
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার সরোজগঞ্জ হাট
বাড়ির আঙিনায়, পথের ধারে, ক্ষেতের আইলে অগুন্তি খেজুর গাছের শোভা পাচ্ছে চুয়াডাঙ্গার জনপদে। ২ লাখ ৭২ হাজারের মতো খেজুর গাছ আছে এ জেলায়। শীত মানেই খেজুর গাছে রসের ভাঁড়। আগেরদিন বিকেলে বসানো ভাঁড়ে রাতভর নলি (বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি) বেয়ে মিষ্টি রস সঞ্চয়। কুয়াশার চাদরে মোড়া ভোরে গাছিরা সাজসরঞ্জামসহ পথে নামে রসের ভাঁড় সংগ্রহে। গাছে পোঁতা গুঁজে আটকে রাখা ভাঁড় গাছিরা কায়দা করে নামান লম্বা বাঁশের লগি দিয়ে। খেজুর গাছের সংখ্যা বেশি হওয়ায় চুয়াডাঙ্গায় গাছিরা গাছ বেয়ে উপরে না উঠে এভাবেই ভাঁড় নামান। এ জেলার মাটি ও আবহাওয়া খেজুর গাছ চাষের জন্য খুবই উপযোগী। অন্যান্য এলাকার তুলনায় এখানকার গাছিরা রসও পান পরিমাণে বেশি। প্রতিটি গাছ থেকে এক মৌসুমে যে পরিমাণ রস মেলে তা দিয়ে ১০ থেকে ১২ কেজির মতো গুড় বানানো যায়। শীতের কুয়াশামাখা ভোরে কাঁধের বাঁকে রসের ভাঁড় ঝুলিয়ে গাছিদের চলাচলের মনোরম দৃশ্য দেশের অন্য এলাকায় কমে গেলেও চুয়াডাঙ্গায় এখনো মুগ্ধতা ছড়াই। গাছিদের সংগ্রহ করা কাঁচা রসের একাংশ বিক্রি হয় পানীয় হিসেবে। বেশিরভাগটা কাজে লাগে গুড় বানাতে। শীত মৌসুমে সাতসকালে খেজুরের রস দিয়ে গুড় বানানোর এমন আয়োজন চুয়াডাঙ্গার গ্রাম-গ্রামান্তরে চলে কয়েক হাজার পরিবারে। এক ভাঁড় রস থেকে সাধারণত এক কেজি গুড় বানানো যায়। ১০-১২ ভাঁড় রস দিয়ে গুড় বানানো হয় ১০-১২ কেজি। রস জ্বালানো চুলাকে বলা হয় বাইন। বাইনের দুদিকে থাকে দুটি ছিদ্র। এর একটি জ্বালানি যোগান দেওয়ার অন্যটি পোড়া অবশিষ্ট বের করার। রস জ্বালানো চৌক পাত্রকে বলা হয় জ্বালা হাঁড়ি। লাকড়ি-পাতার সঙ্গে খেজুরপাতা ও আখের ছোবড়া ব্যবহৃত হয় জ্বালানি হিসেবে। জ্বালা হাঁড়ি আগে ছিল মাটির তৈরি গোলাকার। এখন টিনের তৈরি চৌকোণা। রস জ্বালাতে জ্বালানি লাগে প্রচুর। রস জ্বাল দেওয়ার সময় ঘন কুয়াশার মতো জলীয়বাষ্প ছেয়ে যায় চারপাশ। জ্বাল হতে হতে সাদা সাদা গাদ জমে রসে। নিয়মিত বিরতিতে গাদ ফেলে দেওয়ার পাশাপাশি উরকিমালা (নারিকেল মালা ও বাঁশের কাঠি দিয়ে তৈরি) দিয়ে লাগাতার নাড়তে হয় রস। জ্বাল দেওয়া রস লালচে ও ঘন হয় ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে। জ্বাল দেওয়া রস কাক্সিক্ষত মাত্রায় ঘন হলে বাইন থেকে নামানো হয় জ্বালা হাঁড়ি। জ্বালা হাঁড়ির উত্তপ্ত রস যত তাপ হারায় জমাট বাঁধে তত। খানিকটা ঘন রস আলাদা করে নিয়ে এবার বিচ মারার পর্ব। একটানা ঘষে ঘষে সাদা ক্রিম বানানোকেই বিচ মারা বলে। এই বিচ মারার ওপর নির্ভর করে গুড়ের মান ও ধরন। বানানো সাদা ক্রিম বাকি গুড়কে জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। সাধারণত বিচ মারা যত ভাল হয় গুড়ও জমাট বেঁধে তত ঘন হয়। গুড় এবার মাটির নতুন ভাঁড়ে ভরার পালা। ভাঁড়ে ভরার সময় গুড়ের মিষ্টি ঘ্রাণে মন ভরে যায়। মাটির তৈরি বিশেষ আকৃতির এই ভাঁড়ে চুয়াডাঙ্গার গুড় বাজারজাত হয় সবখানে। বিচ মারা ঠিকঠাক হলে ভাঁড়ে ভরা গুড় আরও জমাট বেঁধে দানাদার হয়। কিন্তু বিচ মারা কম হলে ঝোলগুড় হিসেবে রয়ে যায়। কলস আকৃতির ভাঁড়ে রাখা হয় বলে স্থানীয়রা কেউ কেউ বলেন কলসগুড়। দানাদার হওয়ায় কেউ বলেন দানাগুড়। তবে দানাগুড় নামেই এটি বেশি পরিচিত। একেকটা মাটির ভাঁড়ে সাধারণত ১০-১৫ কেজির মতো গুড় ধরে। স্থানীয় হাট-বাজারে পাইকাররা গুড় কেনেন ভাঁড় হিসেবে। খুচরা ক্রেতারা কেনেন কেজি হিসেবে। চুয়াডাঙ্গায় ২ লাখ ৭২ হাজার খেজুর গাছ থেকে বছরে মেলে প্রায় ২ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন গুড়। যার বাজারমূল্য ৬৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ গুড় স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বেশিরভাগ পাইকারের মাধ্যমে চালান হয় দেশের নানা জায়গায়। দেশের বাইরেও কদর আছে এ গুড়ের। খেজুর গুড় উৎপাদনে সারাদেশের মধ্যে চুয়াডাঙ্গা প্রথম স্থানটি দখল করেছে জনপ্রিয় এই কলসগুড়ের কল্যাণে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় খেজুরের গুড়েরহাট চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার সরোজগঞ্জে। শীত মৌসুমে জমজমাট এই হাট বসে সপ্তাহে দুদিনÑ সোমবার ও শুক্রবার। কাছে ও দূরের গ্রাম-গঞ্জ থেকে গুড়ের কলস নিয়ে এ হাটে আসেন সাইকেলসহ নানান বাহনে কৃষক-ব্যবসায়ীরা। হাটবারে সারি সারি গুড়ের ভাঁড়ে ছেয়ে যায় হাটচত্বর। কাঠির সাহায্যে ভাঁড়ে রাখা গুড় ক্রেতারা পরখ করেন ঘনত্ব, রং এবং ঘ্রাণ। এতেই ক্রেতারা বুঝে যান কোন ভাঁড়ের গুড় কতটা খাঁটি। খাঁটি খেজুরের গুড় সাধারণত কালচে লাল, নরম ও রসালো হয়। এখানে পাইকাররা পরখ করে গুড় কেনেন বেশি। দরদামের আগে ভাঁড়ের ওজন বোঝাটাও জরুরি। সাধারণত ১০-১৫ কেজির মতো গুড় থাকে প্রতি ভাঁড়ে। দরদাম মিটমাট হলে ভাঁড়ে সাংকেতিক চিহ্ন এঁকে দেন ক্রেতা। সাংকেতিক এই চিহ্ন আঁকার কারণÑ পরে হাট থেকে যাতে দ্রুত অন্যত্র নিয়ে যাওয়া যায়। পাইকারের লোকজন একের পর এক ভাঁড় কেনেন নানা বিক্রেতার কাছ থেকে। কেনা ভাঁড়গুলো জমানো হয় নির্দিষ্ট কোন জায়গায়। দরদাম এই হাটে নির্ধারিত হয় গুড়ের মান এবং ভাঁড়ের আকার ও ওজনভেদে। দরাদরির মাধ্যমে মান ও ওজনভেদে এক ভাঁড় গুড় বিক্রি হয় ৯০০ থেকে ১৪০০ টাকা পর্যন্ত। প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে কেনা যায় বলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বরিশালসহ নানা জায়গার বড় বড় মোকাম থেকে ব্যাপারীরা এখানে আসেন গুড় কিনতে। এই হাটে দানাদার খেজুর গুড়ের পাশাপাশি পাটালি আর ঝোলাগুড়ও কম-বেশি বিক্রি হয়। মাটির খালি ভাঁড়ও বিক্রি হয় এই হাটে। মাটির তৈরি কলস আকৃতির বিশেষ এই ভাঁড়ে ভরে চুয়াডাঙ্গার এই গুড় বাজারজাত হয় সবখানে। খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে গুড় বানান যারা তারাই স্থানীয় কুমারদের বানোনো খালি এসব ভাঁড় কিনে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। হাটজুড়ে গুড়ের ম ম গন্ধ। চুয়াডাঙ্গার গুড় সুস্বাদু খুব। এ কারণে দাম কিছুটা বেশি হলেও এখানকার গুড়ের কদর অন্যান্য এলাকার চেয়ে বেশি। ভাঁড়ের ওজন যাচাইয়ের ব্যবস্থাও আছে এই হাটে। স্থানীয় ক্রেতারা গুড় সাধারণ চালান করে নসিমন, করিমনে করে। দূরের গন্তব্যে চালান করার আগে মুখ ঢাকতে হয় ভাঁড়ের। প্রথমে কাগজের আবরণে পরে পলিব্যাগের মোড়কে। ধুলাবালি এড়ানোর জন্য এমন প্রথাবরণ। এর পর মুখ ঢাকা ভাঁড় বাহনে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বিভিন্ন প্রান্তে।
ঐতিহ্যবাহী সরোজগঞ্জ খেজুর
গুড়ের হাট
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার সরোজগঞ্জ হাটে পৌঁছানো মাত্রই চোখে পড়ে সারি সারি বাইসাইকেল, আলমসাধু, নছিমন-করিমন, ট্রাক ও কলসভর্তি খেজুর গুড়। সরোজগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে ফজরের নামাজের পর থেকে শুরু হওয়া হাটে সকাল ১০টার দিকে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে কৃষকরা গুড়ভর্তি মাটির কলস (ভাঁড়) নিয়ে এসেছেন। নলেন গুড়ের সুগন্ধে চারদিকের বাতাস ম-ম করছে। এখানকার খেজুর গুড়ের সুনাম সারাদেশে। এমনকি বিদেশেও রপ্তানি হয়। চুয়াডাঙ্গার খেজুরের গুড় ও নলেন পাটালির সুখ্যাতি আছে। স্বাদে-গন্ধেও অতুলনীয়। খেজুর গুড় ও নলেন পাটালি বেচাকেনাকে কেন্দ্র করে এখন জমজমাট ঐতিহ্যবাহী সরোজগঞ্জ সাপ্তাহিক শুক্রবার ও সোমবারের হাট। হাটের দিন এখানে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন ব্যাপারীসহ হাজারো ক্রেতা-বিক্রেতা। ফলে জমে উঠেছে দেশের সর্ববৃহৎ চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জের খেজুর গুড়ের হাট। বিগত বছরগুলোর মতো গুড় কিনতে বিভিন্ন জেলা থেকে আসছেন ব্যাপারীরা। বেচাকেনার জন্য এই হাটের ঐতিহ্য কয়েকশ’ বছরের।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ আঞ্চলিক মহাসড়ক ঘেঁষে জেলার সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের সরোজগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে বসে এ হাট। সপ্তাহে শুক্রবার ও সোমবার এ হাটে ফজরের নামাজের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে বেচাকেনা।
গ্রামবাংলার ঐতিহ্য পিঠা-পুলির উৎসব
বাড়ি বাড়ি চলছে খেজুর গুড়ের তৈরি আবহমান গ্রামবাংলার ঐতিহ্য পিঠা-পুলির উৎসব। প্রতিবছরই শীতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ জেলার গ্রামাঞ্চলে সকাল হলেই খেজুর রস, পিঠা ও নলেন গুড়ের ম-ম গন্ধে ভরে ওঠে পুরো এলাকা। শীতের সকালে খেজুরের ঠান্ডা রস পান করা যে কতটা তৃপ্তিকর তা বলে বোঝানো যায় না। আর খেজুর রসের পিঠা-পায়েস যে কেমন মজাদার তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতিবছরের মতো এবারও শীতের শুরুতেই গ্রামাঞ্চলে খেজুর রসের ক্ষীর, পিঠা, পায়েস তৈরির ধুম পড়ে গেছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো বাড়িতে চলছে খেজুরের রস ও গুড়ের তৈরি নানারকম খাবারের আয়োজন।
