ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী ঢাকার টমটম গাড়ি

​​​​​​​মামুন শেখ, জবি সংবাদদাতা

প্রকাশিত: ২০:১৯, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩

হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী ঢাকার টমটম গাড়ি

ঘোড়ায় টানা এই টমটম সদরঘাট থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন করছে

পুরান ঢাকার বাংলাবাজার এলাকার ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের সামনে থেকে হাঁক-ডাক আসছে, ‘গুলিস্তান ৩০, গুলিস্তান ৩০।পাশেই দাঁড়িয়ে আছে দুই ঘোড়ায় বানানো টমটম গাড়ি; অনেকেঠিকা গাড়ি বলে। হাঁক-ডাক যতটা, যাত্রীদের সাড়া ততটা নেই। শেষমেশ ১৫ আসনের গাড়িতে পাঁচ-সাতজন যাত্রী তুলেই রওনা দিচ্ছে গুলিস্তানের দিকে। কোচওয়ান (চালক) মালিকরা বলছেন, টমটমের জনপ্রিয়তা দিন দিন কমছে। এভাবে কমতে থাকলে টমটম এক সময় রাজধানীর সড়ক থেকে হারিয়ে যাবে।

টমটমের একাধিক মালিক জানান, আধুনিক পরিবহন, যানজট ঘোড়া পোষার খরচ বাড়ায় টমটম গুরুত্ব হারিয়েছে। ফলে পেশার লোকজনের আর্থিক দুরবস্থা বেড়েছে। বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন অনেকে।

১৯৭৬ সাল থেকে ঘোড়ায় টানা এই টমটম সদরঘাট থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন করছে। রাজধানীর নিমতলী এলাকার বাসিন্দা মো. খোরশেদ। তারা তিন পুরুষ ধরে টমটম ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। পোষাতে না পেরে সম্প্রতি তিনি টমটম ছেড়ে মোটর পার্টসের দোকানে কাজ নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘একটা গাড়ির পেছনে দিনে এক হাজার টাকা খরচ হয়। অথচ যানজট বাড়ায় এখন দিনে তিনবারের বেশি যাওয়া-আসা করা যায় না। আগে ছয়-সাতবার করা যেত। আয়ের চেয়ে ব্যয়ই বেশি। তাই বাধ্য হয়ে পারিবারিক ব্যবসায় ইতি টেনেছি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৮৩০ সালে পুরান ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন শুরু। কারও কারও মতে, শাঁখারীবাজারে আর্মেনীয় বণিকদের প্রতিষ্ঠানসিরকো অ্যান্ড সন্স১৮৫৬ সালে ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন করে। জমিদারি বাহনের পাশাপাশি এটি তখন আর্মেনীয়দের ব্যবসার মাল টানার কাজেও ব্যবহৃত হতো। এরপর নবাবি শাসনামলেও ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন ছিল। পরবর্তী সময়ে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। কয়েক বছর আগেও সদরঘাট গুলিস্তানের মধ্যে প্রায় ৫০টি টমটম চলত। কমতে কমতে এখন দাঁড়িয়েছে ২৫টিতে।

কোচওয়ানরা জানান, সময় বাঁচাতে মানুষ এখন বাস মোটরসাইকেলের মতো দ্রুতগতির যান বেছে নেয়। কারণেও টমটমের জনপ্রিয়তা কমছে। ফারহান নামে এক কোচওয়ান বলেন, ‘সব খরচ বাদ দিয়ে যে টাকাটা থাকে, সেটা দুজন কর্মীর বেতন এবং মালিককে দিতে হয়। আমি সারাদিন খেটে তিন-চারশ বেশি পাই না। এই টাকায় সংসার চালানো কষ্টকর।

পারিবারিকভাবে টমটম ব্যবসায় যুক্ত এক ব্যক্তি বলেন, ‘ব্যবসাটা টিকে আছে দুটি কারণে। প্রথমটা হলো বংশগত ব্যবসা ছাড়তে পারি না। দ্বিতীয়ত, শীতকাল এলে বিয়ে-শাদীর সময় গাড়ির কিছু চাহিদা তৈরি হয়। সময় গাড়ি ভাড়া দিয়ে কিছু আয় হয়। তবে যেভাবে সবকিছুর খরচ বাড়ছে, তাতে অচিরেই হয়তো এই ব্যবসায় ইতি টানতে হবে।

