ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ১৬ অগ্রাহায়ণ ১৪৩০

শেয়াল মরে তালের গন্ধে

মো. আশতাব হোসেন

প্রকাশিত: ২০:২৫, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩

শেয়াল  মরে  তালের  গন্ধে

.

গ্রামের নাম ইসলামাবাদ। পূর্বে নাম ছিল বৈড়াগিটারি। সেই গ্রামের ছোট এক বিলের পাড়েই খুব পুরাতন একটি তাল গাছ, গাছটির গোড়াতে কিছু ছোট ছোট উদ্ভিদ জন্মে একটি ঝোঁপ হয়েছে। তাল গাছটিতে প্রতি বছর অনেক তাল ধরে। কিন্তু অনেক বড় হওয়ার কারণে মানুষের গাছটিতে ওঠা কষ্টকর হয়ে যায় তাই কেউ তাল পাড়ে না। ভাদ্রমাসে সেই তাল পেকে বাতাসে গন্ধ ছড়ায় চারদিকে। এক রাতে দুটি শেয়াল তালের গন্ধ পেয়ে লোভ সামলাতে না পেরে তাল খাওয়ার জন্য গাছের নিচে যায়, গিয়ে দেখে বড় সাইজের একটি পাকা তাল পড়ে আছে। পুরুষ শেয়াল হুক্কুটুসু আগে তালের গন্ধ শুকে তৃষিত প্রাণ জুড়িয়ে নেয়। পরে তার স্ত্রী তুলিটুসিকে বলে কি মজার গন্ধ ফলটি থেকে বের হচ্ছে! তুলিটুসিও বলে তাইতো অনুভব করছি, স্বাদেও মনে হয় ভারি মজা হবে।

হুক্কুটুসু বলে হ্যাঁ, অনেক মজা হবে, বেজায় মনে হচ্ছে। এই বলে সে তালে কামড় দেয়, কিন্তু তাল থেকে আঁশ ছাড়া আর কিছুই পাচ্ছে না। হুক্কুটুসু খুব জোরে জোরে কামড় মারছে তো মারছেই। কামড়াতে কামড়াতে শরীর থেকে গড়গড়িয়ে ঘাম ঝরছে। তুলিটুসি কলার পাতা দিয়ে বাতাস করে চলছে তার জামাই বাবুকে। তাল গাছের গোড়ায় ঝোঁপের ভিতরে মাটি খুড়ে ইঁদুর বাসা করে বসবাস করে আসছিলো। সেই বাসায় ইঁদুর দম্পতি চারটি বাচ্চা দিয়েছিলো। বাচ্চাগুলি একটু বড় হয়ে গাছের গোড়ায় একদিন খেলতে আসলে দুষ্ট শেয়াল হুক্কুটুসুর নজরে পড়ে। যেমনি দেখা তেমনি কাজ, ঘপ ঘপ করে চারটি বাচ্চাই মুখের ভিতর পুরে নেয়। তখন শেয়ালটি মাত্র বিয়ে করেছিল। তার নববধূ আবার ইঁদুরের সিক কাবাব খেতে  আবদার করেছিল। আর যাই হোক নববধূ তুলিটুসির মন রক্ষার জন্য ইঁদুরের ছোট ছোট বাচ্চাগুলো মুখে পুরে তার বউকে সিক কাবাব তৈরি করে খাওয়াচ্ছিল। সেই সঙ্গে নিজেও দুটি বাচ্চা আগুনে পুড়িয়ে কাবাব করে খেয়েছিল।

এবার ইঁদুরটি শেয়ালের তাল কামড়ানো দেখে মনে মনে ভাবছে, এই দুষ্টই আমার সব সর্বনাশ করেছিল। এবার যদি একটু সুযোগ হয় তবে ওর জীবনের দফারফা করে ছাড়ব। এদিকে শেয়াল হুক্কুটুসু গায়ের জোরে তাল কামড়াতে কামড়াতে দাঁতের অবস্থা নাজেহাল করে ফেলেছে এবং পাকা তালের সব আঁশ দাঁতে পেঁচিয়ে একাকার!

তাল খাওয়া হচ্ছে না আর দাঁত থেকে আঁশও ছাড়াতে পারছে না। ভারি মুশকিলে পড়ে যায় শেয়াল হুক্কুটুসু।

তালের আঁশ জড়িয়ে একেবারে পাট গুদাম হয়ে গেছে শেয়ালের মুখে। কথাও বলতে পারছে না, বউ তুলিটুসিকে কোনো রকমে ইশারা করে বলে ইঁদুরকে খবর দিতে।

তুলিটুসি স্বামীর এমন নাজুক অবস্থা দেখে চিৎকার করে বলতে থাকে, কে আছোগো... আশপাশে জলদি করে এসে আমার স্বামীকে বাঁচাও... বাঁচাও!

