ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৯ মে ২০২৫, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

আধুনিক প্রযুক্তির ভিড়ে হারিয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী গরু-মহিষের হাল চাষ

শাহাজাদ ইসলাম, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঠাকুরগাঁও

প্রকাশিত: ১০:৪৮, ২৭ মে ২০২৫

আধুনিক প্রযুক্তির ভিড়ে হারিয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী গরু-মহিষের হাল চাষ

ছবি: জনকণ্ঠ

এক সময় গ্রামীণ বাংলার কৃষিনির্ভর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল গরু-মহিষ দিয়ে হাল চাষ। সে সময় গ্রামীণ চাষাবাদের প্রধান উপকরণ ছিল গরু ও মহিষ। মাঠের পর মাঠজুড়ে দেখা যেত গরু-মহিষে টানা লাঙলের দৃশ্য।
কৃষকের ঘামে ভেজা শরীর, গরুর গলায় ঝুলন্ত ঘণ্টা, আর লাঙলের ফলা ফুঁড়ে উঠে আসা উর্বর মাটি—এই ছিল গ্রামীণ জীবনের চেনা ছবি। কিন্তু সময়ের স্রোতে ও প্রযুক্তির অগ্রগতিতে সেই দৃশ্য এখন প্রায় হারিয়ে গেছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি, ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার এসে দখল করেছে চাষের মাঠ। ফলে গরু-মহিষ দিয়ে হাল চাষ করার ঐতিহ্য ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ঢোলারহাট ইউনিয়নের প্রবীণ কৃষক আব্দুল হালিম বলেন, “আমার বাবা-চাচারা গরু দিয়ে হাল চাষ করতেন, আমি শিখেছি তাদের কাছ থেকেই। এখন আমার ছেলে ট্রাক্টর ভাড়া করে চাষ করে। গরু-মহিষের হাল আর মাঠে দেখা যায় না।”

একজন আরেক প্রবীণ কৃষক বলেন, “আগে প্রতিটি বাড়িতেই গরু-মহিষ থাকত। জমিতে হাল চাষ করা মানে ছিল একটা উৎসব। এখন সেই দিন আর নেই। সবকিছু মেশিননির্ভর হয়ে গেছে।”

তরুণ কৃষকদের ভাষ্য, গরু-মহিষ পালন কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। গরু দিয়ে হাল চাষে সময় বেশি লাগে, খরচও বেশি। তার চেয়ে পাওয়ার টিলার দিয়ে অল্প সময়েই পুরো জমি চাষ হয়ে যায়।

এদিকে কিছু প্রবীণ কৃষক দুঃখ করে বলেন, “গরু-মহিষ শুধু চাষের জন্য নয়, একসময় তারা ছিল কৃষকের সাথী। এখন তারা নেই—মনে হয় মাঠগুলো যেন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে।” কালের পরিবর্তনে সেই চিত্র আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।

ঠাকুরগাঁও কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলায় কৃষিকাজে যান্ত্রিকীকরণের হার প্রায় ৯৯%। ফলে ঐতিহ্যবাহী হাল চাষ বিলুপ্তির মুখে।

তবে কিছু কৃষি গবেষক ও সংস্কৃতি সচেতন মহল মনে করেন, গরু-মহিষের হাল চাষ শুধু একটি কৃষি পদ্ধতি নয়—এটি একটি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও শিকড়ের অংশ। তারা চান সরকার বা স্থানীয় প্রশাসন যেন এই ঐতিহ্যবাহী কৃষিপদ্ধতির সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়, যেমন: প্রদর্শনী মাঠ, মেলা বা শিক্ষামূলক কার্যক্রম আয়োজন।

স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা জানান, প্রযুক্তি কৃষিতে গতি এনেছে ঠিকই, তবে ঐতিহ্যগত কৃষিপদ্ধতিও আমাদের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় বহন করে। ঠাকুরগাঁওয়ে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বিভিন্ন যাদুঘরে এই ঐতিহ্য পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষিত আছে।

গ্রামবাংলার শস্যভরা মাঠে গরু-মহিষের লাঙলের দৃশ্য যেন স্মৃতিতে বন্দি না হয়ে যায়, সে চেষ্টাই এখন সময়ের দাবি।

মুমু

×