রাজধানী ঢাকার নবাবী আমলের আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে জায়গা করে নিয়েছিল ঘোড়ার গাড়ি বা টমটম। পুরান ঢাকার টমটমের সঙ্গে মিশে আছে ঢাকার ঐতিহ্য ইতিহাসের নানা অংশ। অতীতে রাজা-বাদশাহ, আমির-ওমরাহ, জমিদাররা ঘোড়ার গাড়িকেই প্রধান বাহন হিসেবে ব্যবহার করতেন। বিয়ে বা বড় কোনো আনুষ্ঠানিকতায় টমটম থাকলেই অভিজাত হিসেবে গণ্য করা হতো। যাত্রী পরিবহন ছাড়াও টমটম ব্যবহৃত হয় বিয়ে, পূজা, বিভিন্ন দিবসের শোভাযাত্রা সিনেমার শূটিংয়ে। এসব কাজে ফুলের মালা দিয়ে আর রঙিন কাগজ কেটে নকশা বানিয়ে সাজানো হয় ঘোড়া আর গাড়ি দুটোকেই। আর কোচওয়ান হেলপারের জন্যও ওই সব অনুষ্ঠানে রয়েছে বিশেষ পোশাক। বিশেষ করে পুরান ঢাকার বিয়েতে ঘোড়ার গাড়ি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

তবে এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে ঢাকার ঐতিহ্য টমটম। জানা যায়, ১৮ শতকের প্রথম দিকে ঢাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে আর্মেনীয়রা ছিল অন্যতম প্রভাবশালী বণিক সম্প্রদায় এবং ১৮৫৬ সালে সিরকো নামীয় একজন আর্মেনীয়ই প্রথম ঢাকায় টমটমের প্রচলন করেন। অর্থাৎ টমটমের গর্বিত ইতিহাস প্রায় দেড়শবছরের। রাজকীয় এই বাহনটি প্রায় ১৫০ বছরের বেশি সময় ধরে দেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকলেও এই পেশার সঙ্গে জড়িতরা জীবন জীবিকার তাগিদে বর্তমানে অন্য পেশার প্রতি ঝুঁকছেন। বঙ্গবাজারের নবাবী টমটম সার্ভিসের স্বত্বাধিকারী টুকু খান বলেন, ঘোড়ার খাবার রক্ষণাবেক্ষণ, চালক হেলপারের বেতনসহ আনুষঙ্গিক খরচ জোগানো সম্ভব হচ্ছে না বলে টমটমের ব্যবসা অনেকেই বন্ধ করে দিয়েছেন।

দীর্ঘদিন ধরে একটি আস্তাবলের দাবি জানিয়ে এলেও এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো রকমের সাড়া পাইনি। আগে বঙ্গবাজার, ফায়ার সার্ভিস, পশু হাসপাতাল, বকশীবাজার, নারিন্দা, সিদ্দিকবাজার, কেরানীগঞ্জসহ কয়েকটি রুটে প্রায় শতাধিক টমটম চলাচল করলেও এখন শুধু গুলিস্তান থেকে সদরঘাট রুটে মাত্র ২৫টি টমটম চলাচল করে।

কয়েক বছর আগেও প্রতিটি টমটম দৈনিক প্রায় তিন হাজার টাকার মতো আয় করলেও এখন মাত্র ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা আয় করে। প্রতিদিন একটি ঘোড়া প্রায় ৫০০ টাকার খাবার খায়, টমটমের চালককে দিতে হয় ৩০০ টাকা, আর হেলপারকে ২০০ টাকা। ঘোড়ার খাবার, চালক হেলপার বাবদ একটি গাড়ির পেছনে দৈনিক খরচ হয় ১২০০ টাকার মতো। কিন্তু একটি গাড়ি দৈনিক আয় করে ৮০০ টাকা। অর্থাৎ রাস্তায় গাড়ি নামালে প্রতিদিন ৪০০ টাকা করে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। আমাদের অস্তিত্ব বর্তমানে হুমকির মুখে।

সরকারি অনুদান বা পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে এই ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছি।

ঢাকার ঐতিহ্য পৈত্রিক ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য ভালোবাসার কারণেই এখনো এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছি। আধুনিকতার জাঁতাকলে ঢাকাই এই ঐতিহ্য বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বাস, কার, অটোরিক্সাসহ নানা ধরনের যানবাহনের আধিক্যের কারণে এই বাহনের কদর বর্তমানে শূন্যের কোটায়। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের আন্তরিক কার্যকর পদক্ষেপ ছাড়া ঘোড়ার গাড়ি বা টমটমকে টিকিয়ে রাখা অসম্ভব বলে জানিয়েছেন এই পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

×