ইঁদুর খুশি হয়ে মনে মনে বলছে, এবার বুঝি সুযোগ এসে গেল, আমার বাচ্চা হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার। এই ভেবে গর্ত থেকে বের হয়ে বলে কে রে? তোরা আমার ঘুমের ডিসটার্ব করছিস! তখন তুলিটুসি বলে ইঁদুর ভাই, আমরা খুব বিপদে পড়েই এমন চেঁচামেচি করছি। তুমি দয়া করে আমার স্বামীকে রক্ষা কর। তুমি ছাড়া কাজ আর কেউ পারবে না ইঁদুর ভাইয়া, হাত জোর করে বলে ইঁদুরকে। ইঁদুর বলে আচ্ছা দেখি কি করা যায়, তুমি ঠিক মতো জোরে জোরে বাতাস করো হুক্কুটুসু দাদাকে।

এই বলে ইঁদুর শেয়ালের সামনে গিয়ে তার ধারালো দাঁত দিয়ে আগে মুখের তালের আঁশ কেটে একটি রাস্তা তৈরি করে নিয়ে বলে এবার মুখের ভিতরে গিয়ে দাঁতে লেগে থাকা আঁশগুলো কেটে পরিষ্কার করতে হবে। এদিকে শেয়াল হুক্কুটুসু জীবন যায় যায় অবস্থা, শরীর তার ঘামছে তো ঘামছেই! তুলিটুসি ইঁদুরকে বলে জলদি করো ভাইয়া, যেমন করেই হোক তুমি আমার স্বামীকে আগে রক্ষা করো। এবার ইঁদুর তুলিটুসিকে বলে আমি ভিতরে যাই তুমি ঠিক মতো বাতাস করতে থাকো। বাতাস যেন মুখের ভিতরেও যায় কারণ সবার মুখের ভিতরে অনেক গরম, গরম বেশি লাগলে আমার কাজ করা কঠিন হবে এবং বিলম্বও হবে। এই বলে ইঁদুর শেয়ালের মুখের ভিতরে ঢুকে সোজা পেটের ভিতরে চলে যায়। তুলিটুসিতো বাতাস দেওয়ার কাজেই ব্যস্ত! ইঁদুর ভিতরের ঢোকার জন্য শেয়ালটির মুখ পরিষ্কার করে যে রাস্তা তৈরি করেছিল তাতে শেয়াল হুক্কুটুসুর কিছু সুবিধাও হয়েছে সে গড়গড়িয়ে কিছু কথাও বলতে পারছে।

এদিকে ইঁদুর শেয়ালের মুখে ঢুকে সোজা পেটের ভিতরে চলে গিয়ে শেয়ালের নাড়িভুঁড়ি কাটা শুরু করেছে। শেয়াল তো ব্যথায় পাগলের মতো চিৎকার করছে তো করছেই! তুলিটুসি শেয়ালের মুখের মুখ লাগিয়ে বলছে কি গো ইঁদুর ভাইয়া তুমি কই গেলে? এবং কী করছো? আমার হুক্কুটুসু তো যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছে!

ইঁদুর শেয়ালের পেটের ভিতর থেকে চেঁচিয়ে বলছে, ভিতরে তো আরও অবস্থা খারাপ দেখছি, তালের আঁশ এখানেও রসের সঙ্গে গড়িয়ে এসে জমাট বেঁধেছে। এগুলো পরিষ্কার করছি আর আমার বাচ্চাদের খুঁজছি!

কথা শোনার সঙ্গেই তুলিটুসি কি যেন ভাবতে লাগল! সে চিৎকার করে বলে কিগো ইঁদুর ভাইয়া তুমি কি সব বলছো? তোমার বাচ্চা ওখানে যাবে কেনো গো! কিন্তু তুলিটুসির বুঝার বাকি রইল না, মনে পড়ে গেল সেই কাবাব খাওয়ার কথা! ইঁদুর তো শেয়ালের নাড়িভুঁড়ি কেটে সাবার করে দিচ্ছে। শেয়াল ব্যথায় একাধারে চিৎকার করে বলছে, মরে গেলাম রে বাবা... মরে গেলাম! এদিকে রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে গেছে। এক কাঁঠঠোঁকড়া পাখি সেখান দিয়ে উড়ে যেতে যেতে শেয়াল তার বধূর চিৎকার শুনে কাছে এসে বলে, কীগো তোমাদের কি হয়েছে বল তো দেখি, তুলিটুসি পুরা ঘটনা বলে কাঠ ঠোঁকড়াকে অনুরোধ করে তার স্বামীর পেটে ছিদ্র করে ইঁদুরটিকে বের করে আনতে। কাঁঠঠোঁকড়া আর দেরি না করে সমানে শেয়ালের পেটে তার শক্ত ধারালো ঠোঁট কুড়ালের মতো মারতে থাকে! কিছুক্ষণের মধ্যেই  একটি গর্ত করে পাখিটি বসে বিশ্রাম নিচ্ছে এমন সময় ইঁদুর শেয়ালের পেট থেকে বের হয়ে দৌড়ে ঝোঁপের ভিতর চলে যায়।

কাঁঠঠোকড়া শেয়ালের করুণ পরিণতি দেখে সেও ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়।

অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার