ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ৩০ মে ২০২৫, ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

দ্বিগুণ গতিতে ভিডিও দেখার অভ্যাসে লুকিয়ে থাকা ভয়ংকর বিপদ

প্রকাশিত: ১০:১৩, ২৯ মে ২০২৫

দ্বিগুণ গতিতে ভিডিও দেখার অভ্যাসে লুকিয়ে থাকা ভয়ংকর বিপদ

ছবি: সংগৃহীত

নিশ্চিতভাবেই আপনার কিছুটা অস্বস্তি লাগবে, যখন দেখবেন আপনার প্রিয় কোনো গানের আবেগময় পরিবেশনা আপনি ২ গুণ গতিতে দেখছেন। মাত্র ৩০ সেকেন্ডের একটি ক্লিপ, সেখানে প্রিয় একটি লাইন শোনার জন্যই আপনি ২এক্স বাটনে চাপ দিচ্ছেন।

“আমি না জেনেই রিলস ২এক্স স্পিডে দেখার অভ্যাস গড়ে তুলেছিলাম। একদিন হঠাৎ নিজের প্রিয় গানের ভিডিও তেও একই কাজ করতে গিয়ে বুঝলাম ব্যাপারটা অন্যরকম কিছু হয়ে গেছে,” বলছেন দিল্লির ২৯ বছর বয়সী কর্মজীবী মান্য।

“আমার ভাই, যে নিজেও একজন সংগীতপ্রেমী, তখন পাশে বসা ছিল। সে-ই বিষয়টা প্রথম লক্ষ্য করে। তখনই আমার মাথায় আঘাতের মতো আসে—আমার মনোযোগ ক্ষমতা হয়তো আরও খারাপ হয়ে গেছে,” যোগ করেন তিনি।

ইনস্টাগ্রামের রিলস, যা ইতিমধ্যেই একটি ছোট ভিডিও ফরম্যাট, সেটিকে দ্বিগুণ গতিতে দেখার প্রবণতা নতুন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে ব্যবহারকারীদের জন্য। এ বছরের মার্চে, ইনস্টাগ্রাম এমন একটি ফিচার চালু করে, যার মাধ্যমে রিলের যেকোনো প্রান্তে লং প্রেস করলেই ভিডিওটি ২এক্স স্পিডে চলতে থাকে।

“আজ আমরা বিশ্বব্যাপী ইনস্টাগ্রাম রিলস ২এক্স স্পিডে দেখার সুবিধা চালু করছি। আমাদের কমিউনিটির তরফ থেকে এটি বহুলভাবে অনুরোধ করা হয়েছিল, এবং আমরা আশা করি এই ফিচার আপনাকে কনটেন্ট দেখার অভিজ্ঞতা আরও নিয়ন্ত্রণে আনতে সাহায্য করবে,” ঘোষণা করে ইনস্টাগ্রাম।

এই ফিচার আসে এমন এক সময়ে, যখন মেটা রিলসের সময়সীমা ৩ মিনিটে উন্নীত করে।

২এক্স স্পিডে কনটেন্ট দেখা: একটি সাধারণ প্রবণতা
ইউটিউব ও টিকটকের মতো ভিডিও প্ল্যাটফর্মেও অনেক আগেই এই ফিচার চালু হয়েছে। এমনকি নেটফ্লিক্স ও প্রাইম ভিডিওর মতো স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মেও দর্শকরা সিনেমা বা সিরিজ দ্রুতগতিতে দেখার সুযোগ পান।

“আমি সিনেমা দেখতে খুবই ভালোবাসি, কিন্তু হলে বসে যখন একটা বিরক্তিকর দৃশ্য আসে, তখন তা স্কিপ করতে না পারা আমাকে কষ্ট দেয়। বাসায় যখন দেখি, তখন অপ্রয়োজনীয় গান বা দৃশ্য আমি চট করে স্কিপ করে দেই,” বলেন ৩১ বছর বয়সী তনিশা। তবে তিনি স্বীকার করেন, এই অভ্যাস নিয়ে তার মধ্যে অপরাধবোধও কাজ করে।

লম্বা ভিডিওতে ২এক্স স্পিড ব্যবহার নতুন কিছু না হলেও, ইতিমধ্যে ছোট ভিডিওতে এ ধরনের ব্যবহার অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।

এই ছোট পরিবর্তন মনোযোগ ক্ষমতা, মানসিক প্রক্রিয়া ও সম্পর্কের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে বই পড়া বা একটানা সিনেমা দেখা কঠিন হয়ে ওঠে।

আচরণে প্রভাব ও মনোযোগের অবনতি
“এই প্রবণতা আমাদের ধৈর্য ও গভীর কনটেন্ট গ্রহণ করার ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। আমাদের মস্তিষ্ক ধীরে চলা কনটেন্ট—যেমন গভীর আলাপ, দীর্ঘ বই বা শান্ত মুহূর্ত সহ্য করতে পারে না, কারণ আমরা সবসময় দ্রুত কনটেন্টের মধ্যে থাকি,” বলছেন মুম্বাইয়ের পি. ডি. হিন্দুজা হাসপাতালের মনোবিজ্ঞানী ও কাউন্সেলর শীনা সূদ।

আরেট হসপিটালসের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. বিষ্ণু গাডে বলেন, “মানুষ যখন দ্রুত ভিডিওতেও ধৈর্য হারায়, তখন বোঝা যায় তারা ক্রমশ অধৈর্য হয়ে উঠছে। এমনকি এক সেকেন্ডও বড় মনে হয়, সবাই চায় সরাসরি মূল বিষয়ে যেতে। এটা স্পষ্ট করে দেয়, আমাদের ধৈর্য্যের প্রাথমিক মান দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।”

