
.
শুরু থেকেই মোটামুটি এক ছন্দে চলছিল সব কিছু। কিন্তু এ পর্যায়ে এসে বাগড়া দিল বৃষ্টি। বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রথমবারের মতো বৃষ্টি হানা দেয় মেলায়। তারপর রাতে অবিরাম বর্ষণ। কয়েক দফা বর্ষণে মেলা প্রাঙ্গণ ভিজে একাকার। আয়োজক বাংলা একাডেমি প্রতিকার কিছু করতে পারেনি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। অমর একুশে বইমেলার ২৩তম দিনে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘুরে দেখা গেছে, এখানে পানি-ওখানে কাদা। বিশেষ করে উদ্যান অংশে ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল অনেক কিছু। মাঠে অগণিত মানুষের বিচরণের ফলে ঘাস উঠে গিয়েছিল আগেই। ন্যাড়া মাঠে বৃষ্টি পড়তেই কাদা হয়ে গেছে মাটি। কাদায় পা পিছলে পড়ে যাওয়ার ঘটনাও দেখা গেছে মেলায়।
শুক্রবার শিশু প্রহর থাকায় আগেভাগে, অর্থাৎ বেলা ১১টায় মেলার প্রবেশদ্বার খুলে দেওয়া হয়। তবে বৃষ্টি বিঘিœত মেলায় শিশুদের আগমন এদিন কমই ছিল। বিকেলের মেলার ছবিটাও অনেকখানি বদলে দিয়েছিল বৃষ্টি। স্টল প্যাভিলিয়নগুলোর জবুথবু অবস্থা হয়েছিল। স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ পাঠক মনের চাঞ্চল্য কেড়ে নিয়েছিল। সব দেখে মনে হয়েছে বড়সড় ছন্দপতন।
অবশ্য, অহেতুক ভিড় না থাকায় যারা সত্যিকারের বইপ্রেমী তারা সময়টা কাজে লাগিয়েছেন। স্বচ্ছন্দে বই দেখতে পেরেছেন তারা। সংগ্রহও করেছেন। শফিক নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী দুটি বই কিনে মেলা থেকে ফিরছিলেন। কথা প্রসঙ্গে বললেন, প্রথম দিকে একবার মেলায় এসেছিলাম। তখন নতুন কী বই মেলায় এসেছে পরিষ্কার ধারণা ছিল না। এখন তো শেষ পর্যায়। এখন বই না কিনলে পরে আর সময়ই পাব না। তাই পছন্দের দুটি বই কিনেছি। কিছু নতুন বইয়ের তালিকা সংগ্রহ করেছি। আরেকদিন এসে নিয়ে যাব।
সুমিত নামের আরেক পাঠক সরকারি চাকুরে। বললেন, বৃষ্টির মধ্যে মেলায় আসার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু একই কারণে যেহেতু লোক কম আসবে, ভিড় ঠেলতে হবে না তাই এসেছি। নীরবে বই দেখেছি। যেটা পছন্দ হয়েছে কিনেছি। তবে মেলায় খুব মৌলিক বই চোখে পড়েনি বলে অভিযোগ করেন তিনি।
মানসম্পন্ন বইয়ের অভাবের কথা স্বীকার করেন কোনো কোনো প্রকাশকও। এই যেমন আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনি বলছিলেন, মেলায় প্রকাশকই তো কম। বিক্রেতা বেশি। বই করার নামে প্রচুর কাগজ খরচ করেন তারা। পাইরেটেড বইয়ে মেলা ভর্তি হয়ে গেছে। আমরা যারা চ্যালেঞ্জ নিয়ে সৃজনশীল মননশীল বই প্রকাশ করি, অপ্রকাশকদের ভিড়ে সেগুলো তো হারিয়ে যায়। মেলা থেকে অপ্রকাশকদের বিদায় এবং অপাঠকদের অনুৎসাহিত করার পরামর্শ দেন বিদগ্ধ এই প্রকাশক।
১৯৭ নতুন বই ॥ অমর একুশে বইমেলার ২৩তম দিনে বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে জমা পড়েছে ১৯৭টি নতুন বই।
লেখক বলছি ॥ এদিন ‘লেখক বলছি’ অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন লেখক, পর্যটক ও পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক, কথাসাহিত্যিক নভেরা হোসেন, কবি কুশল ভৌমিক ও শিশুসাহিত্যিক আহমেদ জসিম।
বই-সংলাপ ও রিক্সাচিত্র প্রদর্শন মঞ্চের আয়োজন ॥ নতুন এই মঞ্চে বিকেলে পারস্য সাহিত্যের অনুবাদক ও লেখক অধ্যাপক শাকির সবুর রচিত সমকালীন ইরানের কবি ও কবিতা এবং ফারসি থেকে অনূদিত বুজুর্গে আলাভির তার চোখগুলো বই নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
মূলমঞ্চের আলোচনা ॥ বিকেলে বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘স্মরণ : আখতারুজ্জামান ইলিয়াস’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মামুন হুসাইন। আলোচনা করেন ওয়াসি আহমেদ এবং জাফর আহমদ রাশেদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস।
প্রাবন্ধিক বলেন, আমাদের কালের এক আশ্চর্য-নির্লোভ মানুষ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস চেনা বাস্তবতাকে প্রসারিত করেন প্রচলিত দৃষ্টি ও বুদ্ধিগ্রাহ্যতার ওপারে। আমাদের আদিকল্প, ইন্দ্রজাল, উপকথা তিনি চিনেছিলেন সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে। মধ্যবিত্তের ধসে পড়া সেতুর খোলনলচে দেখতে গিয়ে তিনি আঘাত করেছিলেন মধ্যবিত্তের গোপন পঙ্কিলময় শালীনতা, শুদ্ধতা ও নৈতিকতাকে। ইলিয়াসের মিথ পুরাণগর্ভ থেকে নয়, বরং বরেন্দ্রভূমির দূর অতীতের ইতিহাস থেকে তৈরি হয়। অর্থাৎ ইলিয়াসের ক্ষেত্রে মিথের জন্মভূমি যত না পুরাণের ঐতিহ্য, তার থেকেও বেশি মানুষের জীবনযাপনের অতীত ইতিহাস।
আলোচকরা বলেন, বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত শক্তিমান লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্যদর্শন, সংশীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে জানতে হলে তাঁর সাহিত্য পাঠ একান্ত জরুরি। তিনি ছিলেন সংবেদনশীল ও অনুসন্ধিৎসু একজন লেখক। সমাজের নানা দিকে তাঁর সাহিত্যিক দৃষ্টি ছিল প্রসারিত। তিনি তাঁর চিন্তাশীলতার মধ্য দিয়েই একজন পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। সন্ধ্যায় ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।