শীতের সকালে বাড়ির উঠানে বসে পিঠে মিষ্টি রোদ লাগিয়ে খেজুরের গরম গরম ঝোলাগুড় দিয়ে রুটি খাওয়ার মজাই আলাদা। একবার খেলে তার স্বাদ মুখে লেগে থাকে অনেকদিন পর্যন্ত। খেজুর গুড় দিয়ে তৈরি হয় সুস্বাদু পাটালি। নতুন ধানের মুড়ি আর পাটালি খুবই মুখোরোচক খাবার। খেজুরের নলেন গুড় ছাড়া শীতকালীন পিঠা-পায়েসের উৎসবের কথা ভাবাই যায় না। আগেকার দিনে শীত মৌসুমে জেলার গ্রামাঞ্চলের মানুষের সকালের নাস্তা হতো নতুন ধানের চিড়া, ঘরে পাতা দই আর খেজুর গুড় দিয়ে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় নানারকম খাবারের ভিড়ে সেসব আজ শুধুই স্মৃতি। সূত্রে জানা গেছে, এক সময় চুয়াডাঙ্গার সব অঞ্চলই খেজুর গুড়ের জন্য বিখ্যাত ছিল। দেশের বিভিন্ন জেলায় এই খেজুর গুড়ের ব্যাপক চাহিদা ছিল। এ এলাকার বিভিন্ন হাটবাজার থেকে বিভিন্ন যানবাহনযোগে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ খেজুর গুড় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চালান হতো।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পূর্বে জীবননগর বাজারের খেজুর গুড় চালান হতো ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার বিভিন্ন অঞ্চল, কলকাতাসহ বিভিন্ন শহরে। ওই সময় ভারতের রানাঘাট ও মাজদিয়া হাটের ব্যাপারীরা এসে দামুড়হুদা সদর, কার্পাসডাঙ্গা, জীবননগরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে গুড় কিনে গরু ও ঘোড়ার গাড়িতে বোঝাই করে নিয়ে যেত তাদের নিজ নিজ এলাকায়। সদর উপজেলার জয়রামপুর গ্রামের গাছি আলী হোসেন বলেন, আমি প্রায় ২০-২৫ বছর যাবৎ খেজুর রস সংগ্রহ ও খেজুর গুড় তৈরি করে আসছি।
আগে এ কাজে ভালই লাভ হতো। গুড় তৈরির কাজ করে এখন আর আগের মতো লাভ হয় না। কারণ, আগে এলাকার সব মাঠে ও গ্রামের আনাচে-কানাচে খেজুর গাছ ছিল। একসঙ্গে অনেক গাছ কাটা যেত। এখন এলাকায় খেজুর গাছ অনেক কমে গেছে। অন্যান্য কাজের ফাঁকে এ কাজ করতে হয়। প্রতিবছর ভাঁটিতে ইট ও টালি পোড়াতে বিপুলসংখ্যক খেজুর গাছ কেটে সাবাড় করা হচ্ছে। যে হারে বড় বড় খেজুর গাছ কাটা পড়ছে তাতে কয়েক বছর পর আর রসের জন্য বড় গাছ পাওয়া যাবে না।
যাদবপুর গ্রামের ইসমাইল হোসেন বলেন, চুয়াডাঙ্গা জেলার খেজুর গাছের রস থেকে উৎপাদিত গুড় দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। প্রতিবছর গ্রাম থেকে ট্রাকভর্তি গুড় দেশের বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানি হয়ে থাকে। গ্রামবাংলার সেই ঐতিহ্য খেজুর গাছ অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাঁটির কারণে আজ বিলুপ্তির পথে। প্রতিদিন ইটভাঁটির জ্বালানির কাজে নিধন হচ্ছে এলাকার শত শত খেজুর গাছ। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর পরও গাছিরা তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
উপকার ও অপকারিতা
খেজুর গুড়ের বিশেষ উপকারিতা কি কি?
