মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে কর-জিডিপি অনুপাত ১৩ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত অবস্থার তেমন পরিবর্তন লক্ষণীয় হচ্ছে না। এরূপ অবস্থায় কর ফাঁকি রোধে এনবিআরের অটোমেশনে গতি আনা খুব জরুরি। এটা কেবল কর ফাঁকি ধরতে সাহায্য করবে না, উপরন্তু নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করা এবং এনবিআর ডাটাবেজের সঙ্গে কর প্রদানকারীর ব্যাংক হিসাবের যোগাযোগ তৈরিতে সহায়তা করবে। সংস্থাটি এরই মধ্যে অবশ্য কিছু সার্ভিস সেন্টার খুলেছে। এ ব্যাপারে করদাতাদের ওয়াকিবহাল করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজস্ব বিভাগে কর গোয়েন্দা সেলকেও আরও সক্ষম ও কার্যকর করা আবশ্যক। বিশ্বায়নের যুগে ট্রান্সফার প্রাইসিং সেলকে অনেক শক্তিশালী করতে হবে, প্রয়োজনে ঢেলে সাজাতে হবে।
এর মধ্যেই বহুপ্রতীক্ষিত ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন শুরু করেছে সরকার এবং ব্যবসায়ীদেরও হয়রানি কীভাবে কমানো যায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। আয়কর আইন যুগোপযোগী এবং এটি এখন বাংলা ভাষায় করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে যা প্রশংসনীয়। এটা হলে অনেক অস্পষ্টতা দূর হবে এবং জনগণও এ-সম্পর্কিত বিধিবিধান সহজেই জানতে পারবে, যা কর বাড়াতে সহায়ক।

প্রতি বছরই করের আওতা বাড়ানোর কথা বলা হলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন কম এবং যারা নিয়মিতভাবে কর দেন, তাদের ওপরই দেয়া হয় বাড়তি চাপ। বড় শহরগুলোয় কর দেয়ার প্রবণতা বেশি হলেও মফস্বল পর্যায়ের অনেক সচ্ছল ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান করের আওতায় নেই। উদীয়মান গ্রোথ সেন্টারগুলো চিহ্নিত করে তাদের করের আওতায় আনা সময়ের দাবি বিধায় স্থানীয় কর কার্যালয়গুলো আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

×