.
মানুষের মাঝে বেঁচে থাকার বিপুল তৃষ্ণা ছিল রবীন্দ্রনাথের। এ তৃষ্ণার কথা জানিয়ে কবিগুরু লিখেছিলেন, মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই...। কিন্তু মৃত্যু যে অমোঘ। সে অমোঘ পরিণতির কাছে হার মানতে হয় এই মহামানবকেও। সবাইকে কাঁদিয়ে প্রিয় পৃথিবী থেকে চির প্রস্থান গ্রহণ করেন তিনি। আজ ২২ শ্রাবণ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮২তম প্রয়াণ দিবস। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে অনন্তের পথে যাত্রা করেন তিনি। ‘মরণ রে,/তুঁহুঁ মম শ্যামসমান... মৃত্যু-অমৃত করে দান।’ অমৃতের সন্ধানে পাড়ি জমান অন্য ভুবনে।
বহুকাল আগে নির্বাসন নিলেও, রবীন্দ্রনাথ বাঙালির হৃদয়রাজ্যে রাজা হয়ে আছেন। বাঙালির প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে, বোধের সঙ্গে, চর্চার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি লিখেছিলেন বটে, ‘তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,/তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।’ কিন্তু বাঙালি নিজের প্রয়োজনেই তাকে ডেকে চলেছে। সৃষ্টির আলোয় খুঁজে চলেছে কবিগুরুকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সংগীত স্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, প্রবন্ধিক, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে তার সাহিত্য। ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। তার এ প্রাপ্তি বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় অর্জন। নিজ কর্মের মাধ্যমে একটি কালের সূচনা করে গেছেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথ কৈশোর পেরোনোর আগেই বাংলা সাহিত্যের দিগন্ত বদলে দেয়ার আভাস স্পষ্ট করেন। তার পরিণত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিণত হয়েছে বাঙালির শিল্প-সাহিত্য ভান্ডার। বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্য সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। তার সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের কাব্য সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা, চিত্ররূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোমান্টিক সৌন্দর্য চেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্যে, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা। রবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষাও কাব্যিক। ভারতের ধ্রুপদ ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তার রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন। সাহিত্যের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের গান বাংলা সংগীত ভান্ডারকে দারুণভাবে সমৃদ্ধ করেছে। আজকের বদলে যাওয়া সময়েও বিপুল ঐশ্বর্য নিয়ে টিকে আছে রবীন্দ্রসংগীত। এর আবেদন যেন কোনোদিন ফুরাবার নয়। বরং যতদিন যাচ্ছে ততই রবীন্দ্রসংগীতের বাণী ও সুরের ইন্দ্রজালে নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছে বাঙালি। তাদের আবেগ, অনুভূতি কবিগুরুর গানের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জাতীয় সংগীতেরও রচয়িতা তিনি। বহু প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় সত্তর বছর বয়সে নিয়মিত ছবি আঁকা শুরু করেন। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে অঙ্কিত তার স্কেচ ও ছবির সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি। দক্ষিণ ফ্রান্সের শিল্পীদের উৎসাহে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তার প্রথম চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় প্যারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে। এরপর সমগ্র ইউরোপেই কবির একাধিক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। তার আঁকা ছবিতে আধুনিক বিমূর্তধর্মিতাই বেশি প্রস্ফুটিত হয়েছে।
মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ মানুষের ওপর দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল ছিলেন। তার মতে, মানুষই পারে অসুরের উন্মত্ততাকে ধ্বংস করে পৃথিবীতে সুরের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে। তাই ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেনÑ ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।’ ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার কবিকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করে। কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা-ের প্রতিবাদে সেই উপাধি বর্জন করেন তিনি।
সমাজের কল্যাণেও নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সমাজকল্যাণের উপায় হিসেবে তিনি গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন। এর পাশাপাশি সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের দর্শন চেতনায় ঈশ্বরের মূল হিসেবে মানব সংসারকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তিনি দেববিগ্রহের পরিবর্তে কর্মী অর্থাৎ মানুষ ঈশ্বরের পূজার কথা বলেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ চার বছর ঘন ঘন অসুস্থতার মধ্য দিয়ে গেছে। এ সময়ের মধ্যে দু’বার অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল কবিকে। ১৯৩৭ সালে একবার অচৈতন্য হয়ে গিয়েছিলেন। আশঙ্কাজনক অবস্থা হয়েছিল। তখন সেরে উঠলেও ১৯৪০ সালে অসুস্থ হওয়ার পর আর তিনি সুস্থ হননি। ‘চুকিয়ে দেব বেচা কেনা,/মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনা দেনা...।’ পৃথিবীর সঙ্গে লেনা দেনা সব চুকিয়ে দেন তিনি। তবে বাঙালির সমস্ত অনুভূতিজুড়ে তিনি আছেন। অস্তিত্বজুড়ে আছেন। থাববেন।
