
গেন্ডারিয়া হাই স্কুলের সামনে লেখকসহ ‘ইতিহাস চর্চা ও রক্ষা গ্রুপ’
ছুটির দিনটির অপেক্ষায় থাকা হয় সপ্তাহের প্রথমদিন থেকেই। রাস্তা ফাঁকা থাকায় এ সময়ে প্রিয় বাহন সাইকেলে চড়ে বেড়ানোর মজাই আলাদা! সেরকম একটি দিনে পুরান ঢাকার কিছু ঐতিহ্যবাহী ও কালের সাক্ষী জায়গাগুলো দেখতে যাওয়া।
ঐতিহাসিক গেন্ডারিয়া : বেশ কিছুদিন থেকে ঐতিহাসিক এই জায়গায় যাবার ইচ্ছে ছিল। আর সঙ্গে আনাচে-কানাচে কালের সাক্ষী জায়গাগুলো দেখার। আগে থেকে জানা ছিল পায়ে হেঁটে একটি ইতিহাস চর্চা ও রক্ষা গ্রুপ (এসটিএইচবি) গেন্ডারিয়াসহ বহু ঐতিহাসিক জায়গাগুলো পরিদর্শন করে। তাদের সঙ্গে সহযাত্রী হয়ে গেলাম আমরা ক’জন। অবশ্য দুই চাকার সাইকেল নিয়ে। বলা হয়ে থাকে, একবার এক ইংরেজ পর্যটক ঘোড়ায় চড়ে গেন্ডারিয়ার লোহারপুলের পাদদেশে এসে চারপাশের দৃশ্য দেখে বলেছিলেন, ‘What a grand Area!’ সেই থেকে এলাকাবাসী এই আবাসিক এলাকার নাম দেন ‘গেন্ডারিয়া’। আবার অনেকে বলেন- তখন দয়াগঞ্জ, মীরহাজিরবাগ এলাকায় প্রচুর গেন্ডারি বা আখের চাষ হতো। সেই থেকে এর নাম হয় ‘গেন্ডারিয়া’।
১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত সতিশ সরকার রোডে অবস্থিত গেন্ডারিয়া হাই স্কুলের সামনে সবাই জড়ো হলাম। অদূরে ছিল দীননাথ সেন এর ভিটা। যিনি বাংলার কিংবদন্তি চলচ্চিত্র অভিনেত্রী মহানায়িকা সূচিত্রা সেনের দাদাশ্বশুর ছিলেন। কিছুদূর এগুলে স্থানীয়দের মতে প্রায় ৩০০ বছরেরও বেশি পুরনো সমাধি মঠ। পথে বেশকিছু শতবর্ষী পুরনো ইমারত, মসজিদ, মন্দির ও স্থাপনা এখনো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখানে একটি লোহারপুল ছিল, সেটি এখন নেই। তবে নামটি রয়ে গেছে। এ পুলটির নিচ দিয়ে বয়ে চলত ধোলাই নদী/খাল। কথিত আছে এই খাল দিয়ে চলত বড় বড় বজরা নৌকা। সেই আমলের দোতলা ইমারতের কাঠের টানা বারান্দা, লোহা, ইট সুরকির উপরে কারুকাজ। কিছুদূর এগুলে দীননাথ সেন রোডে অবস্থিত ঐতিহাসিক সাধনা ঔষধালয় ফ্যাক্টরি। ভারত উপমহাদেশের বিখ্যাত আয়ুর্বেদ ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। ১৯১৪ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলার সূর্য সন্তান কিংবদন্তি আয়ুর্বেদ বিশারদ ও শিক্ষাবিদ শহীদ অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র ঘোষ। তাঁর দরজায় গিয়ে কোনো অসহায় মানুষ দাঁড়িয়েছেন, আর খালি হাতে ফিরে এসেছেন- এমন সাক্ষ্য কেউ দিতে পারবেন না। আর্ত-দুস্থ মানুষের শেষ আশ্রয় ছিলেন তিনি। এমনও হয়েছে যে, কোনো দরিদ্র মানুষজন মামলায় লড়তে পারছেন না, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা পণের জন্য মেয়ে বিয়ে দিতে পারছেন না, কেউ ঋণগ্রস্ত, কেউ অভাবে পড়ে ভিটেমাটি হারিয়েছেন- তিনিই যেন তাদের শেষ আস্থার স্থান। অকাতরে ব্যবস্থা করে দিতেন তিনি। তার দুই হাত যেন ছিল কেবলই বিলিয়ে দেওয়ার। তিনি ১৯৭১ সালে শহীদ হন। পরবর্তী সময়ে তাঁর পুত্র প্রয়াত ডা. নরেশচন্দ্র ঘোষ এর হাল ধরেন। বর্তমানে অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র ঘোষ এর নাতনিরা দেখাশোনা করেন। বিপুল সাফল্যের কারণে এক সময় চীন ও উত্তর আমেরিকায় সাধনা ঔষধালয়ের শাখা বা এজেন্সি ছিল।