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, আপনি যদি সবসময় ছোট ভিডিও ২এক্স স্পিডে দেখেন, তাহলে বাস্তব জীবনে শোনা বা শেখার মতো বিষয়েও মনোযোগ হারাতে পারেন।

বাড়তি কনটেন্ট ও সময়ের চাপই এই অভ্যাসের পেছনে মূল কারণ।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, মাঝে মাঝে আগেই দেখা ভিডিও দ্রুত গতিতে দেখা ক্ষতিকর না হলেও, যখন গান বা সাধারণ কনটেন্টও আপনার কাছে ধীরে মনে হয়, তখন এটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

এই অভ্যাস মনোযোগ ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে—যেমন কনটেন্টে গভীরভাবে সংযুক্ত না হওয়া। ফলে তথ্য ধারণ বা ধরে রাখার ক্ষমতা কমে যায়।

২এক্স স্পিডে দেখা কমিয়ে দেয় অনুধাবন ক্ষমতাও।

“এভাবে দ্রুত ভিডিও দেখলে জটিল বিষয় যেমন গণিত, রসায়ন বা সমস্যা সমাধানের ধারণা বুঝতে সমস্যা হয়। কারণ দ্রুত গতিতে বিষয়টি ধরতে পারা কঠিন হয়ে পড়ে,” ব্যাখ্যা করেন ডা. গাডে।

এর ফলে দেখা দিতে পারে উদ্বেগ, সৃষ্টিশীলতার ঘাটতি, বাস্তব জীবনে অধৈর্যতা, সহানুভূতির অভাব, আবেগী অস্থিরতা এবং দ্রুত কথা বলার প্রবণতা।

ছোট ভিডিও দ্রুত গতিতে দেখার এই আসক্তি তাত্ক্ষণিক সন্তুষ্টির চাহিদাকে আরও উস্কে দেয় এবং আমাদের তথ্য প্রক্রিয়াকরণের ধরন বদলে দেয়।

“টিকটক বা ইনস্টাগ্রাম রিলস এমনিতেই ছোট কনটেন্ট দেয়, সেখানে ২এক্স স্পিডে দেখার সুবিধা মানুষকে আরও বেশি তাত্ক্ষণিক আনন্দে অভ্যস্ত করে তোলে। এই নিরবিচার ডোপামিন উদ্দীপনা আমাদের গভীর মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায়, দীর্ঘ সময়ের কনটেন্ট বা বাস্তব জীবনের আলাপে মন বসানো কঠিন হয়ে পড়ে,” বলেন হায়দরাবাদের কেয়ার হসপিটালের সিনিয়র নিউরোলজিস্ট ডা. বিক্রম শর্মা।

সারকথা, দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব শুধু মনোযোগ নয়, চিন্তা, অনুভূতি, শেখার ধরন ও সম্পর্ককেও বদলে দেয়।

ভালো খবর: মনোযোগ ক্ষমতা প্রশিক্ষণযোগ্য
একসাথে একটি কাজে মনোযোগ ধরে রাখা এবং তা শেষ করতে পারা মানেই আপনার মনোযোগ ক্ষমতা ভালো। নতুন কিছু শেখা, গভীরভাবে কাউকে শোনা কিংবা মানসিক শান্তির জন্যও এই ক্ষমতা দরকার।

মনোযোগহীন মন মানেই অকারণ উদ্বেগ ও অজানা অস্বস্তি—বলছেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

এই খারাপ অভ্যাস দূর করতে ছোট কিন্তু ধারাবাহিক কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন—চা খাওয়ার সময় ফোন না দেখা, দিনে কয়েকবার স্ক্রিন থেকে বিরতি নেওয়া।

বহু কাজে মনোযোগ না দিয়ে একসাথে একটি কাজে মনোযোগী হন। ফোন দূরে রাখতে DND বা সাইলেন্ট মোড ব্যবহার করুন।

গভীর মনোযোগ বা ‘ডিপ ওয়ার্ক’ চর্চা করুন। ডা. গাডে বলেন, “একটানা ২৫ মিনিট কোনো বাধা ছাড়াই কাজ করুন, এরপর ৫ মিনিট বিরতি নিন। ধীরে ধীরে সময় বাড়ান। এতে মনোযোগ প্রশিক্ষণ হয়।”

“মস্তিষ্ককে রিসেট করতে অন্তত ১৫ মিনিট বিরতি দরকার। বই পড়া, হাতে লিখে কিছু করা, আঁকা, রান্না—এসব কাজে মনোযোগ ক্ষমতা ফিরে আসে,” বলেন শীনা সূদ।

প্রকৃতির মাঝে সময় কাটানো, ১৫–৩০ মিনিট ফোন ছাড়াই বাইরে হাঁটা মনোযোগ ফিরিয়ে আনার কার্যকর উপায়।

এছাড়া ভালো ঘুম, নিয়মিত ব্যায়াম, ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ খাবার (মাছ, বাদাম, সবুজ শাকসবজি), প্রসেসড ফুড এড়িয়ে চলা এবং মেডিটেশন মনোযোগ উন্নত করে।

বই পড়া, ধাঁধা মেলানো, আঁকা, বাদ্যযন্ত্র বাজানো বা নতুন ভাষা শেখার মতো কাজগুলো অবশ্যই করতে হবে। কারণ এগুলো মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়ায়।



সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে

আবির

×