আমাদের প্রায় সবারই খেজুর অনেক ভালো লাগে। ঠিক তেমনি শীতকালে গ্রামে-গঞ্জে খেজুরের রস আমাদের খুবই প্রিয়। শহরের অনেকেই গ্রামে যেয়ে খেজুরের রস খাওয়ার আনন্দ নেয়। সেই খেজুরের রস থেকে যখন তাজা ও খাঁটি গুড় তৈরি হয়, সেটা খালি হোক কিংবা মুড়ি দিয়ে; আমরা খেতে পিছপা হই না। কিন্তু, মজার জন্য খেলেও এই খেজুর গুড়ের উপকারিতা কি কি তা জানলে আমরা অবাক হব।
খেজুর গুড়ের উপকারিতা
আমরা যারা খেজুরের গুড় খাই, তারা সাধারণত শখের বসেই খাই। কিন্তু, এই গুড়ে কি কি উপকারিতা রয়েছে তা আমরা ঠিকমতো জানি না। আপনাদের বোঝার সুবিধার্থে বিশেষ উপকারিতাগুলো বিস্তারিত বর্ণনা করছিÑ
হজমের সমস্যা দূর করে ॥ খেজুরের গুড়ে ফসফরাস, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম জাতীয় খনিজ উপাদান রয়েছে যা হজমের সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। এতে উচ্চমাত্রায় ‘কম্পোজিট কার্বহাইড্রেট’ রয়েছে যা সাধারণ চিনির চেয়ে খাবারকে দ্রুত হজম করতে সাহায্য করে। নিয়মিত এক চামচ গুড় খেলে এর ফাইবার উপাদান মলত্যাগ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে, কোষ্ঠকাঠিন্য, আমাশয় এবং বদহজমের সমস্যা দূর করে।
ওজন কমাতে সাহায্য করে ॥ খেজুরের গুড়ে প্রাকৃতিক চিনি থাকে যা সাধারণ চিনি থেকে কম ক্যালরি বহন করে। এই চিনি রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। ফলে আমরা ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ এবং অতিরিক্ত খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে পারি। নিয়মিত চায়ের সঙ্গে বা গরম পানির সঙ্গে সাধারণ চিনির পরিবর্তে খেজুরের গুড় খেলে আমাদের হজমে সুবিধা হবে, পুষ্টি শোষণে সহায়তা হবে। এতে আমাদের ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
কোল্ড অ্যালার্জি থেকে রক্ষা করে ॥ খেজুরের মতোই খেজুরের গুড়ে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য শরীরের প্রদাহ কমায় এবং অ্যালার্জি রোধ করে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই গুড়ে থাকা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে লড়াই করে শরীরকে সুস্থ রাখে। তাই শীতকালে বা কারো অ্যালার্জির সমস্যা যেমন নাক বন্ধ হওয়া বা বয়ে যাওয়া, হাঁচি, চোখে জল আসা, গলা ব্যথা, কাশি, মাথাব্যথা থাকলে খেজুরের গুড় খেলে তা দূর হবে।
শরীরে আয়রনের ঘাটতি মেটায় ॥ আমরা জানি না কিন্তু অনেকেই এমন আছেন, যাদের শরীরে আয়রনের ঘাটতি রয়েছে। এতে দেখা যায়, আমরা নানা ধরনের অসুখে আক্রান্ত হই। এক চা চামচ খেজুরের গুড়ে প্রায় ০.৫ মিলিগ্রাম আয়রন থাকে যা শরীরে আয়রনের ঘাটতি পূরণ করে রক্তশূন্যতাসহ আয়রনের ঘাটতিজনিত রোগব্যাধি দূর করতে পারে। গুড়ে থাকা ভিটামিন সি আমাদের শরীরে আয়রনের ঘাটতি কমায়, কপার লাল রক্ত কণিকা তৈরিতে সহায়তা করে এবং ফোলেট উপাদান আয়রনের পরিবহন এবং সংরক্ষণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মহিলাদের জন্য উপকারী ॥ গঠনগত বৈশিষ্ট্যের কারণে নারীদের এমন কিছু পুষ্টিগুণ প্রয়োজন যা সব ধরনের খাবারে থাকে না। খেজুরের গুড় নারীদের দেহে এন্ডোরফিন্স নিঃসরণ করে যা প্রাকৃতিক উপায়ে মাসিকজনিত ব্যথা ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি কমায়। এছাড়াও, এতে থাকা আয়রন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ম্যাগনেসিয়াম ও পটাশিয়াম মেয়েদের আরও নানা বিশেষ রোগ নিরাময়ে সাহায্য করে।