গেন্ডারিয়ার ভাটিখানা এলাকায় রয়েছে একটি পুরনো পানির ট্যাংক। অনেকটা বাহাদুর শাহ পার্কের নিকটে। ১৮৭৮ সালে তৈরি ঢাকার প্রথম পানির ট্যাংকের মতো। সম্ভবত ভাটিখানার এ পানির ট্যাংকটি সমসাময়িক সময়ে প্রতিষ্ঠিত। এখনো এ এলাকায় পানি সাপ্লাই দেওয়া হচ্ছে এটি দিয়ে।
এক সময়ের প্রমত্তা বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছিল মিল ব্যারাক নামের জায়গাটি। ১৮৭০ সালে তোলা ব্রিটিশ লাইব্রেরির একটি অজানা ফটোগ্রাফারের ছবিতে দেখা যায় দুই পাশে নদী, সবুজ গাছপালা, নদীর পারে একটিমাত্র ভবন। তবে আকারে বেশ বড়সড়। ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, উনিশ শতকের প্রথমভাগে জনৈক ইংরেজ বুড়িগঙ্গার তীরে সূত্রাপুরে ‘ঢাকা সুগার ওয়ার্কার্স কোম্পানি’ নামে একটি চিনির কল চালু করেন। কারখানাটি অল্প দিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেলে উইলিয়াম ফলি নামে আরেক ইংরেজ কলটি কিনে ‘ফ্লাসিস ফ্লাওয়ার মিল’ নামের একটি ময়দার কারখানা বানান। তবে ১৮৫৭-৫৮ সালে ভারতবর্ষে সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হলে ঢাকায় বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশ সেনাদের আনা হয়। তখন তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয় এই মিলে। এমনকি বিদ্রোহ দমনের পরও মিলের বৃহৎ গুদামঘরগুলো সংস্কার করে সেখানে সৈন্যদের ব্যারাক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তখন থেকে এটি মিল ব্যারাক নামে পরিচিত। ১৮৬৭ সালে ব্রিটিশ সরকার মিল ব্যারাক ও আশপাশের কয়েকটি ইমারতকে ক্যান্টনমেন্ট ঘোষণা করে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর পূর্ব বাংলা-আসাম প্রদেশের রাজধানী হয় ঢাকা।
তখন থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত আসাম ও বেঙ্গল পুলিশের উপ-পরিদর্শক এবং কনস্টেবলদের প্রশিক্ষণ বিদ্যালয় হিসেবে মিল ব্যারাক ব্যবহার করা হয়। ১৯১২ সালের পর এটি ঢাকা জেলা পুলিশের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৯৬৩ সালে রাজারবাগে পুলিশ লাইন চলে গেলে মিল ব্যারাকে ঢাকা জেলা পুলিশ লাইন স্থাপিত হয়। ১৯৮৪ সালে মিল ব্যারাকের পূর্বাংশে বাংলাদেশের একমাত্র ট্রাফিক ট্রেনিং স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এই এলাকায় রয়েছে বেশকিছু পুরনো শতবর্ষী মন্দির, বটগাছ। তবে এখন আশপাশে উঠে গেছে বহু ভবন। প্রায় মৃত ধোলাইখাল। এই মিল ব্যারাকের সেই ইমারতগুলো এখনো বিদ্যমান। ঐতিহাসিক দুটো মসজিদও রয়েছে এখানে।