হাড় ও বাতের ব্যথা কমায় ॥ খেজুরের গুড়ে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং ক্যালসিয়াম জাতীয় খনিজ থাকে যা আমাদের আর্থ্রাইটিস, জয়েন্টের ব্যথা বা হাড়ের ব্যথা কমায় এবং ভিটামিন ডি ক্যালসিয়াম শোষণ করে। এছাড়াও, এতে থাকা অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান বাতের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। অর্থাৎ, পটাশিয়াম আমাদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, ম্যাগনেসিয়াম হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে এবং হাড়ের ক্ষয় প্রতিরোধ করে হাড়কে শক্তিশালী করে তোলে।
দিনে দৈনন্দিন খাবারের সঙ্গে অর্থাৎ রুটি দিয়ে, বা গুড় দিয়ে বানানো মিষ্টি পরিমাণমতো খেলে ভালো ফলাফল পাবেন।
মুখের ত্বক ভালো রাখে ॥ খেজুরের গুড়ে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আমাদের মুখের ত্বকের কোষগুলোকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচায়, মুখের ত্বক ভালো রাখে। এই গুড় আমাদের ত্বককে হাইড্রেটেড রাখে, ভিটামিন সি মুখের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য ব্রণ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে এবং এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আমাদের ত্বককে ফ্রি র্যাডিকেলের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে বয়সের ছাপ কমাতে সাহায্য করে। তাই, আপনি যদি আপনার মুখের শুষ্কতা দূর করতে চান এবং ত্বককে মসৃণ রাখতে চান, তাহলে নিয়মিত অল্প পরিমাণ হলেও খেজুরের গুড় খেতে হবে।
লিভার বা যকৃত ভালো রাখে ॥ অন্যান্য খাবারের চেয়ে খেজুরের গুড় আমাদের লিভার ভালো রাখতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে। গুড়ে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট লিভারের কোষগুলোকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে, লিভারের এনজাইমের মাত্রা উন্নত করে এবং লিভারের ফাংশনকে স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। এতে থাকা ফাইবার আমাদের কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে খেজুর গুড় উপকারিতা হিসেবে আমাদের ওজনের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপও নিয়ন্ত্রণে থাকে। তাছাড়া, সোডিয়াম ও পটাশিয়াম আমাদের দেহের পেশিকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করে যা লিভারের সুস্থ থাকার জন্য জরুরি।
রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়ায় ॥ রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে গেলে শরীরের বিভিন্ন টিস্যুতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ অক্সিজেন পৌঁছাতে পারে না। তাই হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম থাকলে ক্লান্তিবোধ, শ্বাসকষ্ট, মাথা ব্যথা বা মাথা ঘোরা, হাত-পা ঠাণ্ডাসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। খেজুরের গুড়ে থাকা ফোলেট এবং আয়রন রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়িয়ে রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
খেজুর গুড়ের অপকারিতা
কোনো খাবারই অতিরিক্ত খাওয়া উচিত নয়। ঠিক তেমনি খেজুরের গুড় বেশি পরিমাণে খেলে কিছু ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়াও দেখতে পারবেন। যেমন-
শরীরের ওজন বেড়ে যাবে : যেহেতু প্রতি ১০০ গ্রাম গুড়ে ৩৮৫ ক্যালরি শক্তি রয়েছে, তাই অতিরিক্ত খেলে ওজন বেড়ে যাবে। যাদের ওজন বেশি, এতে থাকা কার্বোহাইড্রেট বেশ সমস্যা সৃষ্টি করে। তাই পরিমিত অনুসারে খাওয়া উচিত।
রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় ॥ প্রতি ১০ গ্রাম খেজুরে প্রায় ৭.৫ গ্রাম চিনি রয়েছে। এই চিনি স্বাস্থ্যকর হলে অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যাবে। ফলে আমরা ধীরে ধীরে ডায়াবেটিস, হৃদরোগের ঝুঁকি, কিডনি বা চোখের রোগসহ নানা রোগের সম্মুখীন হব।
হজমে সমস্যা তৈরি হয় ॥ সরাসরি তৈরি হওয়া গুড় খেলে আপনার ডায়রিয়া জনিত সমস্যা হতে পারে। আবার কোষ্ঠকাঠিন্য রোগেও ভুগতে পারেন। এজন্য আমাদের কিছু সময় বা ১ থেকে ২ দিন পর খেলে তেমন সমস্যা হবে না। এছাড়া, অতিরিক্ত খেলে হজমের সমস্যায় পড়তে পারেন।
জীবাণুর সংক্রমণ বৃদ্ধি পায় ॥ যদি গুড় তৈরি করতে যেয়ে প্রস্তুতপ্রণালীতে কিছু ভুল হয় বা অন্য জায়গা থেকে কিনলে সেই জায়গা যদি স্বাস্থ্যকর না হয় তাহলে সেই গুড়ে জীবাণুর সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই একসঙ্গে অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে আমাদের স্বাস্থ্যহানি বা বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হতে পারি।
মাছ ও গুড় একসঙ্গে খাওয়া যাবে না ॥ যাদের ‘আলসারেটিভ কোলাইটিস’ বা পরিপাকতন্ত্রে আলসারের সমস্যা রয়েছে তাদের বেশি গুড় খাওয়া উচিত নয়। মাছ ও গুড় একসঙ্গে খেলে পেটের সমস্যা, হজমে সমস্যা, অ্যালার্জি বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বাড়তে পারে।
রোগবালাই বৃদ্ধি পায় ॥ গুড়ে অনেক পরিমাণে সুক্রোজ থাকে বিধায় বেশি পরিমাণে খেলে বাতের ব্যথা কমার পরিবর্তে উল্টো বেড়ে যায়। তাই যারা এমন রোগে আক্রান্ত, তাদের বেশি না খাওয়া ভালো। কারণ, এতে থাকা ’ওমেগা ৩’ ফ্যাটি এসিড শরীরের প্রদাহ যন্ত্রণা বাড়িয়ে দেয়।
উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা তৈরি হয় ॥ যদি অনেক গরমে বেশি পরিমাণে গুড় খেয়ে থাকেন, তবে উচ্চ রক্তচাপের কারণে নাক দিয়ে রক্ত পড়তে পারে। এজন্য, প্রচন্ড গরমে সেবন না করাই উত্তম।
আমাদের জন্য খেজুর যেমন উপকারী, খেজুরের গুড়ও তেমনি উপকারী। আমরা খেজুর সবসময়ের জন্য সংরক্ষণ করতে পারি না। কিন্তু, অনেক দিনের জন্য খেজুরের গুড় সংরক্ষণ করে রাখা সম্ভব। এই গুড় আমাদের খাবারের স্বাদ অনেক পরিমাণে বাড়িয়ে দেয়। আমাদের ঝোলাগুড়ে কোনো প্রকার ক্ষতিকর বা রাসায়নিক পদার্থ নেই। এই বিশেষ খাবার আমাদের ঠাণ্ডা, কাশি ইত্যাদি দূর করার পাশাপাশি রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
রাজীব হাসান কচি, চুয়াডাঙ্গা